কোলরিজের কবিতা: বুড়ো নাবিকের গান (প্রথমাংশ)

ভূমিকা

ইংরেজ রোমান্টিক কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ তাঁর এই কবিতা “দ্যা রাইম অব দ্যা এইনশানট মেরিনার” এর জন্য সুবিখ্যাত। কবিতাটা মূলত কাহিনী নির্ভর। প্রশান্ত মহাসাগরে প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়ে, অদ্ভুত সব ঘটনা আর এডবেঞ্চারের মধ্য দিয়ে কিভাবে বৃদ্ধ নাবিক দেশে ফিরে আসে সেই লোমহর্ষক ভূতুড়ে কাহিনী বুড়ো লোকটি মানুষকে ধরে বসিয়ে শোনায়। একবার, দুইবার, বারবার। কবিতাটা শুরু হয় একটা বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে। কবিতার কাহিনী সিনেমার মতই মাঝে মাঝে বিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। আবার মূল কাহিনীতে ফিরে যায়। কবিতাটার সাতটি অংশ। একটু দীর্ঘ হলেও কবিতাটা পড়তে গিয়ে ক্লান্তি আসে না। মূল কবিতা অন্তমিলে লেখা হলেও অনূদিত কবিতায় কোনো ছন্দমিল নেই।

অনুবাদ

ইনি একজন বৃদ্ধ নাবিক,
এবং তিনি প্রতি তিনজনে একজনকে ডেকে দাঁড় করান,
হে নাবিক, তোমার দীর্ঘ ধূসর দাড়ি আর চকচকে চক্ষু,
এখন আমার পথ কেন আগলে দাঁড়িয়েছো?

বরের ঘরের দরজাগুলো হাট খোলা,
এবং আমিই পরবর্তী কুটুম,
নিমন্ত্রিতরা জড়ো হয়েছে, ভোজন পর্ব শুরু হয়েছেঃ
হয়তো এখন কানে আসবে উচ্ছ্বাসের আওয়াজ।

লোকটাকে আঁকড়ে ধরলো হাড্ডিসার হাতে,
“একদা একটা জাহাজ ছিলো”, বলল সে।
“ছাড়ো!” ছেড়ে দাও আমায়, দাড়িওয়ালা বুড়ো পাগল!
দ্রুত তাঁর হাতটা ছেড়ে দিলো সে।

এখন সে হাতে নয় তাঁকে আটকে রেখেছে তাঁর চকচকে চক্ষু দ্বারা —
বিয়ের-অথিতি লোকটা থমকে দাঁড়িয়েছিল,
এবং সে শুনে যাচ্ছে ঠিক তিন বছরের বাচ্চার মতইঃ
নাবিকের গল্প বলার ইচ্ছাটাও তীব্র।

অতিথি লোকটা বসে পড়লো একটা পাথরের উপরঃ
এখন গল্প শোনা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তাঁর;
অতঃপর সে কথা ছুঁড়লো বৃদ্ধটার উপর,
সেই উজ্জ্বল চক্ষুবিশিষ্ট বৃদ্ধ নাবিকটা।

‘হর্ষধ্বনিতে ভরে উঠেছিলো জাহাজটা, খালি করা হয়েছিলো বন্দরটা,
উচ্ছ্বসিত আমরা ধীরে চলতে শুরু করলাম
গির্জার নিচ দিয়ে, পর্বতের নিচ দিয়ে,
উঁচু ঐ বাতিঘরটার নিচ দিয়ে।

সূর্যটা উদিত হলো বাঁ দিকটায়,
যেন সে সমুদ্রের নিচ থেকে ভেসে উঠলো!
এবং সে ছড়িয়ে দিলো তাঁর উজ্জ্বল আলো, ডান দিকটায়,
তারপর আবার ডুব দিলো সমুদ্রে।

উঁচুতে, আরও উঁচুতে প্রতিটা দিন,
ঠিক অপরাহ্নে ঐ মাস্তুলের মাথা পর্যন্ত —’
এখানে এসে অতিথি লোকটা বুকে চাপড় মারলো,
বিয়ে বাড়ির বাদ্যযন্ত্রের প্রবল আওয়াজ শুনে।

নববধূকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো হল ঘরটায়,
তাঁকে গোলাপের মতই রাঙ্গা দেখাচ্ছিলো;
বিয়ের গায়করা গান গেয়ে, মাথা নেড়ে
অভিবাদন জানাচ্ছিলো তাঁকে।

অতিথি লোকটা বুকে চাপড় মারল,
এখনো তাঁর গল্প শোনা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই,
অতঃপর সে কথা ছুঁড়লো বৃদ্ধটার উপর,
সেই উজ্জ্বল চক্ষুবিশিষ্ট বৃদ্ধ নাবিকটা।

এবং এখন ঝড়ের ঝাপটা আসলো,
বড় নিষ্ঠুর আর শক্তিশালী সেই ঝাপটা,
সে আঘাত হানলো তাঁর প্রশস্ত পাখাগুলো দিয়ে,
আমাদেরকে তাবড়ে পাঠালো দক্ষিণে।

ঢলে পড়া মাস্তুল, ডুবে যাওয়া গলুই,
যেন কেউ খুঁজেছিলো চিৎকার করে আর ক্ষিপ্রতায়
এখনো পদদলিত করছে তাঁর শত্রুর ছায়াটাকে,
আর সামনে ঝুঁকে আছে তাঁর মাথা,
জাহাজটা যত দ্রুততর হচ্ছিলো, ঝড়টাও তত গর্জে উঠছিলো।
আমরা পালিয়ে গেলাম দক্ষিণ অভিমুখে।

এবং এখন আসলো তুষার আর কুয়াশা দুটোই,
আমরা ডুবে গেলাম বিস্ময়কর ঠাণ্ডায়ঃ
মাস্তুল সম উঁচু বরফ ধেয়ে আসছিলো,
সবুজ, পান্নার মতই সবুজ।
এবং বাতাসের ঘূর্ণিপাকে বরফ কণাগুলি
অন্ধকারে পাঠালো এক আলোর ঝলকানি,
না মানুষ, না পশু, কোনো আকৃতিই দৃষ্টিসীমায় ধরা দিচ্ছিলো না,
দেখা যাচ্ছিলো, শুধুই বরফ।

বরফ ছিলো এখানে, ওখানে, সেখানে,
বরফ ছিলো সবখানেঃ
ঝড়টা ভেঙ্গে চুরমার করছিলো আর চিৎকার করছিলো,
গর্জে উঠছিলো আর উচ্চস্বরে কেঁদে উঠছিলো,
যেন মূর্ছা যাওয়ার তীক্ষ্ণ আওয়াজ।

কিছুদূরেই একটা অ্যালবাট্রস পাশ কাটিয়ে গেলো,
কুয়াশা ভেদ করেই এটা এসেছিলো,
যেন এটা একটা ধর্মীয় আত্মা ছিলো,
আমরা এটাকেই প্রণাম করতে লাগলাম ঈশ্বরের নামে।

পাখিটা খাবার খেলো, যে খাবার সে জীবনে কোনদিন খায়নি,
এটা ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগলো,
বজ্রাঘাতে বরফগুলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছিলো,
এইসবের ভিতর দিয়েই জাহাজচালক আমাদের নিয়ে চললো।

তারপর একটা সুন্দর দখিনা হাওয়া বয়ে চললো আমাদের পেছনে;
পাখিটাও পিছু নিয়েছিলো আমাদের,
প্রতিদিন খাবারের জন্যে অথবা খেলার জন্যে
এটা চলে আসতো নাবিকের কামরায়!

কুয়াশায় অথবা মেঘে, মাস্তুলে অথবা রজগুচ্ছে,
পাখিটা বিশ্রাম নিতো সান্ধ্য উপাসনার জন্যে,
সারা রাত্রি, শুভ্র কুয়াশার ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে
শুভ্র চাঁদটি মিটি মিটি জ্বলতো।

‘ঈশ্বর তোমাকে নিরাপদে রাখুক, হে বৃদ্ধ নাবিক,
অশুভ আত্মা থেকে, মহামারি রোগবালাই থেকে!—
তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’— আমার হাতের ধনুকটা দিয়ে
আমি তীর বিদ্ধ করলাম অ্যালবাট্রসকে।

প্রথম অংশের সমাপ্তি। (চলবে…)

মূলঃ দ্যা রাইম অব দ্যা এইনশানট মেরিনার — স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *