‘মাগো, তোর-ই গর্ভে আমায় কেন করেছিলি ধারন,
আমি পাই না তো খুঁজে হায় এই বেঁচে থাকার কারণ…’
গানের দুটো লাইন। মারুফের মাথায় গুনগুন করে বাজে। অনেক সুখে কিংবা অনেক দুঃখে কিংবা সম্পূর্ণ বোধহীনতায়। মাঝে মাঝে রাতটা যখন কৈশোর থেকে যৌবনে মোড় নেয়ার প্রস্তুতি নেয় তখন কিংবা দিনটা যখন মরার জন্য ঠোঁটে শুকনো হাসি নিয়ে গোধূলির দিকে তাকিয়ে থাকে ঠিক তখন। গানের লাইন দুটো বাংলা সিনেমার। নাম ইতিহাস। গানটায় ভেন্দা কিসিমের আবেগ দিয়ে অভিনয় করেছিল কাজী মারুফ। তার অভিনয় করার ভঙ্গিটাও ভেন্দা। তার নিজের নামও মারুফ। কী জ্বালা! ২০০১ সালে শীতের দুপুরে যখন ন্যাংটা হয়ে পুকুরের পানিতে না ছুঁই-না ভিজি ভাবটা সারা অঙ্গে মেখে নিয়ে হালি খানেক ডুব দিয়ে ইংলিশ হাফপ্যান্টটা হাতে নিয়ে দৌড়ে এসে উঠানের কেন্দ্রে বসে মাকে চিৎকার দিয়ে নারিকেল তেলের শিশি আনার কথা বলে নিজের কুঞ্চিত শিশ্নের দিকে তাকানোর পর প্রথমবারের মত লজ্জাবোধ শীতল জলের দাঁতের মত এসে মারুফের অস্তিত্বে কামড় বসালো, ঠিক তখন পাশের ঘরের আলী আকবর জ্যাঠার রেডিওতে বেজে উঠেছিল এই গান। খাড়া হয়ে গিয়েছিল মারুফের কান। কেমন মোলায়েম লাগছিল গানের কথাগুলো। দুঃখ এত মোলায়েম, অর্থহীনতা এত শ্রুতিমধুর কেন তা তেলের শিশি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের দিকে তাকিয়ে মারুফ বুঝতে পারে না। লজ্জাবোধটা চাপা পড়ে যায় কিংবা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মারুফের কর্ণ আর হৃদপিণ্ডের সংযোগ স্থাপনে এই লিরিকের তাড়াহুড়ায়।
মারুফের জ্যাঠা আলী আকবর সিনেমাকে বলত বই। মারুফরা বলত ছবি। অনেকদিন রেডিওতে গানটা শোনার পর, একদিন মারুফ বাজারে শিঙ্গাড়ার দোকানের ভিসিডিতে ছবিটা দেখে নেয়। পুরো ছবিটাই মোলায়েম দুঃখে ভরা। ছবি কিংবা আলী আকবর জ্যাঠার ভাষায় বইটা দেখতে গিয়ে যখন গানের দৃশ্যটা আসে, মারুফের মনসংযোগে তখন পুরো ব্রহ্মাণ্ড একীভূত হয়ে পড়ে শিঙ্গাড়ার দোকানের ভিসিডিতে। এতদিন অডিও শুনে শুনে মারুফের কল্পিত বিলাসী দুঃখগুলো যেন এখন বাস্তব হয়ে ঝরে পড়তে থাকে অভিনেতা মারুফের গলা বেয়ে। মারুফ মারুফকে দেখে। দুঃখকে দেখে। গানের আরও দুটি লাইন মারুফের হৃদপিণ্ডকে অধিকতর তরল করে তোলেঃ
‘আমার দুঃখ কলিজাতে, হাড়-মাংস-রক্ত কণায়,
আমার মত জনম দুঃখী ভবে বুঝি একটা গো নাই।’
আহা। এমন বিশুদ্ধ দুঃখ। জীবনে এমন দুঃখী মারুফ হতে পারবে কিনা জানে না, তবে বোধে বিঁধে থাকে একটা দুঃখবোধের তীব্র স্বাদ।
২০২০ সাল। আজকে অসময়ে। রাত নয়, দিনের কৈশোরকালে কিংবা বেলা বেলা ভাবের শুরুতে মারুফ অনুভব করছিলো দার্শনিক নিৎশের দুঃখবোধ। বিশুদ্ধ অর্থহীনতা। দ্যা টিউরিন হর্স সিনেমার কিংবা আলী আকবর জ্যাঠার ভাষায় বইয়ের লিমিটলেস পরাবাস্তব বাতাসের ভাষাহীন গানের লিরিক, বড় বড় গোলআলুর লবণ মিশ্রিত স্বাদ এসে লেপটে যায় মারুফের অস্তিত্বে। আজকে অসময়ে। গুনগুন করে বেজে উঠে মারুফের মস্তিষ্কে – ‘মাগো, তোর-ই গর্ভে আমায় কেন করেছিলি ধারন…।’ এই লিরিকে বেজে উঠে নিৎশের কণ্ঠ। ভেসে উঠে তার অবয়বও। ঠিক মারুফের মতই ভেন্দা।
গল্প ।। দুঃখাক্ষেপ
শরিফুল ইসলাম
১৩-০৫-২০২০