অনেকগুলো চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে মনুষ্য জীবনের প্রধান চাওয়া-পাওয়া হল—শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সুখ। এগুলো সবাই চায়। একেকজন একেক ফর্মে। আপনিও চান। এই চাওয়ায় দোষ নাই। কিন্তু প্যারাডক্সিক্যালি এগুলো পেতে গিয়ে আপনি যদি মাত্রাতিরিক্ত চেষ্টায় রত হয়ে যান তাহলে পরিণতিতে আপনি হবেন—নিঃসঙ্গ, বিষণ্ণ এবং দুর্দশাগ্রস্ত।
নৌবাহিনীর ‘নেভি সিল’ ট্রেনিং-এ ‘ড্রাউন প্রুফিং’ নামে একটি অংশ আছে, যেখানে আপনার হাত দুটি পিঠমোরা করে এবং পা দুটি একসাথে বেঁধে আপনাকে ৯-১০ ফুট গভীর একটি পুলে নিক্ষেপ করা হবে।
আপনার কাজ হল এই অবস্থায় ৫ মিনিট ওই পুলের পানিতে বেঁচে থাকা।
বেশীরভাগ সিল ট্রেনিং এর মত, অনেক ক্যাডেটই ‘ড্রাউন প্রুফিং’-এ ফেল করে। পানিতে ফেলে দেয়ার সাথে সাথে বেশীরভাগই প্যানিক করে এবং উপরে তোলার জন্য চিৎকার শুরু করে দেয়। কেউ কেউ পানিতে ডুবে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা পর্যন্ত টিকে থাকে, যাদেরকে পরে মাছের মত তুলে এনে জ্ঞান ফিরানো হয়। বিগত বছরগুলোতে এই প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে বেশ কয়েকজন মারাও গেছে।
কিন্তু মারা যাওয়া এবং ব্যর্থ প্রশিক্ষার্থীর সংখ্যাটা বড় হলেও কেউ কেউ ঠিকি সফলভাবে ৫ মিনিট পানিতে টিকে থাকতে পারে। কীভাবে পারে? এরা পারে, কারণ এরা দুটো পরস্পর সজ্ঞা-বিরোধী শিক্ষা বুঝতে সক্ষম হয়।
প্রথমত, তারা বুঝতে পারে যে ‘ড্রাউন প্রুফিং’ ব্যাপারটা হল প্যারাডক্সিক্যাল (আপাতবিরোধী): অর্থাৎ যতই আপনি পানিতে ভেসে থাকার চেষ্টা করবেন, ততই আপনি ডুবে যেতে থাকবেন।
হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পানির উপর পুরো পাঁচ মিনিট ভেসে থাকাটা আসলে প্রায় অসম্ভব। তার উপরে আপনি যদি হাত-পা নাড়িয়ে (বাঁধা অবস্থায়) পানির উপর আপনার শরীরটাকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করেন, এটা হয়ে উঠবে আপনার দ্রুত পানিতে ডুবে যাওয়ার প্রধান কারণ।
ড্রাউন প্রুফিং-এ টিকে থাকার কৌশলটি হল, যখনই আপনাকে পানিতে ছুড়ে ফেলা হবে, তখন আপনি নড়াচড়া না করে নিজেকে ডুবে যেতে দেবেন। ডুবতে ডুবতে পুলের তলা পর্যন্ত যাবেন। তারপর তলায় হাত দিয়ে নিজেকে উপরের দিকে হালকা পুশ করে স্থির থাকলে ভরবেগে আপনার শরীর উপরে ভেসে উঠতে থাকবে। উপরে ভেসেই আপনি পর্যাপ্ত পরিমাণ নিঃশ্বাস টেনে নিবেন। এভাবে পুরো প্রসেসটা আবার শুরু করবেন।
অদ্ভুদ ব্যাপার হল ড্রাউন প্রুফিং এক্সারসাইজে সারভাইব করতে আপনার অতিমানবিক শক্তি কিংবা সহ্য ক্ষমতা কোনটারই প্রয়োজন নাই। এমনকি এটার জন্য আপনাকে সাতার কাটতেও জানতে হবে না। উল্টো, সাতার কীভাবে না কাটতে হয় সেটা আপনাকে জানতে হবে। যে ফিজিক্স আপনাকে মেরে ফেলতে পারে সেটাকে বাঁধা দেয়ার পরিবর্তে সেটার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে এবং সেটাকে নিজের জীবন বাঁচানোর জন্যে ব্যবহার করতে হবে।
ড্রাউন প্রুফিং এর দ্বিতীয় শিক্ষাটি আরেকটু সুস্পষ্ট, কিন্তু এটাও প্যারাডক্সিক্যাল (আপাতবিরোধী): যত বেশি আপনি প্যানিক করবেন, তত বেশি আপনি অক্সিজেন বার্ন করবেন এবং তত বেশি বাড়বে আপনার অজ্ঞান হয়ে ডুবে যাওয়ার প্রবণতা। একটু ভয়ানক ভাবে হলেও, এই এক্সারসাইজটা আপনার নরমাল সারভাইবাল ইন্সটিংক্টকে আপনার বিরুদ্ধেই দাঁড় করাবেঃ যত বেশি নিঃশ্বাস নেয়ার টান লাগবে, ঠিক তত কম নিঃশ্বাসই আপনি নিতে পারবেন। বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা যত তীব্র হবে, আপনার মারা যাওয়ার চান্সও তত বেড়ে যাবে।
এটা যতটা না শারীরিক ইচ্ছাশক্তির পরীক্ষা, প্রতিটা ক্যাডেটের জন্য চরম বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে এটা নিজের ইমোশনাল কন্ট্রোল-এর জন্য তার চেয়ে বড় পরীক্ষা। সে কি নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? সে কি সম্ভাব্য মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে শান্ত থাকতে পারে? উচ্চতর কোন মূল্যবোধ কিংবা লক্ষ্যের জন্য কি সে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে পারে?
সাতার কাটার চেয়েও এই দক্ষতাগুলো একজন ক্যাডেটের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো তার দৃঢ়তা, শারীরিক সক্ষমতা অথবা উচ্চাকাঙ্ক্ষার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি সে কতটা চতুর, ঝকঝকে ইটালিয়ান স্যুটে সে দেখতে কতটা সুন্দর তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ এইসব দক্ষতা।
শুধু সিল ট্রেনিং-এর জন্যই নয়—যখন নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার ইচ্ছাটা সবচাইতে বেশি তীব্র, তখনই নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ার দক্ষতা পৃথিবীর যেকোন মানুষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। বেশিরভাগ মানুষ মনে করে, প্রচেষ্টা এবং ফলাফলের মধ্যকার সম্পর্কটা বোধহয় মুখোমুখি। আমরা মনে করি যে, কোন কিছু নিয়ে দ্বিগুণ সময় কাজ করলে সেটার দ্বিগুণ রেজাল্ট পাওয়া যায়। অথবা কোন সম্পর্কে দ্বিগুণ কেয়ার নিলে অপরপক্ষ বোধহয় দ্বিগুণ ভালোবাসা অনুভব করে। অথবা কোন একটা পয়েন্ট নিয়ে দুইবার চিৎকার করে বললে বোধহয় এটার সত্যতা দ্বিগুণ হয়ে প্রকাশ হয়।
আমাদের এই ধারণার কারণ আমার মনে করি জীবন একটা সোজা লাইনে চলে যেখানে প্রচেষ্টা এবং পুরস্কারের অনুপাত সমানঃ
কিন্তু রিয়েলিটিতে আসলে সেটা ঘটে না। ধরুন, কেউ যদি তার একটা লেখার এডিটিং তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য নরমালের চেয়ে দ্বিগুণ ‘রেড বুল’ ড্রিংক পান করে, তাতে তার এডিটিং তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে না। পৃথিবীর বেশিরভাগটাই সোজা লাইনে চলে না। সোজা লাইনের ব্যাপারটা শুধু দেখা যায় বুদ্ধিবৃত্তিশূন্য্, যন্ত্রবৎ এবং রিপিটেটিভ কাজগুলোতে, যেমন— গাড়ি চালানো, কাগজ গোছানো, বাথরুম পরিষ্কার করা ইত্যাদি। এইসব ক্ষেত্রে এক ঘণ্টার জায়গায় দুই ঘণ্টা কাজ করলে সেটার ফলাফল দ্বিগুণ হবে। এর কারণ এইসব কাজে কোন চিন্তা অথবা চাতুর্যের প্রয়োজন হয় না।
জীবনের বেশিরভাগ কর্মকাণ্ড সোজা প্রচেষ্টা / পুরস্কারের লাইনে কাজ করে না, কারণ জীবনের বেশিরভাগ কাজই মৌলিক নয় কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিশূন্যও নয়। বেশিরভাগ কর্মকাণ্ডই জটিল, মানসিক খাটুনি নির্ভর এবং সব কাজেই লাগে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর যোগ্যতা।
অতএব, বেশিরভাগ কর্মকাণ্ড একটি হ্রস্বীকৃত (কমে যাওয়া) ফলাফলের লাইন তৈরি করেঃ
হ্রস্বীকৃত ফলাফল বলতে বোঝায়, কোনকিছুকে আমরা যত বেশি এক্সপেরিয়েন্স করি, সেটার স্বাদ কিংবা তীব্রতা তত কমে যায়। এটার ক্লাসিক উদাহরণ হল টাকা। যেমন, ২০,০০০ ডলার আয় করা আর ৪০,০০০ ডলার আয় করার মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। এই পার্থক্য একজন মানুষের জীবন পর্যন্ত পরিবর্তন করে দিতে পারে। কিন্তু ১২০,০০০ ডলার আয় করা আর ১৪০,০০০ ডলার আয় করার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নাই, যা আছে তা হল আপনার গাড়ির সিট হিটারটা হয়তো একটু হালকা সুন্দর হবে। এবং ১২৭,০২০,০০০ ডলার আয় করা আর ১২৭,০৪০,০০০ ডলার আয় করার মধ্যে পার্থক্য কী জানেন? জাস্ট বছর শেষে আপনার ট্যাক্স রিটার্নের উপর একটা রাউণ্ডিং ইরর আসবে।
হ্রস্বীকৃত ফলাফলের ধারনাটা বেশিরভাগ জটিল এবং উচ্চমার্গীয় অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দিনে আপনি যতবার শাওয়ার নেন; খুশীর সময় যতগুলো চিকেন উইং গোগ্রাসে গিলেন; মাকে দেখার জন্য বছরে যতবার বাড়ি যান— এই সবগুলোই শুরুর দিকে খুবই মূল্যবান বলে বোধ হয় কিন্তু এর সংখ্যা যত বৃদ্ধি পায় ততই কমতে থাকে এর বোধকৃত মূল্য।
আরেকটা উদাহরণঃ কাজের উৎপাদনশীলতার উপর একটা স্টাডিতে দেখা যায় যে আমরা দিনের শুরুর চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা শুধু সত্যিকার অর্থে প্রোডাক্টিভ থাকি। এর পরে যাই করি সেটার ফলাফল হয় হ্রস্বীকৃত, যেখানে ১২ ঘণ্টা কাজ করা আর ১৬ ঘণ্টা কাজ করার মধ্যে কোন পার্থক্যই নাই (কেবল নিদ্রাহীনতা ছাড়া)।
মানুষের বন্ধুত্বের সম্পর্কও হ্রস্বীকৃত ফলাফলের ভিত্তিতে কাজ করে। একজন বন্ধু থাকা গুরুত্বপূর্ণ। দুইজন বন্ধু থাকা নিশ্চিতভাবে একজন থাকার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কারও ৯ জন বন্ধুর পরিবর্তে ১০ জন বন্ধু থাকার মধ্যকার ব্যবধান তার জীবনে খুব একটা পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে না। এবং ২০ জন বন্ধুর পরিবর্তে ২১ জন বন্ধু থাকার মানে হল এদের নাম মনে রাখাটা আপনার জন্য একটু কঠিন হয়ে পড়ল।
সেক্সও হ্রস্বীকৃত ফলাফলের ভিত্তিতে কাজ করে, খাওয়া, ঘুম, মদ্যপান, জিমের ব্যায়াম, বই পড়া, ছুটিতে যাওয়া, কফি খাওয়া, রিটায়ারমেন্টের জন্য টাকা জমানো, বিজনেস মিটিং করা, পরীক্ষার জন্য পড়া, হস্তমৈথুন করা, রাত জেগে ভিডিও গেম খেলা— উদাহরণ সীমাহীন। এই সবকিছুই যত বেশি করবেন কিংবা চেষ্টা করবেন, রিটার্ন (অর্থাৎ অভিজ্ঞতার স্বাদ কিংবা তীব্রতা) তত কম পাবেন। সবকিছুই এখানে হ্রস্বীকৃত ফলাফলের লাইনে কাজ করে।
কিন্তু আরেকটা লাইন আছে, যেটা আপনি সম্ভবত কখনও দেখেন নাই অথবা শোনেনও নাই— কারণ হয়তো এই ধরনের জিনিস আমার নিজেরই বানানো। এটা হল উল্টো লাইন বা ইনভার্টেড কার্ভঃ
উল্টো লাইনটাকে বলা যায় উদ্ভট ‘টোয়াইলাইট জোন’ যেখানে প্রচেষ্টা এবং পুরস্কারের মধ্যে একটা নেতিবাচক সম্পর্ক বিদ্যমান— সেটা হল, কোন কিছু করতে আপনার প্রচেষ্টা যত বেশি হবে, সেটাতে আপনি তত ব্যর্থ হবেন। ড্রাউন প্রুফিং এই উল্টো লাইনেই কাজ করে। পানির উপরে উঠার যত চেষ্টাই আপনি করবেন, ততই আপনি ডুবে যেতে থাকবেন। একইভাবে, যত আপনি নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করবেন, ততই পুলের ক্লোরিন দেওয়া মুতের পানি গলায় আটকে আপনার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে।
আমি জানি আপনি এখন কী ভাবছেন। ভাবছেন এইসব সোজা লাইন, উল্টো লাইন নিয়ে কে এত চিন্তা করে। সময় আছে এত! আর সবকিছু কি এভাবে কাজ করে নাকি!
হ্যাঁ সত্যি! জীবনে হয়তো খুব অল্প জিনিসই উল্টো লাইনে কাজ করে। কিন্তু যে অল্প কিছু জিনিস কাজ করে সেগুলো মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত, আমি বলব যে জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা এবং লক্ষ্যগুলো উল্টো লাইনেই কাজ করে।
যখন কোন কাজ বুদ্ধিবৃত্তিশূন্য এবং সহজ হয়, তখন সেটা সোজা লাইনে কাজ করে। আর যখনই কোন কাজ জটিল এবং বহুচলকীয় হয় সেখানে প্রচেষ্টা আর পুরস্কারের মধ্যকার সম্পর্কটা হয় হ্রস্বীকৃত ফলাফল (যেখানে ফলাফল কমে যায়)।
কিন্তু যখন কোন কাজ হয় পুরোপুরি মানসিক — যে অভিজ্ঞতা কেবলই আমাদের চিত্তে অবস্থান করে — সেক্ষেত্রে প্রচেষ্টা এবং পুরস্কারের মধ্যে সম্পর্কটা হয় উল্টো লাইনের।
যেমন, সুখের অন্বেষণ আপনাকে সুখ থেকে আরও দূরে সরিয়ে দেয়। আবেগ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা আবেগকে আরও লাগামহীন করে তোলে। বৃহত্তর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রায়ই আমাদের বন্ধী করে তোলে। কারও ভালোবাসা এবং গৃহীত পাত্র হওয়ার চাহিদা আমাদেরকে দূরে রাখে ভালোবাসা থেকে এবং নিজের কাছে নিজে গৃহীত হওয়া থেকে।
অলডাস হাক্সলি একবার লিখেছিলেন, “ইচ্ছা নিয়ে কোন কিছু করার চেষ্টা আমরা যত কঠিনভাবে করি, ততই আমরা সেটা করতে ব্যর্থ হই। দক্ষতা এবং সুফল শুধু তারাই পায় যারা কোন কিছু করা এবং না করা অথবা কাজ এবং অবসরের একত্রীকরণের শিল্পটা আয়ত্ত করতে পারে।”
এটাই ‘ব্যাকওয়ার্ডস ল’: পজিটিভ অভিজ্ঞতার আকাঙ্ক্ষা নিজেই একটা নেগেটিভ অভিজ্ঞতা; নেগেটিভ অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করাটাই পজিটিভ অভিজ্ঞতা।
সব না হলেও — এটা আমাদের জীবনের বেশিরভাগ মানসিক এবং শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সত্যঃ
১) নিয়ন্ত্রন — আমাদের অনুভূতি এবং প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য আমরা যত চেষ্টা চালাই, ততই আমরা অনুভব করি অসহায়ত্ব। আমাদের আবেগগুলো অদম্য এবং অনিয়ন্ত্রণযোগ্য; এবং এটাকে নিয়ন্ত্রন করতে গেলে হিতে বিপরীত হয়। উল্টোদিকে, যতই আমরা আমাদের অনুভূতি এবং প্রবৃত্তিকে গ্রহণ করে নেই, ততই সেগুলোকে ডিরেক্ট করা এবং প্রসেস করা সহজ হয়ে উঠে।
২) স্বাধীনতা — বেশি বেশি স্বাধীন হওয়ার নিরবিচ্ছিন্ন চাহিদা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে বন্ধী করে তোলে। বরং জীবনে কিছু নির্দিষ্ট জিনিসের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থেকেই কেবল সত্যিকারের স্বাধীনতার চর্চা করা যায়।
৩) সুখ — সুখে থাকার চেষ্টায় আরও অসুখ বাড়ে। অসুখকে গ্রহণ করলেই সুখ এসে আলতো করে কাঁধে বসে।
৪) নিরাপত্তা — নিজেকে যতটা সম্ভব নিরাপদ অনুভব করানোর চেষ্টাটা আমাদেরকে আরও অনিরাপদ করে তোলে। অনিশ্চয়তার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারলেই অনুভূত হয় নিরাপত্তা।
৫) ভালোবাসা — যতই অন্যকে আমরা ভালোবাসাতে এবং গ্রহণ করাতে চাই, ততই আমরা ভালোবাসা হারাই।
৬) শ্রদ্ধা — যতই আমরা অন্যের কাছে শ্রদ্ধা দাবি করি, ততই তারা আমাদেরকে কম শ্রদ্ধা করে। অপরদিকে, যতই আমরা অন্যকে শ্রদ্ধা করা শুরু করি, ততই আমরা শ্রদ্ধা পেতে শুরু করি।
৭) আস্থা — অন্যকে দিয়ে যতই আপনি নিজের উপর আস্থা তৈরি করার চেষ্টায় মত্ত হবেন, ততই সে আস্থা হারাবে। আর আপনি অন্যের উপর যত আস্থা স্থাপন করবেন, ততই অন্যরা আপনার উপর আস্থা পাওয়া শুরু করবে।
৮) আত্মবিশ্বাস — আত্মবিশ্বাস অনুভব করার যত চেষ্টা আমরা করি, ততই আমাদের অনুভূত হয় উদ্বিগ্নতা এবং অনিরাপত্তা। নিজের ভুলগুলোকে যত সহজে আমরা গ্রহণ করে নেব, ততই আমরা নিজের সাথে নিজে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরিতে সক্ষম হবো।
৯) পরিবর্তন — যতই অধীর হয়ে আমরা নিজেকে পাল্টানোর জন্য উঠেপরে লাগব, ততই অপূর্ণতা এসে চেপে বসবে মনে। যেখানে বেড়ে উঠা এবং বিবর্তিত হওয়ার একমাত্র পন্থাই হল নিজেকে গ্রহণ করা।
১০) উদ্দেশ্য — যতই আমরা জীবনের গভীর অর্থ কিংবা উদ্দেশ্য খুঁজে বেড়াই, ততই আমরা আত্মকেন্দ্রি এবং অগভীর হয়ে উঠি।
এইসব মানসিক এক্সপেরিয়েন্স উল্টো লাইনে কাজ করে, কারণ এগুলো একই জিনিসের কারণ এবং প্রভাব (কজ এন্ড ইফেক্ট) দুটোই। সেই জিনিসটা হল আমাদের মন। যখন আপনি সুখের আকাঙ্ক্ষা করেন, তখন আপনার মন একইসঙ্গে নিজেই সেই আকাঙ্ক্ষা এবং নিজেই আকাঙ্ক্ষার টার্গেট।
যখন এসব উচ্চমার্গীয়, বিমূর্ত, অস্তিত্বগত লক্ষ্যের বিষয়গুলো আসে, তখন আমাদের মন একটা কুকুরের মত আচরণ শুরু করে, যে কুকুর জীবনভর কিছু ছোট ছোট শিকার তাড়িয়ে সফলতার সাথে ধরতে পেরে সেই একই নিয়মে নিজের লেজকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কুকুরের কাছে এটা যুক্তিযুক্ত মনে হয়। কারণ শত হলেও এই তাড়িয়ে বেড়ানোর কারণে তার কুত্তা জীবনে তো সে অনেক কিছুই ধরতে পেরেছে। তাহলে কেন তার লেজ নয়?
কিন্তু একটা কুকুর কখনই তার লেজটাকে ধরতে পারে না। যতই সে লেজ তাড়িয়ে বেড়ায়, ততই সেটা নাগালের বাইরে থাকে। কুকুর বুঝতে পারে না যে সে আর তার লেজ দুটোই এক জিনিস।
কুকুরের এই লেজ তাড়ানো আমাদের শিক্ষা দেয় যে জীবনের উদ্দেশ্য, স্বাধীনতা এবং সুখকে তাড়িয়ে বেড়ালে এগুলো আরও দূরে সরে যায়। কোন কিছু পেতে হলে আগে সেটা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে দিতে হয়। পানিতে ভেসে উঠতে হলে, আগে নিজেকে ডুবতে দিতে হয়।
ভাবছেন, এটা কী করে সম্ভব?
ছেড়ে দিন। একেবারে ছেড়ে দিন। নিজেকে সমর্পণ করুন। দুর্বলতা থেকে নয়। শ্রদ্ধা থেকে। কারণ পৃথিবীটা আমাদের উপলব্ধির বাইরে। দেখুন আমরা কতটা ভঙ্গুর এবং সীমিত। মহাকালের বুকে আমরা এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা মাত্র। এটা করবেন আপনি নিয়ন্ত্রন ছেড়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে, এই কারণে না যে আপনি অসহায় বোধ করছেন, বরং এই কারণে যে আপনি অনেক সাহসী। যা কিছু নিজের নিয়ন্ত্রনে নাই তা ছেড়ে দেওয়াই সাহসিকতা। সবাই হয়তো সবসময় আপনাকে ভালোবাসবে না, হয়তো আপনি প্রায়ই ব্যর্থ হবেন অনেক কিছুতে, অনেক সময় আপনার কোন ধারনাই থাকবে না আপনি কী করছেন, কেন করছেন।
আপনি শুধু হেলে পড়ুন ভয় এবং অনিশ্চয়তার বুকে। এবং যখনই আপনার মনে হবে আপনি ডুবে যাচ্ছেন, ডুবে যান। তলায় পৌঁছানো মাত্রই আপনার ভরবেগ আপনাকে তুলে নিয়ে আসবে—আপনার মোক্ষে।