১৯৬৮ সাল।
একটা জমাট বাঁধা উত্তেজনা আনন্দে রূপ নিয়ে ছাগল শাবকের মত লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সাত বছর বয়সী অর্কের মনে। কারণ এই মাত্রই অর্ক বেশ কিছুদিন ধরে চেষ্টা করে যাওয়া একটা যন্ত্র বানানোর কাজ সফলভাবে শেষ করতে সক্ষম হয়েছে। যন্ত্রটা দিয়ে এখন সে দূর থেকেই তার কুকুরের ঘরের দরজাটা খুলতে এবং বন্ধ করতে পারবে। ব্যাপারটা আনন্দেরই।
অর্ক কৌতূহলী। শারীরিক খেলাধুলার প্রতি তার তেমন কোন আগ্রহ না থাকলেও যন্ত্রিক খেলনা তৈরির প্রতি আগ্রহ আছে বেশ। সারাদিনই এটা সেটা দিয়ে খেলনা বানানোর চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায় তার। পুরনো টিভির পার্টস, ক্যাসেট প্লেয়ারের পার্টস, এন্টেনা, সাইকেলের গিয়ার — হাতের কাছে যা পায় তা দিয়েই সে কিছু না কিছু একটা বানায়। বানিয়েই ছাড়ে। উত্তেজনা রূপ নেয় আনন্দে।
১৯৭৬ সাল।
অর্কের বয়স এখন ১৫। পারসোনাল কম্পিউটার নামক এক যন্ত্র এসেছে বাজারে। যাদুর মত কাজ করে। জিনিসটার প্রতি অর্কের আগ্রহ তুঙ্গে। মাকে বলে কিনে আনলো একটা। সারা দিন-রাত এটাতে ডুবে রইলো সে। কিছুদিন পরেই বানানো শুরু করল নতুন নতুন সফটওয়্যার। বুঝতে শুরু করল মানুষ আর প্রযুক্তির মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া। এটা ঘটলো তার কৌতূহল, আগ্রহ, আর মেধার জোরে। এরই মধ্যে একটা সফটওয়্যার কোম্পানি চালু করে দিল। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল অর্কের নাম। টিভিতে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাক পেল ডজন খানেক বার। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতিও আগ্রহ প্রকাশ করেছে তার সাথে দেখা করার। অল্প বয়সে এতগুলো অর্জন থলেতে নিয়ে এমআইটি থেকে অর্ক শেষ করলো তার গ্র্যাজুয়েশন।
১৯৮২ সাল।
২১ বছরে পা রাখল অর্ক। হঠাৎ একদিন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল তার মা। বাবাকে সে কখনই দেখেনি। মাকেই সে ভালোবেসেছে অস্তিত্বের গভীর থেকে। ধরণীর বুকে মাকে ছাড়া আর কারও উপরেই অর্ক ভরসা করতে পারত না। মায়ের এমন আকস্মিক মৃত্যুতে সে গভীরভাবে আহত হল। মেনে নিতে পারছে না। মৃত্যু ব্যাপারটাই তাকে বিচলিত করে তুললো। শুধু মায়ের মৃত্যুই না, অর্কের কাছে কোন মানুষের মৃত্যুই বোধগম্য ঠেকছে না। মানুষের মত এমন বুদ্ধিমত্তার অধিকারী প্রজাতিকে কেন মারা যেতে হবে! যে মানুষ আগুন আবিষ্কার করতে পারে, কম্পিউটার, বিমান এবং মেডিসিনের মত জিনিস আবিষ্কার করতে পারে, সে কেন মরে যাবে? মরে তো একটা টিকটিকিও যায় একই ভাবে। এটা মেনে নেয়া যায় না। তার মনে একটা বিশ্বাস জন্মাল। মানুষকে মরতেই হবে ব্যাপারটা এমন না। অদূর ভবিষ্যতেই আমরা আমাদের এই দুর্বল মনুষ্য শরীরের উপরের নির্ভরতাকে জয় করতে পারব। এবং এটা হবে প্রযুক্তির মাধ্যমে। অর্ক তার এই বিশ্বাসের উপর ভর করে কাজ করতে শুরু করলো। শুরু করলো গভীর পড়াশোনা। সৃষ্টি করতে লাগল একের পর এক নতুন থিউরি। প্রবেশ করতে লাগল নতুন নতুন সফটওয়্যার এবং বায়োটেকনোলজির গভীরে, আরও গভীরে।
১৯৯৭ সাল।
৩৬ বছর বয়সে অর্ক চালু করল একটা বায়োটেক কোম্পানি। নাম দিল ‘কার্ভ’। এখানে তৈরি করা হয় মানুষের বায়োলজি এবং জেনেটিক্সের সাথে রিলেটেড এলগোরিদম এবং কম্পিউটার মডেল। কিছুদিনের মধ্যেই অর্ক আবিষ্কার করল মানুষের মস্তিষ্ক আর আর তার তৈরিকৃত সফটওয়্যারের মধ্যে সাদৃশ্য আছে অনেক। মানুষের মস্তিষ্ক বিভিন্ন প্যাটার্ন খুঁজে বের করে, সেই প্যাটার্নগুলোকে ক্রম অনুযায়ী সাজায় এবং সেগুলোর সাহায্যে নিজের অবস্থান সম্পর্কে একটা চেতনা গঠন করে। এই চেতনা দিয়েই সে মূল্যায়ন করে তার পারিপার্শ্বিকতাকে। ঠিক অর্কের সৃষ্টি করা নতুন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতই। এই সাদৃশ্যে অর্কের উপলব্ধি আসলো যে মানুষের চেতনের কোডিং-কে যদি পুরোপুরি রেপ্লিকেট করা যায়, তাহলে এটাকে যে কোন ডিভাইসে সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভব হবে। এতে থিউরেটিক্যালি মানুষ অমরত্ব লাভ করতে পারবে। অন্যকথায়, মানুষের আমিত্বের অনুভূতিকে মনুষ্য শরীর ছাড়াও ধরে রাখা সম্ভব হবে।
২০২৯ সাল।
অর্কের বয়স এখন ৬৮। তার বায়োটেক কোম্পানি কার্ভ সফলভাবে মানুষের মস্তিষ্কের সবগুলো ফাংশনকে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ার করতে সক্ষম হয়েছে। বায়োটেকনোলজি স্পেসের অন্যান্য আবিষ্কারের সাথে মস্তিষ্কের এই রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং মিলে এক অভূতপূর্ণ ঘটনার জন্ম দিল। মানুষের চেতনাকে এখন যে কোন ডিভাইসে সংরক্ষণ করা যাবে। শুধু তাই নয়, চেতনাকে বর্ধিত করে সেটা আপলোড করা যাবে ক্লাউড সার্ভিস এনটিটিতে। মানুষ এখন অতীতের যে কোন সময়ের যে কোন কল্পিত পন্থার চেয়ে দ্রুত গতিতে চিন্তা করতে পারবে। জেনেটিক্স কোড ভেঙ্গে ফেলে পরিবর্তন করা যাবে মানুষের মেনটাল কন্ডিশন। দূর করা যাবে যে কোন ধরণের মানসিক সমস্যা। থামিয়ে দেয়া যাবে ব্যাকটেরিয়া এবং বার্ধক্য জনিত সব রোগ।
২০৩৭ সাল।
৭৬ বছর বয়সী অর্কই হল পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি যে কিনা তার মস্তিষ্কের সবগুলো ফাংশনকে একটা আউটসাইড হাইব্রিড এনটিটিতে আপলোড করতে সক্ষম হয়েছে। অর্ক এখন যখন তখন যে কোন ধরণের কৃত্রিম শরীরে রূপ নিতে পারে এবং সেখান থেকে একটা সফটওয়্যার এক্সেস সার্ভারের মাধ্যমে তার মূল চেতনার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। অর্ক গোটা মানবতাকে নিয়ে গেছে অস্তিত্বের এক নতুন রাজ্যে। এক সীমাহীন চেতনার রাজ্যে।
২৪৮৬ সাল।
অর্ক এবং তার পৃথিবীতে বাস করা সকলে পার করে দিয়েছে শত বছরের যাপিত জীবন। টপকে গেছে মানুষের অতীতের গড় আয়ুকে। এরই মধ্যে অর্ক ঘুরে এসেছে সারা পৃথিবীর সকল আনাচ-কানাচ। দেখে নিয়েছে যা কিছু দেখার আছে সব। পড়ে ফেলেছে মানব রচিত প্রত্যেকটি বই। দেখেছে প্রতিটা মুভি, প্রতিটা ভিডিও। ভিজিট করেছে প্রতিটা ওয়েভসাইট, শিখে ফেলেছে পৃথিবীর প্রতিটা ভাষা। আয়ত্ত করেছে প্রতিটা দক্ষতা। প্রেমে পড়েছে বার বার, অসংখ্যবার। একশ বছর থেকে দু’শ বছরে, দু’শ থেকে পাঁচ’শ, পাঁচ’শ থেকে হাজার, হাজার থেকে লক্ষ, লক্ষ থেকে কোটি। এভাবে কত বছর পার হল সেটা নিয়ে ভাবাও বন্ধ করে দিল অর্ক। আবিষ্কৃত হচ্ছে নতুন নতুন পৃথিবী, নতুন নতুন গ্রহ, নতুন নতুন গ্যালাক্সি। সব শেষ করে অর্ক ঢুকে পড়ল অন্য ডাইমেনশনে। সাক্ষাৎ পেল বিভিন্ন সত্তার। এরই মধ্যে নতুন নতুন বিজ্ঞানের ধারা, বিনোদনের ধারা, শিল্পের ধারা আসে আর যায়, আসে আর যায়, আসে আর যায়। অর্ক অনুভূতিরও নতুন নতুন ধারা আবিষ্কার করতে লাগল, আবিষ্কার করতে লাগল সব ধরণের চিন্তাকে। এভাবে কেটে গেল আরও কয়েক মিলিয়ন বছর। অর্ক ভুলে গেল তার নিজের বাড়িটার কথা, তার মায়ের কথা, বোনের কথা, কুকুরটার কথা, শৈশবের কথা, বুড়ো হওয়ার কথা, এবং পুরনো পৃথিবীটার কথা। এই সব কিছুই যেন একটা হার্ড ড্রাইভে রেখে দেওয়া মেমরি যেগুলোকে এখন বড় অপ্রাসঙ্গিক ঠেকে।
অর্ক চলতে লাগল। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, শতাব্দী যায়, যায় মিলেনিয়ার পর মিলেনিয়া। এভাবে চলতে চলতে একটা সময়ে এসে সবগুলো তারা মরতে শুরু করল, গ্যালাক্সিগুলো হারিয়ে যেতে শুরু করল এবং পুরো ব্রহ্মাণ্ড নিঃশেষ হওয়া শুরু করল। অর্ক তো সব পেয়েছে যা তার আগে মনুষ্য ইতিহাসে কেউ পায়নি, সব দেখেছে যা মনুষ্য ইতিহাসে অন্য কেউ দেখেনি। এত কিছু দেখে, বুঝে, জেনে কি লাভ হল যদি মহাবিশ্বই এখন মরে যায়! কি লাভ হল এই অমরত্ব লাভ করে! অর্ক আরও ভাবল, যে মানুষ প্রকৃতির সব রীতিনীতি পরিবর্তন করে ফেলতে পেরেছে তাকে এখন মহাবিশ্বের সাথে মরে যেতে হবে! মহাবিশ্বের এই ক্রান্তিকালে অর্ক শেষবারের মত একটা জিনিস সৃষ্টি করার করার সিদ্ধান্ত নিল।
যেহেতু অর্ক প্রকৃতির প্রতিটা রুলের কথা জানে, রিয়েলিটি এবং মহাবিশ্ব কীভাবে কাজ করে সেটা জানে, সেই জ্ঞান দিয়ে সে আরেকটা মহাবিশ্বের ব্লু প্রিন্ট আঁকা শুরু করল। ঠিক নতুন ভিডিও গেমের রুলস তৈরি করার মত সে নতুন মহাবিশ্বের কোডগুলো রেনডার করা শুরু করল। নতুন এই মহাবিশ্বের সবকিছুই হবে কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়, দীর্ঘস্থায়ী কিন্তু চিরস্থায়ী নয়। এই মহাবিশ্বের সবকিছু হবে আগেরটার চেয়ে কঠিন কিন্তু আরও ইন্টারেস্টিং, আরও কষ্টসাধ্য কিন্তু আরও বেশি পুরস্কারে ভরা। শুরুতে কেউই বুঝতে পারবে না মহাবিশ্বের উদ্দেশ্য কী, রহস্যটা জমা থাকবে শেষের জন্য। বিশৃঙ্খলার মধ্যে লুকিয়ে থাকবে সত্য, অযুক্তির মধ্যে লুকিয়ে থাকবে যুক্তি, অর্থহীনতায় ঘাপটি মেরে থাকবে অর্থ। এবং সবশেষে সম্ভাবনা থাকবে নতুন আরেক মহাবিশ্বের। অর্কের নতুন মহাবিশ্বের কোডিং করা শেষ। “পারফেক্ট!” অর্ক নিজেকে নিজে বলল।
বর্তমান মহাবিশ্ব দ্রুত ছোট হতে লাগল। নিঃশেষ হতে লাগল সকল প্রাণ। সর্বশেষ তারাটি খসে পড়ল, সর্বশেষ গ্রহটি বিস্ফোরিত হল। সবকিছুই ফিরে গেল একটা সিঙ্গেল পয়েন্টে। অতঃপর, এই পয়েন্ট থেকে বিস্ফোরিত হল অর্কের নতুন মহাবিশ্ব। আবার শুরু হল টাইম এবং স্পেস। আকাশ ভরে উঠল তারায় তারায়। সেলেসশিয়ান সংঘর্ষ ঘটা শুরু হল। গড়ে উঠতে লাগল গ্রহের পর গ্রহ। ব্যাকটেরিয়া আর অ্যামিবার আবির্ভাব ঘটল। শুরু হল প্রাণ। উন্মোচিত হল জীবন। চলতে লাগল তার চক্র। বেঁচে থাকা, মরে যাওয়া। বেঁচে থাকা, মরে যাওয়া। চেষ্টা করা এবং ব্যর্থ হওয়া। বিবর্তিত হওয়া এবং মানিয়ে নেওয়া। চিন্তা করা এবং কথা বলা। নির্মাণ করা এবং সৃষ্টি করা। পার হতে লাগল বছরের পর বছর।
১৯৬৮ সাল।
একটা জমাট বাঁধা উত্তেজনা আনন্দে রূপ নিয়ে ছাগল শাবকের মত লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সাত বছর বয়সী অর্কের মনে। কারণ এই মাত্রই অর্ক বেশ কিছুদিন ধরে চেষ্টা করে যাওয়া একটা যন্ত্র বানানোর কাজ সফলভাবে শেষ করতে সক্ষম হয়েছে। যন্ত্রটা দিয়ে এখন সে দূর থেকেই তার কুকুরের ঘরের দরজাটা খুলতে এবং বন্ধ করতে পারবে। ব্যাপারটা আনন্দেরই।
অর্ক কৌতূহলী। শারীরিক খেলাধুলার প্রতি তার তেমন কোন আগ্রহ নেই। তবে যন্ত্রিক খেলনা তৈরির প্রতি আগ্রহ আছে বেশ। সারাদিনই এটা সেটা দিয়ে খেলনা বানানোর চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায় তার। পুরনো টিভির পার্টস, ক্যাসেট প্লেয়ারের পার্টস, এন্টেনা, সাইকেলের গিয়ার — হাতের কাছে যা পায় তা দিয়েই সে কিছু না কিছু একটা বানায়। বানিয়েই ছাড়ে। উত্তেজনা রূপ নেয় আনন্দে।
জীবনে হয়তো অর্ক আরও অনেক কিছুই তৈরি করবে। কুকুরের দরজা বানানো শেষ করার পরেই অর্কের বোন জিজ্ঞেস করল “তুই কি এর আগেও এটা বানিয়েছিলি না?”
অর্ক বলল, “হ্যাঁ, এটাকে ভেঙ্গে আবার বানিয়েছি।“
তার বোন জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
অর্ক বলল, “কি জানি। মজা লাগে। আমার মনে হয়েছে এটাকে আরও ভালো করে বানানো যেতে পারে।”
তার বোন জিজ্ঞেস করল, “এটা কি আগেরটার চেয়ে ভালো হয়েছে?”
অর্ক উত্তরে বলল, “না।”
গল্প।। অর্ক
শরিফুল ইসলাম
জুলাই ৩১, ২০১৯
ছায়াঃ দ্যা বিগিনিং অ্যান্ড এন্ড অব হিউম্যানিটি, পারস্যুট অব ঔন্ডার