মানুষের সাব্জেকটিভিটি, মোটিভেশন আর রিয়েলিটি

ছোট বেলায় গ্রামে থাকতে জ্বর-সর্দি হইলে আমরা নানু ডাক্তারের কাছে যাইতাম। নানু ডাক্তার হইল আমাদের এলাকার একজন হাতুড়ে ডাক্তার। তাঁর পুরা নাম কি সেইটা কখনই জানা হয় নাই। জ্বর-সর্দি ছাড়াও অন্যান্য ছোট খাটো রোগেও মানুষ তাঁর কাছে যাইত। একবার কি এক সমস্যা নিয়া মা আমারে তাঁর কাছে নিয়া গেল। সে আমারে জিগাইল, ‘কীরে তোর কি আচিলা রোগ হইছে নাকি অন্য কিছু?’ আমি জিগাইলাম, ‘আচিলা রোগ’ কী?’ ডাক্তার তখন একটা গল্প বলা শুরু করল।

গল্পটা এইরকমঃ

আশির দশকে এক চৈত্রের দুপুরে চল্লিশ ছুঁই ছুঁই আলী আহমদ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাড়ির পাশে পুকুর পাড়ে এক ঝোপের আড়ালে লুঙ্গি উঠাইয়া বসলেন। কাজটা যখন প্রায় অর্ধেক আগাইয়া গেছে ঠিক তখনই উনি দেখলেন পাশের একটা গাছ থাইকা একটা আচিলা নাইমা আসতেছে। ‘আচিলা’ হইলো গিরগিটির আঞ্চলিক নাম। আচিলাটা তড়িৎ গতিতে উনার নিচ দিয়া উনার পেছনের দিকে চইলা গেল। জিনিসটা কই গেল সেইটা দেখার জন্য আলী আহমদ পেছন ফিরা তাকাইলেন। কিন্তু আচিলাটারে আর দেখতে পাইলেন না। জিনিসটা গেল কই! আলী আহমদ আতঙ্কিত হইয়া পড়লেন। উনার মনে হইল আচিলাটা উনার পায়ুপথ দিয়া উনার পেটের ভিতরে ঢুকে পড়ছে। উনি টের পাইতেছিলেন উনার পেটের মধ্যে কি জানি নড়তেছে। আতঙ্কিত আলী আহমদ হাগা শেষ করার কথা ভুইলা গিয়া দৌড় দিলেন বাড়ির দিকে।

ঘরের বউরে বললেন ঘটনাটা। বউ বিশ্বাস করল না। পোলা মাইয়ারে বললেন। তাঁরাও বিশ্বাস করল না। সবাই বলতে লাগল এইটা তাঁর মনের ভুল। এইরকম হইতে পারে না। কিন্তু আলী আহমদ স্পষ্ট জানেন জিনিসটা তাঁর পেটের ভেতরেই ঢুকছে। এখন নড়তেছে। এইটারে বাহির করতে হবে। কিন্তু কীভাবে করবে সেইটা উনি জানেন না। সারাক্ষণ উনি এইটা নিয়া চিন্তা করতে লাগলেন। কেহই তাঁর কথা বিশ্বাস করতেছে না। দুশ্চিন্তায় তিনি নাওয়া-খাওয়া ছাইড়া দিলেন। উল্টা পাল্টা বকা শুরু করলেন। পাড়া প্রতিবেশীর লোকজন আইসা তারে বুঝাইতে লাগল, কেউ কেউ তারে নিয়া হাসাহাসি শুরু করল, পাগল হইয়া গেছে আলী আহমদ।

বউ ছেলে-মেয়েরা নানান হুজুর-কবিরাজ আইনা চেষ্টা চালাইল। কিন্তু আলী আহমদের অবস্থার কোন উন্নতি হইল না। এইভাবে বেশ কিছুদিন কাইটা গেল। আলী আহমদ যখন তাঁর স্যানিটি প্রায় হারাইয়া ফেইলা পুরা উম্মাদ হইয়া যাবার দশা এমন মুহূর্তে দূরের কোন এক গ্রাম থাইকা অদ্ভুদ কিসিমের এক লোক আইসা তারে জিজ্ঞেস করল,

– আপনার পেটে আচিলা ঢুকছে?
– হ
– সাংঘাতিক ব্যাপার!

আলী আহমদ বড় বড় চোখ কইরা লোকটার দিকে তাকাইলেন। তাঁর মনে হইল এই প্রথম কেউ একজন তাঁর কথা বিশ্বাস করল। সাথে সাথেই আলী আহমদের সাইকোলজি আর বায়োকেমিস্ট্রিতে পরিবর্তন আসা শুরু করল। লোকটা বলল,

– আমি আপনার পেট থাইকা আচিলা বাহির কইরা দিতে পারব।

আলী আহমদ জীর্ণ শরীর নিয়া লাফাইয়া উইঠা বললেন, ‘পারবেন?’

– হ্যাঁ, পারব। কালকেই আমি আবার আসব।

আলী আহমদের বউরে আড়ালে ডাইকা নিয়া লোকটা বলল, ‘আপনার পোলারে বলেন একটা জ্যান্ত আচিলা ধইরা আইনা ঘরে রাখতে। আমি কালকে আসব। আচিলা ধরার কথা যেন আলী আহমদ ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে।‘

পরের দিন লোকটা আবার আসল। এদিকে আচিলা ধরা হয়ে গেছে। লোকটা আলী আহমদরে খাটের উপর বসাইয়া মশারী টাঙাইতে বলল। মশারী টাঙ্গানোর আগে আলী আহমদের চোখ বাইন্ধা দিল। তাঁর কানে কানে বলল চোখ বাইন্ধা কিছু মন্ত্র পড়তে হবে। এতে আচিলা বাহির হইয়া আসবে। চোখ বান্ধা অবস্থায় আলী আহমদরে খাটের উপর হাগু করার ভঙ্গীতে বসতে বলল। আলী আহমদ তাই করলেন। এরপর খাটে টাঙানো মশারিটা চারিদিক থেকে শক্ত কইরা গুঁজে দেওয়া হইল। বেশ কিছুক্ষণ লোকটা মন্ত্র পড়ার ভান করল। তারপর জ্যান্ত আচিলাটা মশারীর ভিতরে নিয়া ছাইড়া দিল। আচিলা মশারীর ভেতরে ঘুরতেছে। আলী আহমদরে চোখ খুলতে বলা হইল। আলী আহমদ চোখ খুইলা দেখলেন মশারীর ভিতরে একটা আচিলা ঘুরতেছে। উনি বিশ্বাস করলেন যে তাঁর পেট থাইকা এইটা বাহির হইছে। আহ! অবশেষে আচিলা বাহির করা গেছে!

অতঃপর আলী আহমদ সুস্থ হইয়া উঠলেন এবং অদ্ভুদ লোকটার কাছে চিরঋণী হইয়া থাকলেন।

ওই বয়সে গল্পটার মর্মার্থের খুব গভীরে না যাইতে পারলেও এতটুকু বুঝতে পারছিলাম যে আমার সমস্যাটা রিয়েল কিনা সেইটা নিয়া ডাক্তার আমারে প্রশ্ন করতেছে। অর্থাৎ বুঝতে পারলাম রোগ না থাকলেও মানসিকভাবে রোগ অনুভূত হইতে পারে।

আমরা প্রায় সবাই আলী আহমদের মত আচিলা রোগে আক্রান্ত। এইটা আমাদের সাব্জেকটিভিটি। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের নিজ নিজ সাব্জেকটিভ ওয়ার্ল্ডে বাস করি। এইটারে আমি বলি ‘বাবল ট্র্যাপ’। আমাদের জীবনের সকল কর্মকাণ্ড এবং চিন্তা চেতনারে শেইপ দেয় আমাদের নিজস্ব বিশ্বাস। বিশ্বাস অনেক শক্তিশালী। এতই শক্তিশালী যে এইটা যে কারো জীবন আলী আহমদের মত দুর্বিষহ কইরা তুলতে পারে, আবার মিরাকেল ঘটাইয়া স্বর্গেও পরিণত করতে পারে।

বিশ্বাস কী?

মানুষের জীবন এবং অস্তিত্ব এতই বিশাল এবং রহস্যময় যে এইটার সবকিছু আমাদের লিমিটেড মাইন্ড কিছুতেই বুইঝা উঠতে পারে না। কিন্তু যা কিছু মানুষ বুঝে না কিংবা জানে না সেইসব জিনিসরে অজানা হিসেবে সে মাইনাও নিতে পারে না। তখন সে কিছু জিনিসরে বিশ্বাস কিংবা কিছু জিনিসরে অবিশ্বাস করে। কইরা একটা সেটেলমেন্টে আসে। এবং এই বিশ্বাসই তাঁর জীবনের বাকী সব কর্মকাণ্ডরে ড্রাইভ করতে থাকে।

আধুনিক মেডিক্যাল সাইন্সে একটা টার্ম আছে – “প্লাসিবো ইফেক্ট”। ডাক্তাররা জানেন যে মানুষ যত রোগ নিয়া তাদের কাছে যায় তার সব রোগ রিয়েল না। অনেক রোগই কেবল মানুষের সাইকলজিক্যালি ক্রিয়েট করা ভুয়া রোগ। এবং ওইসব রোগের কোন ওষুধ নাই। কিন্তু ডাক্তাররা এই ব্যপারটা রোগীদের বলতে পারেন না। বললে রোগীরা সেইটা মাইনা নিবে না। সেই ক্ষেত্রে ডাক্তাররা রোগীরে এক ধরণের ভুয়া ওষুধ দেন, যেই ওষুধ দেখতে রিয়েল ওষুধের মতই, কিন্তু সেইগুলা আসলে আটা-ময়দা টাইপ কিছু একটা দিয়া বানানো। এই ওষুধগুলারে বলা হয় ‘প্লাসিবো ড্রাগ’। এবং মজার বিষয় হইল এই ওষুধ খাইয়া রোগীর রোগ ভালো হইয়া যায়। রোগী যেমন নিজেই সাইকলজিক্যালি রোগটা তৈরি করছে, তেমনি ওষুধ খাওয়ার পর এইটারে চিকিৎসা মনে কইরা ভালোও হইয়া যায়। ওষুধের এই ইফেক্টারে বলা হয় “প্লাসিবো ইফেক্ট”। এই পুরা জিনিসিটা কাজ করে মানুষের সাব্জেকটিভ বিশ্বাসের উপর ভর কইরা।

মানুষের এই সাব্জেকটিভ বিশ্বাসে কি কোন সমস্যা আছে?

একভাবে বলতে গেলে নাই। কারণ কিছু সংখ্যক মানুষ সাব্জেকটিভিটির ব্যপারে সজাগ হইয়া বাবল ফুটা কইরা অব্জেকটিভ রিয়েলিটিরে অনুধাবন করতে পারলেও আলটিমেটলি সাব্জেকটিভিটি কাউরেই ছাড়ে না। তবে এইখানে ব্যবধান হইল সাব্জেকটিভ বিশ্বাসে আনকনশাসলি জীবনরে ছাইড়া দিলে সেই জীবন কন্সটিপেটেড হইয়া পড়ে, বন্ধী হইয়া পড়ে।

মানুষের সাব্জেকটিভিটির পাওয়ারের উপর ভিত্তি কইরা সাধারণত মটিভেশনাল স্পিকাররা কথা বইলা থাকেন। তারা যখন বলেন, ‘আপনি যা বিশ্বাস করবেন আপনি তাই হইতে পারবেন। আপনারে বড় বড় স্বপ্ন দেখতে হবে, স্বপ্ন বড় হইলে আপনিও বড় হইতে পারবেন’, তখন তারা যে খুব একটা মিথ্যা বলে তা না। এইটা একরকম সত্য। কারণ আপনার রিয়েলিটি তো আপনার সাবজেকটিভ বিশ্বাসই তৈরি কইরা দেয়।

তবে এইখানে যেই সত্যটা মোটিভেশনাল স্পিকাররা আপনারে বলেন না বা তারা নিজেরাও জানেন না সেইটা হইলো, আপনার সাব্জেকটিভ বিশ্বাস মোস্টলি আপনার ইনার ওয়ার্ল্ডরে প্রভাবিত করে, আপনার সাইকলিজক্যাল এক্সপেরিয়েন্সরে প্রভাবিত করে যেইটার আংশিক প্রভাব আপনার বাহ্যিক জীবনেও পরতে পারে। কিন্তু পুরাপুরি আপনার আউটসাইড লাইফ চেইঞ্জ করতে পারে না। সুতরাং চাইলেও একজন কৃষকের ঘরে জন্মাইয়া আপনে শত কোটি টাকার মালিক হইতে পারবেন না যদি না আপনার লাক আপনারে সাপোর্ট করে। বাহ্যিক একটা ঘটনা ঘটতে গেলে এইটার পিছনে হাজার হাজার (আসলে আনলিমিটেড) ভেরিয়েবল কাজ করে যেইটা আপনি আপনার বিশ্বাস দিয়া চেইঞ্জ করতে পারবেন না।

দুঃখিত, আপনারে ডিমোটিভেট করার জন্য। কি করব বলেন? আসলেই আপনি বিশ্বাস কইরা, শত পরিশ্রম কইরাও আপনার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন না। কেউ কখনও পারে নাই। রিয়েলিটি এইভাবে কাজ করে না।

তবে এইখানে সুখের খবর হইল আপনি চাইলে আপনার অনুভূতির ডিরেকশন চেঞ্জ করতে পারবেন, আপনি চাইলে যে কোন বাহ্যিক ঘটনায় আপনার ইমোশনাল রেসপন্স চুজ করতে পারবেন (শর্ত প্রযোজ্য)। এবং এইটা আপনি এই মুহূর্তে কইরাও যাইতেছেন, তবে সেইটা করতেছেন আনকনশাসলি।

জুন ১৬, ২০১৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *