মানুষ যে স্বাধীন প্রাণী সেইটার একটা প্রমান হইল সে নিজেরে নিজে মাইরা ফেলতে পারে। অর্থাৎ মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে। তবে মানুষের ‘ফ্রি উইল’ তথা স্বাধীন ইচ্ছার যে কয়টা থিওরি আছে সেইগুলা বিশ্লেষণ করা শুরু করলে হয়তো আমার এইখানে বলা ‘প্রমাণ’ কথাটা টিকবে না। সেইদিকে এখন না যাই। অন্য যে কোন কাজের পেছনে হাজার হাজার ভেরিয়েবল যুক্ত থাকা এবং ঘটে যাওয়ার পরে সেইটার চেইন অব কনসিকোয়েন্স তৈরি হওয়ার কারণে সেইখানে স্বাধীন ইচ্ছা হয়তো কাজ করে না। আর নিজেরে নিজে মাইরা ফেলার মধ্য দিয়ে যেহেতু একটা আপাত সত্তার মুক্তি ঘটে, সমাপ্তি ঘটে, এবং এইটা যেহেতু নিজের জন্য নিজে ঘটানো যায়, তাই বলা যায় যে এইখানে একটু স্বাধীনতা আছে।
আপনার যখনই মনে হবে এই জীবন আপনার আর ভালো লাগতেছে না, তখনই চাইলে আপনি নিজেরে মাইরা ফেলতে পারেন। ভালো না লাগাটার সমাপ্তি ঘটাইতে পারেন। এইটা স্বাধীনতার সর্বোচ্চ মাত্রা হইতে পারে। তবে চাইলেই যে আপনি এইটা করতে পারবেন এই স্বাধীনতা পুরাটা আসলে নাই। এইটা অবশ্য অন্য আলোচনা। কিন্তু ইতিমধ্যে পৃথিবীতে যারা আত্মহত্যা করছে সেইটা একটা অবজার্ভড নলেজ হিসেবে ইঙ্গিত করে যে মানুষ নিজেরে নিজে মারতে পারে।
তো এইখানে আসল পয়েন্ট হইলো মানুষ নিজেরে নিজে মারতে পারে। (অত্মহত্যার প্রমোশন কিংবা ফ্রি উইলের বিশ্লেষণ না)
এইটা মানুষ ছাড়া অন্যান্য সেন্টিয়েন্ট বিয়িং – ও করতে পারে।
এই নিজেরে নিজে মাইরা ফেলাটা একটা আশ্চর্যজনক ব্যপার (যদিও কেউ আত্মহত্যা করছে শুনলে আপনি মোটেও আশ্চর্য হন না, দুঃখিত কিংবা রাগান্বিত অন্যকিছু হইতে পারেন)।
একজন মানুষ যখন নিজেরে নিজে মারে সে আসলে কাকে মারে? সে আসলে কয়জন?
আপনি নিশ্চয়ই নিজেরে একজনই মনে করেন। এবং পাশাপাশি আপনি এইটাও মনে করেন যে আপনি নিজের জন্য নিজে অনেক কিছু করতে পারেন (ইনক্লুডিং নিজেরে মাইরা ফেলা)। কিন্তু আপনি শুধু ‘একজন’ (নন- ডুয়াল) হইলে এইগুলা কীভাবে করেন?
যে কোন ঘটনা ঘটতে হইলে তো সেইখানে ডুয়ালিটি থাকা লাগে। যেমন, আপনার ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়া আপনি আপনার ডান হাতেরই বুড়ো আঙুলটা ছুঁইতে বা কাটতে পারবেন না। এইটা করতে আপনাকে অন্য আঙুল কিংবা অন্য হাত ইনভল্ভ করতে হবে। অথচ অন্য কারও ইনভল্ভমেন্ট ছাড়াই আপনি নিজেরে নিজে খুন করতে পারেন। এইখানে নিজের একটা অঙ্গ দিয়া নিজের গুরুত্বপূর্ণ কোন অঙ্গরে আঘাত করাই শুধু ঘটে না। এইখানে সিদ্ধান্তটা আপনার সাইকোলজি নিজেই নেয়, যেইখানে এই সিদ্ধান্তে সাইকোলজি নিজেই মারা যাবে। এখনও আশ্চর্য হন নাই? নাও হইতে পারেন।
তো এখন বোঝা যাচ্ছে যে আপনার দৈহিক এবং মানসিক কাঠামো নিয়া যেই একজন ‘আপনি’রে আপনি চিনেন সে আসলে একজন না।
মানুষ যখন কোন বিষয়ে ডিসিশন মেইক করে তখন সেখানে স্বাধীন ইচ্ছা কতটুকু কাজ করে সেই ব্যপারে আলোচনা করতে গিয়ে ফ্রেঞ্চ-ইজরাইলি নিউরোসাইন্টিস্ট মোরান সার্ফ আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন সেলফ নিয়া কথা বলছিলেন।
তার কথায়, আমাদের মস্তিস্কে অনেকগুলা পাপেটিয়ার থাকে। একেক সময় একেক বিষয়ে একেকটা পাপেটিয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় একটা আরেকটার সাথে তর্ক করে আবার একমতও পোষণ করে, সিন্ধান্তের উপরে ভোট দেয়, শেষ পর্যন্ত যেই পাপেটিয়ারের সিন্ধান্তের জয় হয়, আমরা ধরে নেই এইটাই আমি।
অ্যামেরিকান লেখক মার্ক ম্যানসন তার লেখা “এভ্রিথিং ইজ ফাকড” বইতে আমাদের মস্তিষ্করে দুই ভাগে ভাগ করছেন। একটা হইলো ‘ফিলিং ব্রেইন’ আরেকটা হইলো ‘থিংকিং ব্রেইন’। এই দুইটা ব্রেইন মিলে আমাদের ‘কনশাসনেস কার’ তথা চৈতন্যের গাড়িটারে চালায়। এই গাড়িটার ড্রাইভিং সিটে আসলে কোন ব্রেইনটা বসে থাকে, ফিলিং ব্রেইন নাকি থিংকিং ব্রেইন? লেখক অনেক যুক্তি দিয়ে বুঝাইতে থাকেন যে আমাদের ফিলিং ব্রেইনই ড্রাইভিং সিটে বসে থাকে, যেখানে থিংকিং ব্রেইন মনে করে যে সে আসলে সবকিছু কন্ট্রোল করতেছে। এবং এই দুই ব্রেইনের মধ্যে একটার সাথে আরেকটার সম্পর্ক তেমন ভালো না।
তো প্রশ্ন হইলো এই দুই ব্রেইনের মধ্যে কোনটা আপনি? অর্থাৎ কোনটা আপনার ‘সেলফ’? নাকি দুইটাই?
ঠিক এই প্রশ্নটাই ১৯৭৭ সালের কোন এক নিশি রাইতে মারাত্মক ডিপ্রেশনে ভোগা এক ব্যক্তির মাথায় জাগছিল। ব্যক্তিটার নাম একার্ট টলি। ৭১ বছর বয়সী টলি বর্তমানে একজন কানাডায় বসবাসকারী জার্মান আধ্যাত্মিক গুরু এবং বেস্ট সেলার বই ‘পাওয়ার অব নাও’ এর লেখক। দীর্ঘদিন ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকা এই লোকের একদিন মাঝরাতে ঘুম ভাইঙ্গা যায়। ঘুম থাইকা উঠার পর তার মনে হয় সে নিজেরে আর নিতে পারছে না। ডিপ্রেশনের চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছাইয়া সে ভিতর থাইকা বইলা উঠে ‘আমি আর আমার সাথে থাকতে পারব না।’ ঠিক এইটা বলার পরেই তার মনে প্রশ্ন জাগে, ‘আমি আমার সাথে থাকতে পারব না মানে? কে কার সাথে থাকতে পারবে না? আমি কি একজন, নাকি দুইজন? আর এই ‘আমি’টা আসলে কে?’ এই প্রশ্ন তার পুরা সত্তারে কাঁপাইয়া তোলে। প্রশ্নের উত্তরে সে একটা গভীর শূন্যতায় হারাইয়া যায়। পরের দিন সকালে ঘুম থাইকা উঠার পরে সে দেখে যে তার আর কোন ডিপ্রেশন নাই। মারাত্মক প্রশান্তি কাজ করতেছে তার ভেতরে। তার সাথে ঠিক কি ঘটছে সেইটা সে বুইঝা উঠতে পারে না। পরবর্তীতে দুই বছর সবকিছু ছাইড়া দিয়া সে একটা পার্কে বইসা থাকে। একটা পর্যায়ে গিয়া যখন সবকিছু তার উপলব্ধিতে আসে, তখন সে যেইটা অনুধাবন করে সেইটা হইলো, ‘এই যে এতদিন আমি আমি করছি, এই আমি আসলে কেউ না। অর্থাৎ আমি নাই, কখনই ছিল না।‘
আমি কেউ না? আমি নাই? এইটা কেমন কথা!
হ্যাঁ, এইটারে বলা হয় ‘নো-সেলফ’। এই নো-সেলফের কথা আপনি বুদ্ধিজমে পাবেন। একার্ট টলি ছাড়াও পৃথিবীতে আরও অনেকেই (আপাত ব্যক্তিত্ব) বইলা গেছেন যে ‘আমি নাই’।
২০১৩ সালের এপ্রিলে নন-ডুয়াল টিচার টনি পারনস জেজ টিভির এক সাক্ষাৎকারে নিজের শরীরের দিকে ইঙ্গিত কইরা বলছিলেন, ‘এইটার ভিতরে কেউ থাকে না, কোন ‘আমি’ থাকে না। আমাদের মধ্যে যে সেন্স অব সেলফ জাইগা উঠে সেইটা একটা ভ্রম।’
ভারতীয় দার্শনিক ওশোরে একবার এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘আপনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কী কী করেন?’
উত্তরের শুরুতে ওশো বইলা উঠছিল, ‘আমি কিছু করি না। আই অ্যাম নট অ্যা ডুয়ার। সবকিছু নিজে নিজেই ঘটে।‘ অর্থাৎ করার মত কোন ‘আমি’ নাই।
ব্রিটিশ দার্শনিক এলান ওয়াটস, যিনি কিনা প্রাচ্যের দর্শনকে প্রথম পশ্চিমাদের কাছে সহজ কইরা তুলে ধরছিলেন, তার সব লেকচার আর বইয়ে ঘুরেফিরে বারবার বইলা গেছেন, ‘একটা চামড়ার ব্যাগের (দেহ) ভিতরে আমরা যে সেপারেট অহংরে ফিল করি আর ধইরা নেই যে এইটাই আমি সেইটা একটা ভ্রম।’
সতের শ’ শতাব্দীতে জন্ম নেয়া পাকিস্থানি কবি বুল্লে শাহ্ও নিজের ‘আমি’রে চিহ্নিত করতে গিয়া বিপদে পড়ছিলেন। এইটা প্রকাশ পাইছে তার লেখা কবিতা ‘বুল্লে কি জানা ম্যা কন’-এ, যেইটা এখন গান হিসেবে ইউটিউবে পাওয়া যায়। এই কবিতায় তিনি বারবার বলছেন, “বুল্লে!! আমি জানি না আমি কে।“ নিজেরে ডিফাইন করতে গিয়া তিনি কবিতায় ধর্ম, জাতি, আগুন, বাতাস, আদম, হাওয়া, পানি সহ সবকিছুরে নিয়া আসছেন এবং দেখছেন এর কোনটাই ‘আমি’ না। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত বুল্লে শাহ্ কোন ‘আমি’ খুইজা পান নাই।
বর্তমানের সবচাইতে প্রভাবশালী ভারতীয় ইয়গিক এবং দার্শনিক জাজ্ঞি ভাসুদেব ওরফে সাধগুরুকে অভিনেতা অনুপম খের একবার এক ইন্টার্ভিউতে প্রশ্ন করছিলেন, ‘আপনার কী করতে ভালো লাগে। আপনার পছন্দের কাজগুলার কথা যদি একটু বলেন।“
উত্তরে সাধগুরু বলছিলেন, “আমি কোন ব্যক্তি নই যে আমার নির্দিষ্ট কিছু জিনিস ভালো লাগবে আর কিছু জিনিস খারাপ লাগবে।“
হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা জিম ক্যারি ২০১৭ সালে রেড কার্পেট এওয়ার্ড শোতে এক সাংবাদিককে বলেন, “আমি কোন ব্যক্তিত্বে বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি না যে আপনি এক্সিস্ট করেন।“
এইরকম আরও অসংখ্য মানুষ এই একই কথা বইলা গেছেন বিভিন্ন সময়।
এই ‘আমি নাই’ কথাটার অর্থ কী?
আগে তো বললাম ‘আমি’ একজন না, অনেকগুলা আমি আছে। এখন আবার ‘আমি নাই’? এটা কেমন কথা!
আমাদের সবারই নিজ নিজ ব্যক্তিত্ব আছে যেইটা নিয়া আমরা সবাই গর্ব করি। একটা মানুষের অনেকগুলা ট্রেইট নিয়া তার ব্যক্তিত্ব গইড়া উঠে। এবং ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন সময় পরিস্থিতি এবং নিড অনুযায়ী চেঞ্জও হয়। পারসোনালিটি শব্দটা আসছে গ্রিক ওয়ার্ড ‘পারসোনা’ থাইকা, যার অর্থ ‘মুখোশ’। মানুষের ব্যক্তিত্ব হইল তার মুখোশ। কিন্তু সমস্যা হইল আমরা প্রায়ই ব্যক্তিত্বরেই আসল হিসেবে ধইরা নেই। এবং এই ব্যক্তিত্ব অনেকগুলা অংশে ভাগ হইয়া আমাদের ভিতরে কাজ করে। এইটারে আমি বলি ‘সিজোফ্রেনিক ব্যক্তিত্ব’।
এইরকম কেন হয়? ব্যক্তিত্ব কেবল একটা হইতে পারে না?
না, পারে না। কারণ ডুয়াল রিয়েলিটিতে ফাংশন করতে হইলে সবসময় অপোজিটে কিছু একটা থাকা লাগে।
ডুয়ালিটি কী?
আমাদের এই মেটেরিয়াল জগত হইল ডুয়াল। এইখানে ভালো থাকতে হইলে মন্দ থাকতে হয়, ডান থাকতে হইলে বাম থাকতে হয়, পজিটিভ থাকতে হইলে নেগেটিভ থাকতে হয়, উত্তর মেরু থাকতে হইলে দক্ষিণ মেরু থাকতে হয়। একটা ছাড়া আরেকটা এক্সিস্ট করতে পারে না।
হ্যাঁ, ঠিকই তো। সবই তো এমনেই চলে। তাইলে কি নন-ডুয়াল বইলা কিছু আছে?
দার্শনিক ফ্রেডরিক নিৎশের ভবিষ্যৎ নিয়া লেখা একটা বইয়ের নাম হইল ‘বিয়োন্ড গুড এন্ড এভিল’। এই বইয়ের টাইটেলটা সাজেস্ট করে যে ভালো আর মন্দের ঊর্ধ্বেও একটা অবস্থান থাকতে পারে। সেইটা হইলো নন-ডুয়াল, যদিও নিৎশে নন-ডুয়ালটি নিয়া আলাপ এইভাবে করেন নাই।
আমাদের ভেতরে যে একের অধিক সেলফ অথবা ইগো আছে সেইটা সত্য। সেইটা আপনি আমি সবাই টের পাই। আমরা প্রতিদিনই নিজের সাথে নিজে মানসিক সংঘর্ষে জড়াই। অনেকগুলা ‘আমি’ সাথে নিয়া আমরা ঘুইরা বেড়াই। এই মুহূর্তে আমার এই লেখা পড়ার সময়ও খেয়াল কইরা দেখেন আপনার স্প্লিট সেলফগুলা একটা আরেকটার সাথে এগ্রি / ডিসএগ্রি কইরা যাইতেছে।
কিন্তু এই আমিগুলারে যে এক্সপেরিয়েন্স করে সে কে?
সেইটারে বলা যায় কনশাসনেস কিংবা শূন্যতা।
কিন্ত কনশাসনেস তো আমারও আছে, আপনারও আছে। সেইম জিনিস। তাইলে এইখানে আলাদা কইরা আমি আপনারে চিহ্নিত করব কীভাবে? অর্থাৎ কনশাসনেসের ভাস্ট ফিল্ডে আমার কাছ থাইকা আমি আপনারে আলাদা করব কীভাবে?
এইটা আলাদা করা যায় না। যা আলাদা করা যায় তা হইল ব্যক্তিত্ব।
ব্যক্তিত্বের আড়ালে কী আছে? নিশ্চয়ই ‘আমি’ আছে। আড়ালের এই সত্যিকারের আমিটা খুঁজতে গিয়ে অনেকেই দেখতে পাইল সেইখানে আসলে আলাদা কোন ‘আমি’ নাই। দেখতে পাইল ব্রহ্মাণ্ডে কোন কিছুই আলাদা না, সবই এক। নন-ডুয়াল।