আধুনিক দুনিয়ায় অনেক দেশেই লটারি নামক একটা জিনিসের অস্তিত্ব আছে। প্রতি সপ্তাহেই লাখ লাখ মানুষ মনের মধ্যে ভাগ্য পরিবর্তনের আশা নিয়া লটারি নামক এই জিনিসটাতে অংশগ্রহণ কইরা থাকে। এইখানে লক্ষ্য করার মত ব্যপার হইল, এই লটারিতে কেবল অশিক্ষিত আর সুবিধা বঞ্চিত মানুষজন অংশ নেয়। অর্থাৎ টাকাওয়ালা শিক্ষিত লোকজন ভাগ্য পরিবর্তনের এই পন্থায় তেমন একটা বিশ্বাস করে না। বরং আমরা যারা শিক্ষিত তাঁদের ঠোঁটের কোণে এই ব্যাপারটা নিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি ফুইটা উঠে। আমরা ভাবি, তারা যদি জানত এই লটারির টিকেট কিনে একটা মানুষের লাখ লাখ টাকা জিতা ভাগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনাটা কত ক্ষীণ। তাঁদের যদি সেই প্রজ্ঞা আর গাণিতিক বুদ্ধিমত্তাটা থাকত, তারা হয়তো কোন দিনই লটারির টিকিট কেনার কথা চিন্তা করত না। যেইখানে সর্বাধিক পরিমাণে টাকার লটারি জিতার সম্ভাবনা হইল ১৪ মিলিয়নে মাত্র ১ টা। এই অশিক্ষিত মানুষগুলার লাইগা আমাদের একরকম করুণাই হয়। আহারে!
কিন্তু মজার বিষয় হইল, আমরাও এই অশিক্ষিত মানুষগুলার মতই। যদিও আমাদের মনে হয় আমরা কোন লটারির টিকেট কিনি না, কিন্তু আমরা আরও বড় লটারির টিকিট কিনে বসে আছি, সেইটা হইল – দ্যা লটারি অব লাইফ। জীবনে আমরা অনেক ধরণের লটারি কিনা থাকি প্রতিনিয়ত মনের মধ্যে অলৌকিক সব আশা নিয়া। এবং আমাদের মনে হয় এইখানে প্রতিটা আশা আকাঙ্ক্ষাই যৌক্তিক, কিন্তু আসলে সেইটা কাছাকাছিও না।
লটারির মত মিরাকুলাস ঘটনা ঘটার আশাটা আমাদের প্রধানত দুই ক্ষেত্রে থাকেঃ এক প্রেম / বিয়া এবং আরেকটা হইল আমাদের পেশা। যদি কাউরে বলা হয় একটা আদর্শ সফল জীবনের চিত্রায়ন কইরা দেখাইতে, তাইলে সেই চিত্রটা হইব অনেকটা এইরকমঃ
কর্মজীবনের শুরুতেই আমরা একদম সঠিক কাজটা বাইছা নিছি। এমন কাজ যেইখানে আমরা নিজেরে পুরোপুরি এপ্লাই করতে পারি। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই এই কাজের জন্য আমাদের টাকা আর সম্মান দুইটাই সমানতালে আসতে থাকে। কাজটা হইয়া উঠে ক্রিয়েটিভ এবং ফান, আমাদের মেধার সাথে যেইটার একটা সুন্দর সম্পর্ক গইড়া উঠে। পাশাপাশি আমাদের প্রেমেও আমরা পাই গভীর সুখের সন্ধান। এমন একটা সুন্দর, স্মার্ট, অনুরক্ত, ভালোবাসার যোগ্য মানুষের সাথে আমাদের প্রেম / বিয়া হইয়া যায়, যার সাথে কথা কইতে কোন শব্দ ব্যবহার করা লাগে না। এমনিতেই সে আমাদের মনের ভাষা বুইঝা ফেলতে পারে। অসাধারণ যৌন জীবন, এবং কিউট কিউট বাচ্চা কাচ্চা নিয়া একটা সুন্দর জীবন। পারফেক্ট স্বাস্থ্য নিয়া বাইচা থাইকা বুড়া বয়সে গিয়া সম্মানের সহিত অবসর গ্রহণ কইরা একটা পূর্ণতার স্বাদ নিয়া বয়সকালটারে উপভোগ কইরা নব্বই বছর বয়সে গিয়া যন্ত্রনাহীন একটা রোগে আক্রান্ত হইয়া সুন্দরভাবে মৃত্যু বরন করা। মরার আগ মুহূর্তে ফুলে সজ্জিত ঘরের মধ্যে আলিশান বিছানায় শুইয়া নিজের ছেলে পুলে নাতি নাতনির নামে সম্পত্তির উইল কইরা যাওয়া। আহা! এমন সব দৃশ্যই লটারি জিতার পেআউটের মত আমাদের মনে ভাইসা উঠে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হইল আমরা বাস্তবতার একটা মডিফাইড ভার্সন মনের মধ্যে নিয়া বাঁচতে থাকি। আমদের হয়তো বুঝতেও কষ্ট হয় যে ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত যাইতে একটা মানুষের প্রেম / বিয়া এবং পেশায় তাঁরে বেশ কিছু দুর্যোগ পার হইতে হবে। আমাদের যেই মগজটা মাথার খুলির ভিতরে বইসা আছে সেইটা প্রায়ই পরিসংখ্যান বুঝতে ভুল করে। আমরা কিছু জিনিসরে কমন হিসেবে কল্পনা কইরা নেই। ধইরা নেই যে নতুন যারা ব্যবসা করতে নামে তাঁদের অর্ধেকই বুঝি সফল। কিন্তু আসলে এইখানে সফল হয় মাত্র ২ ভাগ মানুষ। আমরা ধইরা নেই বেশীরভাগ মানুষই চিকন ভুরি আর স্লিম দেহের অধিকারী। অস্ট্রেলিয়ার মত দেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে মাত্র ৪ ভাগ মানুষের শরীর স্লিম, যুক্তরাজ্যের মত জায়গায় অর্ধেক পপুলেশনই দিনের কোন না কোন সময় টাকা নিয়া দুশ্চিন্তায় ভুগে, অর্ধেকের মত বিয়া ভাইঙ্গা যায়, এবং ৬০ ভাগ মানুষ অনুভব করে যে তাঁদেরকে কেউ ভালোবাসে না।
আমরা যখন নিজের পথ তৈরি করি, তখন এইসব ফ্যাক্ট আমাদের মাথায় থাকে খুবই কম। এর কারণ কি হইতে পারে? এইখানে কারণ হিসেবে আংশিক কাজ করে হইল আমাদের পড়া আর দেখা। মিডিয়া আমাদের চোখের সামনে জীবনের যেই ভার্সন তুইলা ধরে সেইটার সাথে বাস্তবতার তেমন একটা মিল নাই। পূর্ণতা পাওয়ার যেইসব সম্ভাবনা আমাদের মেনটাল ম্যাপে জায়গা কইরা নেয় সেইগুলা সকল বাস্তবতারে ইগনোর করে। আমরা যদি দেখতে পাইতাম বেশীরভাগ মানুষের জীবনে কিরকম সফলতা আসে, তাইলে আমাদের নিজেদের অবস্থান আর অর্জন নিয়া দুঃখ প্রকাশ করতাম খুবই কম। আমরা যদি সর্ব দর্শনের অধিকারী দেবতার মত পুরা দুনিয়া উইড়া উইড়া ঘুইরা গিয়া সব মানুষের জীবনে ঢুঁ মাইরা দেখতে পারতাম, তাইলে দেখতে পাইতাম কি পরিমাণ হতাশা আর অপূর্ণ আশা নিয়া মানুষ বাইচা থাকে, দেখতে পাইতাম কি পরিমাণ কনফিউশন আর অনিশ্চয়তায় প্রতিটা ব্যক্তি জীবন ভরা থাকে, এবং দেখতে পাইতাম কি পরিমাণ চোখের জল প্রতিটা নতুন দিনে ঝইড়া পড়ে। অতপর, আমরা রিয়েলাইজ করতাম আমাদের নিজেদের জন্যে সেট করা লক্ষ্যগুলা কি পরিমাণ অস্বাভাবিক এবং নিষ্ঠুর।
আমাদের বেশীরভাগ লক্ষ্যই অপূর্ণ থাইকা যাইব এইটা রিয়েলাইজ কইরা হয়তো কষ্টে আমাদের হৃদয় ভইরা উঠতে পারে, কিন্তু একই সময়ে এইটা আমাদের হৃদয়ে প্রশান্তিও নিয়া আসতে পারে। জীবনের এই লটারি জিততে না পারার দুঃখটা আমাদের অনেকটাই লাঘব হইয়া যায়, যখন আমরা বুঝতে পারি যে এইসব লক্ষ্য আর আশা-আকাঙ্ক্ষা বুকের মধ্যে নিয়া মানুষ হিসেবে ঘুইরা বেড়ানোটা যেমন খুবই স্বাভাবিক, এইগুলা অপূর্ণ থাকাটাও ঠিক তেমনই স্বাভাবিক।
অগাস্ট ১৪, ২০১৮
[উৎসাহ – এলাইন ডে বটন, দ্যা লটারি অব লাইফ]