এমোরাল

তখন নাইট শিফটে কাজ করি। অফিস শুরু হয় রাত দশটায়, শেষ হয় সকাল সাতটায়। সারারাত লম্বা একটা ডেস্কে সারিবদ্ধ ভাবে বইসা সামনে দুইটা মনিটরের দিকে তাকাইয়া থাইকা, ডান হাত দিয়া মাউস নাড়াইয়া, দুই হাতের দশ আঙুল দিয়া কীবোর্ডে টিপাটিপি কইরা পার কইরা দিতাম রাতের পর রাত। কাজগুলা ছিল গদবাঁধা, তার মানে খুব একটা সহজ যে ছিল তাও না। মাঝে মাঝে এক্সেল শিটে প্লেসমেন্টের হিসাব মিলাইতে গিয়া কিংবা প্লাটফর্মে এডের রোটেশন বসাইতে গিয়া মাথার তারগুলাতে গিঁট লাইগা যাইত। সেইটা আবার ছুঁইটাও যাইত বেশীরভাগ সময়েই। সারারাত জাইগা থাকলে মধ্য রাতে সবারই খিদা লাগে। আমারও লাগার কথা। অফিস থাইকা মাঝ রাতে একটা নাস্তা দেওয়া হয় সবাইরে। সবাই খায়ও মজা কইরা। কিন্তু আমি বেশীরভাগ সময়ই সেই নাস্তা খাইতাম না। কেন খাইতাম না সেইটার পেছনের কারণটা ঘোলাটে।

রাত যখন ঘড়ির কাঁটায় তিনটা পার হইয়া যাইত, তখন পেটের মধ্যে একটা খিদার অনুভূতি তার সর্ব শক্তি দিয়া মোচড় দিতে থাকত। সেইটা চলত প্রায় আধাঘণ্টা ধইরা। ওই মুহূর্তে যে চোখের পাতা দুইটার উপরও রাজ্যের ঘুম আইসা চাইপা বসত সেইটাও বইলা রাখা ভালো। কিন্তু মন যেহেতু জানে যে এখন খাওয়া কিংবা ঘুম কোনটাই সম্ভব না, তাই এই দুইটা অনুভূতি অনেক জোরাজুরি, ঘুরাঘুরি কইরাও বেশীক্ষণ টিকা থাকতে পারত না।

প্রায় প্রতি রাতেই ভোর পাঁচটার মধ্যে সব কাজ গুছানো হইয়া যাইত। বাকি দুই ঘণ্টা টিমের সবাই দুই দলে ভাগ হইয়া অনেক উৎসাহ নিয়া, চিল্লাচিল্লি কইরা, উত্তেজনায় ডেস্ক চাপড়াইয়া কম্পিউটারে ‘কল অব ডিউটি’ নামে একটা গেইম খেলত। এই গেইমটা ওরা প্রতি রাইতেই সমান উৎসাহ, সমান উত্তেজনা নিয়া খেইলা যাইত। প্রতিদিন ওরা কিভাবে ওদের উত্তেজনা একই খেলায় একই রকম ভাবে ধইরা রাখতে পারে সেইটা ভাইবা আমি বড়ই আশ্চর্য হইতাম। আশ্চর্য হইতে হইতে তখন আমি কোন একটা বইয়ের পিডিএফ কিংবা ইপাব কপি, কিংবা কানে হেডফোন লাগাইয়া একটা সিনেমা নিয়া চুপচাপ দেখতে বইসা যাইতাম। ওদের চিল্লাচিল্লি আমারে খুব একটা বদার করত না। ঘড়িতে যখন সকাল সাতটা তখন কম্পিউটার বন্ধ কইরা একরকম তাড়াহুড়া কইরাই অফিস থাইকা বাহির হইয়া পড়তাম। চোখের ঘুম আর পেটের খিদাটা নিয়া আমি যখন বাসায় যাওয়ার পথে, তখন মনে হইত কোন রাজ্যের রাজা আইসা যদি তার রাজত্ব আমার হাতে তুইলা দিয়া এই মুহূর্তে বাসা ছাড়া অন্য কোথাও যাইতে বলে, আমি নির্দ্বিধায় তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারব। ওইদিকে বাসার কাছেই একটা নির্দিষ্ট হোটেলে আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকত চারটা গরম পরোটা, এক বাটি বুটের ডাল, আর একটা কুসুম কাঁচা ডিম পোঁচ। আমার এই নির্দিষ্ট হোটেলের নির্দিষ্ট নাস্তা, অতঃপর ঘরে গিয়া আয়েশ কইরা একটা সিগারেট টাইনা দরজায় খিল দিয়া সন্ধ্যা নাগাদ ঘুম দেওয়ার সাথে পৃথিবীর আর কোন কিছুই বিনিময় করা আমার পক্ষে সম্ভব বইলা মনে হইত না।

এইরকম ভাবে কোন এক সকালে অফিস থাইকা বাহির হইছি অন্যান্য কলিগদের সাথে। অফিস থাইকা মেইন রাস্তায় যাইতে একটা চিপা গলি পার হইতে হয়। গলির মধ্যে আছে একটা ইংরেজি ‘N’ আকৃতির মোড়। আমরা যখন ‘N’ এর প্রথম কোণায় পৌঁছাইলাম, দেখলাম একটা লোক মাটিতে পইড়া কাতরাচ্ছে। লোকটার বয়স পয়ত্রিশের মত হবে। পরনে লুঙ্গি, গায়ে একটা পুরাতন শার্ট। লোকটার বা চোখের পাশে একটা বিরাট রক্তাক্ত গর্ত দেখা গেল। কেউ একজন সেইখানে ধারাল কিছু দিয়া কোপ দিছে। গালের উপর রক্তের শুকনা ধারা দেইখা বোঝা গেল ঘটনাটা ঘটছে বেশ অনেকক্ষণ হইয়া গেছে। তার মুখ দিয়া বিভিন্ন আকৃতির গোঙ্গানি আওয়াজের সাথে মিশ্র হইয়া একটা কথাই বাহির হইয়া আসতেছিল, ‘ওরা আমার রিকশাটা নিয়া গেছে’। বুঝলাম লোকটা রিকশাওয়ালা। তার রিকশা নিয়া গিয়া তাঁরে আহত কইরা এইখানে ফালাইয়া গেছে। আমরা ছিলাম পাঁচ-সাতজন। তাঁরে নিয়া কি করব যখন কেহই কিছু বুইঝা উঠতে পারতেছিলাম না, তখন আমাদের মধ্যে আরমান ভাই তাড়াহুড়া কইরা গিয়া একটা রিকশা নিয়া আসল। আমরা ধরাধরি কইরা লোকটারে রিকশায় উঠাইলাম। আরমান ভাই লোকটারে নিয়া বসল রিকশায়। দশ মিনিট দূরত্বেই আছে একটা হাসপাতাল।

আমার চোখে রাজ্যের ঘুম। ওইদিকে পেটের রাক্ষুসে খিদাটা মেটানোর জন্যে ওই নির্দিষ্ট হোটেলে অপেক্ষা করতেছে গরম পরোটা, বুটের ডাল, আর কাঁচা কুসুমের ডিম পোঁচ। এর মধ্যে কি এক ঝামেলায় পড়লাম! ভাবলাম লোকটারে হাসপাতালে কোন রকমে বুঝাইয়া দিয়াই দৌড় দেব বাসার দিকে।

আরমান ভাইয়ের রিকশার পেছন পেছন আমরা হাঁটা শুরু করলাম হাসপাতালের পথে। আমার হাতে একটা একশ টাকার নোট আর একটা পাঁচ টাকার কয়েন। এইগুলা লোকটার বুক পকেটে ছিল। লোকটারে রিকশায় উঠানোর সময় কয়েনটা পইড়া যাওয়ায় পকেটে আর কি আছে দেখতে গিয়া এইগুলা পাইলাম।
কয়েক মিনিট পরে পৌঁছাইলাম হাসপাতালে। লোকটারে স্ট্রেচারে শোয়ানো হইল। কিন্তু কোন ডাক্তারই লোকটার কোন চিকিৎসা দিতে রাজি হইল না। বলল এইটা পুলিশ কেইস। আমরা কিছু করতে পারব না। আপনারা থানায় যান। শুইনা আমার মাথা বনবন করা শুরু করল। খিদাটা আরও চাড়া দিয়া উঠল যেন। দেখলাম লোকটা স্ট্রেচারের উপরে বিনা চিকিৎসায় কাতরাচ্ছে। এইরকম আহত একটা লোকরে অন্তত প্রাইমারি চিকিৎসা দিতে কেন পুলিশ ডাকতে হবে এইটা আমার মাথায় যখন কিছুতেই খেলতেছিল না, তখন লোকটা ধরাস কইরা স্ট্রেচার থাইকা ফ্লোরে পইড়া গেল। আমি আরেকজনের সাহায্য নিয়া লোকটারে উঠাইলাম। স্ট্রেচারের সাইড বারটা উঠানো ছিল না, তাই লোকটা কাতরাইয়া পইড়া গেছে। এখন কি করা উচিত কেহই কিছু বুঝতেছিলাম না। সবারই চোখ লাল। সবার চোখ জোড়াই সারারাত তাকাইয়া থাইকা এখন বন্ধ হওয়ার জন্যে জোরাজুরি করতেছে। আমি হঠাৎ একটু রাইগা হসপিটালের একজনরে বললাম, ‘অন্তত প্রাইমারি চিকিৎসাটা দেন। পরে দেখি কোথায় নেয়া যায়। নইলে তো লোকটা মারা যাবে।’ আমার রাগেই হোক, কিংবা মানবতায় হোক, কিংবা নৈতিকতায় হোক কিংবা মায়ায় হোক সে লোকটারে একটা ইঞ্জেকশন দিয়া মাথায় ব্যান্ডেজ পড়াইয়া দিল। এই ধরণের রোগী নাকি এরা হাত দিয়া ছুঁইয়াও দেখে না সাধারণত।

আমাদের মধ্যে সবচাইতে বেশি চিন্তিত দেখা গেল আরমান ভাইরে। উনি কার মাধ্যমে জানি কোন এক পরিচিত পুলিশের খোঁজ নিয়া ফোন দিল। ওই পুলিশ বলল ঢাকা মেডিকেলের পুলিশ বক্সে নিয়া যাইতে। ওইখানে নাকি পুলিশই সব দায়িত্ব নিবে। এইদিকে এই হাসপাতালের ডাক্তার বলতেছে তাড়াতাড়ি নিয়া যাইতে, নিয়া মাথাটারে সিটি স্ক্যান করাইতে। দেরি করলে বিপদ হবে। পুলিশ, হাসপাতাল, ঘুম, খিদা, সিটি স্ক্যান, ঢাকা মেডিক্যাল সবগুলা শব্দ মাথার ভিতরে একেকটা শেল হইয়া বিঁধতে লাগল।

আমরা সব মিলাইয়া সাত-আট জনের মত আছি। এখন ঢাকা মেডিক্যালে লোকটারে কে নিয়া যাবে? সবাই এক এক কইরা একেকটা উছিলা দিয়া কাইটা পড়ল। বাকি রইলাম আমি আর আরমান ভাই। আমি কেন কোন উছিলা দেখাইয়া বাসায় যাইতে পারতেছি না সেইটা একটা অদ্ভুত ব্যপার হইয়া আমারে আরও ঘোরের মধ্যে ফেলে দিল।

আমার কোন নৈতিকতা নাই। আমি নৈতিকতায় বিশ্বাসী না। এমনকি অনৈতিকতায়ও আমার বিশ্বাস নাই। আমি এমোরাল। অর্থাৎ ভালো এবং খারাপ কোনটা নিয়াই আমার মাথাব্যথা নাই। তাইলে আমি আছি কেন? এইটা আমার ফিলসফিক্যাল স্ট্যান্ডপয়েন্ট বলা যায়। কিন্তু আমি এইটা বলতে নারাজ। কারণ, সাধারণত মানুষ তাঁর নিজের দৈনন্দিন একটিভিটি আর পারিপার্শ্বিকতাকে জাজ করে তাঁর ভেতরে প্রতিষ্ঠিত মরাল সেন্স দিয়া। এই মরাল সেন্স তাঁর সকল কর্মকাণ্ডকে ড্রাইভ করতে না পারলেও, অপরের কর্মকাণ্ড আর নিজে যা অলরেডি কইরা ফালাইছে সেগুলাকে সে তাঁর মরাল সেন্স দিয়াই ফিল্টার কইরা ভালো খারাপ নির্ধারণ কইরা ফালায়। কিছু মানুষ মরালিটি ধার করে প্রথার কাছ থাইকা অথবা বলা যায় প্রথা তাঁর উপর এইসব সেন্স একরকম চাপাইয়াই দেয়। প্রথার দেওয়া মরালিটির বেশিরভাগই হয় ফিক্সড। আর ফিক্সড মরালিটির সুবিধা হইলো, এইটা দিয়া খুব দ্রুত ভালো-খারাপ নির্ধারণ কইরা কনক্লুশনে চইলা যাওয়া যায়। আমি প্রথার এই ফিক্সড মরালীটি মানি না। আমি জানি এইটা মানুষরে আরও ইমমরাল বানায় যেইটা আপাত চোখে ধরা যায় না।

সবাই চইলা যাওয়ার পরে আরমান ভাই জিজ্ঞাসু চোখ নিয়া আমার চোখের দিকে তাকাইল, “ভাই, আপনিও কি চইলা যাইবেন?” আমি তার চোখের ভাষা বুঝতে পাইরা বললাম, “না ভাই, আমি যাব না।” আসলে আমি যাইতে পারতেছি না। কি জানি এক অদ্ভুদ শক্তি আমারে এইখানে আটকাইয়া রাখছে। এই শক্তি আমার ইচ্ছা এবং অনিচ্ছা দুইটারই ঊর্ধ্বে। একে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা যেন আমার নাই। কিন্তু আমার চোখে যে রাজ্যের ঘুম আর পেটে রাক্ষুসে খিদা।

একটা সিএনজি ডাইকা আইনা লোকটারে উঠাইলাম দুইজনে ধরাধরি কইরা। উঠাইতে অনেক কষ্ট হইল। মনে হইল লোকটার গায়ের উপর দুনিয়ার সব ভার আইসা ভর করছে। সিএনজিতে লোকটা মাঝখানে, আমি বাম পাশে, আর আরমান ভাই ডান পাশে। লোকটার মাথাটা আমার ডান হাতের উপর রাখলাম। সকাল বেলার ফাঁকা রাস্তায় সিএনজি দ্রুত গতিতে চলতেছে। লোকটা একটু পর পর ঝাঁকুনি দিয়া উঠতেছে। মাথার রক্তাক্ত গর্তটা যেন আমার দিকে হা কইরা তাকাইয়া আছে। আমি ভাবলাম, “লোকটা যদি আমার হাতের উপরেই মারা যায়, তাইলে ব্যপারটা কি দাঁড়াবে! আমি তো কখনো কাউরে স্বচক্ষে মরতে দেখি নাই। আজকে কি এই দৃশ্য দেখা লাগবে?” আমার মাথাটা লোকটার ভারি শরীরটার সাথে পাল্লা দিয়ে যেন ভারি হয়ে উঠতে থাকল। আমি আর বেশী কিছু ভাবতে পারি না।
ঢাকা মেডিকেলে গিয়া সিএনজি থামল। আরমান ভাই দৌড়াইয়া গেল পুলিশ বক্সে। পুলিশ আসল। আরমান ভাইরে একদফা প্রশ্ন করল। ছোট একটা নোট খাতায় কি কি লিখল। এরপর শুরু করল আমারে প্রশ্ন করা। কোথায় পাইছেন? কিভাবে পাইছেন? নানান প্রশ্ন। একই প্রশ্ন আবার আরমান ভাইরে করল। ফের আমারেও করল। একই প্রশ্ন, একই উত্তর। এইভাবে বারবার প্রশ্ন কইরা ওরা একটা জিনিসই নিশ্চিত হইতে চাইল যে আমরাই লোকটারে কোপাইয়া এইখানে নিয়া আসছি কিনা। লোকটার সাথে কি কি ছিল প্রশ্ন করাতে আমি একশ টাকার নোট আর কয়েনটা দেখাইলাম। দেখাইয়া লোকটার পকেটে ঢুকাইয়া দিলাম।

এইদিকে আমি তাগাদা দিচ্ছি লোকটারে ভিতরে নিতে আগে। মাথা সিটিস্ক্যান করাইতে। কিন্তু ওদের ঐদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। ওদের মূল ইন্টারেস্ট আমাদের দুইজনের উপরে। কিছুক্ষণ পরে একটা পুরানা স্ট্রেচার নিয়া একটা লোক আসল। লোকটারে বললাম আহতরে একটু ধরতে। কিন্তু সে ধরতে নারাজ। অবাক হইলাম কিনা ঘুমের ঘোরে বুঝলাম না। পরে অগত্যা সিএনজিওয়ালা আইসা ধরল। নিয়া গেলাম ভিতরে। পুলিশ দুইটা খালি প্রশ্ন কইরা যাইতেছে বারবার। বললাম প্রশ্ন পরে কইরেন, আগে উনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এমন সময় একটা নার্স সামনে দিয়া যাইতে যাইতে বলল, ‘দারোগা সাবের কাছে বুঝাইয়া না দিয়া আপনারা বাসায় যাইয়েন না। কয়দিন আগে এক ট্রেনে কাটা লোকরে আইনা এক লোক ফাইসা গেছে।’ তখন ঘোলা মাথায়ও অনুধাবন করতে পারলাম যে ভালোই ঝামেলায় জড়াইছি। আরমান ভাই আমার সাথে চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। উনার চেহারায় হালকা আতঙ্কের ছাপ। আমারটা আমি দেখতে পাইতেছি না।

পুলিশ দুইটা বলল দারোগা সাহেব ঘুমাইতেছেন এখন। নয়টায় অফিসে ঢুকবেন। আপনারা পুলিশ বক্সে গিয়া অপেক্ষা করেন। পুলিশ বক্সে ঢুকতেই পুরানা সিনেমা হলের মত প্রস্রাবের কড়া গন্ধ আইসা নাকে আঘাত কইরা সরাসরি মস্তিষ্কে চইড়া উঠল। ভিতরে কেমন গুমোট একটা ভাব। নোংরা। দুইটা বেডের উপর দেখি দুইজন কালো মত মোচওয়ালা লোক স্যান্টু গ্যাঞ্জি গায়ে বইসা আছে। যেন তামিল সিনেমার গুন্ডা। মনে হইল এইটা কোন পুলিশ বক্স না, আস্তানা। আমরা দুইজন দুইটা খালি টুল পাইয়া ভয়ে ভয়ে বইসা পড়লাম। একটা কালো লোক দুইজনরে ডাইকা নিয়া কাছে বসাইয়া জিগাইল, “কি করছেন?” আমরা বিস্তারিত বললাম। লোকটা অবাক হইয়া জিগাইল “রাস্তায় দেইখাই তুইলা এইখানে নিয়া আসলেন?” আমরা বললাম “হ্যাঁ”। লোকটা ইতস্তত কইরা বলল “ঠিকি তো, আহত লোক দেইখা এইখানে আনবেন এইটাই তো স্বাভাবিক।” কিন্তু তাঁর চোখ বলল অন্য কথা।
দারোগা সাহেব চইলা আসছেন। আমাদেরকে তাঁর রুমে নিয়া যাওয়া হইল। দারোগার মুখ ভর্তি দাঁড়ি। সবকটাই পাকা। মেহেদী দিয়া লাল কইরা রাখছে। দাঁড়ি থাকলেও চেহারায় তেমন নূরানি ভাব নাই। মনে হয় নামাজ-টামাজ পড়ে। লোকটার চেহারা দেইখা তাঁর মেজাজ বোঝা মুশকিল। হাতে একটা খাতা নিয়া আমাদের নাম ঠিকানা, ও ফোন নম্বর লেইখা নিয়া প্রশ্ন করা শুরু করল। একই প্রশ্ন, একই উত্তর। এরপর বলল ‘আপনাদের ভয় নাই। আপনারা ঠিক জায়গায় লোকটারে নিয়া আসছেন। কিন্তু সাধারণত যারা নিয়া আসে তাঁরা ঝামেলায় পড়ে রোগী মারা গেলে। কিন্তু আপনাদের দেইখা ভদ্রলোক মনে হইতেছে। আপনাদেরকে ঝামেলায় ফেলব না।’ শুইনা যেন হাফ ছাইড়া বাঁচলাম। আমি দারোগারে মনে করাইয়া দিলাম যে লোকটার মাথায় আগে সিটিস্ক্যান করাইতে হবে। শুইনা লোকটা তেমন কোন রিয়েকশন দেখাইল না। আমাদেরকে ছাইড়া দিল।

দুইজনেরই চোখে ঘুম, পেটে খিদা। আমার অপেক্ষা করা পরোটা, বুটের ডাল, আর কাঁচা কুসুমের ডিম পোঁচ আজকে আর খাওয়া হইল না। বাসায় আসতে আসতে পুলিশ আরমান ভাইয়ের ফোনে কয়েকবার ফোন করল। কইরা আবার সেই একই প্রশ্ন।

অন্য এক জায়গায় নাস্তা সাইরা বাসায় আইসা শুইলাম ১১ টায়। ভালো কাজ কইরা আসলাম, নাকি করতে গিয়া কোনরকমে পালাইয়া আসলাম সেইটা বিশ্লেষণ করতে আমার ঘোলাটে মগজ তখন অপরাগ। ঘুমটা চোখে লাইগা আসতেই ফোন বাইজা উঠল। পুলিশের ফোন। বলল অন্য আরেক থানার ওসি বলতেছে। সে আবার প্রশ্ন করা শুরু করল। প্রশ্ন শেষ কইরা বলল, “উনারে যেইখানে পাইছেন সেইটা আমার থানা। আমি তাঁর কেইসটা নিজের হাতে বুইঝা নিতেছি।” আমি ঘুমের ঘোরে বললাম ‘জী স্যার’। বইলা ফোনটা রাইখা দিলাম। ডুইবা গেলাম ঘুমের রাজ্যে।

অতঃপর, স্বপ্নে দেখলাম পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য মানুষ মাথায় কোপ খাইয়া কাতরাচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ রিকশাওয়ালা, কেউ গাড়িওয়ালা, আবার কেউ বিমানওয়ালা।

শরিফুল ইসলাম ।। এপ্রিল ২৮, ২০১৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *