অগ্নিচোখ

হসপিটালের লাউঞ্জে বইসা আছি। ডাক্তার আসবে। কম্পাউণ্ডাররে জিজ্ঞেস করলেই সে একঘেয়ে ভাবে বইলা যাইতেছে ‘স্যার আসতেছে, পথে’। কিন্তু অনন্তকাল পার হইয়া যায়, তাঁর স্যার আর আসে না। এইটা ডাক্তারদের স্বভাব। কনসাল্টিং আউয়ারে আইসা এরা প্রায় কখনই পৌছায় না। তবে অনন্তকাল পার হইয়া গেলেও এইটা নিশ্চিত যে ডাক্তার আসবে। দেরি করলেও এরা আসে। এই ব্যপারটারে মন্দের মধ্যেও ভালো বলা যায়।

আমার বা’ পাশের সিটে গা ঘেঁইষা বইসা আছে এক সুন্দরী মেয়ে। টিংটিঙে হাত, টিংটিঙে পা। রঙটা ফর্সা। দুই হাতে চিকন চিকন দুইটা বালা। সম্ভবতা সোনার। কানে ঝুলতেছে একটা দুল। অন্য কানেও বোধয় আরেকটা ঝুলতেছে, আমি একপাশে বইসা থাকায় সেইটা দেখতে পাইতেছি না। মাথার চুলগুলা তেমন লম্বা না। তবে যেটুকু আছে সেটুকুই তাঁর সৌন্দর্যরে ধইরা রাখতে পারছে বইলা মনে হয়। নাকটা সরু। যেই পাশের গালটা দেখতে পাইতেছি, সেইটার চামড়া খুব একটা মসৃণ বলে মনে হইল না। মেয়ের সবচাইতে সুন্দর হইল তাঁর পায়ের পাতা দুইটা। দুই পায়ে আবার নূপুরও পড়া আছে। নুপুর আমার খুব পছন্দের। অনেকক্ষণ তাকাইয়া থাকলাম তাঁর পায়ের দিকে।

মেয়েটার ডান পাশে বইসা আছে একটা মোটা মতন বয়স্কা মহিলা। পান চাবাইতেছে আর একটা লোকরে ইণ্ডিয়ায় গিয়া কত সহজে চিকিৎসা করা যায় সেইটা বিবিডলি বর্ণনা করতেছে। লোকটা শুনতেছে খুব মনযোগ দিয়া। দাঁড়াইয়া আছে এক অমায়িক ভঙ্গিতে। মহিলা নিজের চিকিৎসার অভিজ্ঞতা আর হসপিটালের ডিরেকশন দিতেছে লোকটারে। লোকটার অঙ্গভঙ্গি আর গলার স্বর শুইনাই বোঝা যায় মহিলার কথা শুইনা সে কৃতজ্ঞতায় প্রায় নুইয়া পড়তেছে কিংবা পড়ার ভান করতেছে। লোকটার খুব কাছের কারোর বোধয় ক্যান্সার হইছে। মহিলা পান চাবাইতে চাবাইতে লোকটারে সব বর্ণনা কইরা যাইতেছে অনর্গল। চেহারায় তাঁর বেশ তৃপ্তির ভাব। তাঁর চকচকে চোখ আর পান খাইয়া কালো করা দাঁতের হাসিতে সেইটা স্পষ্ট হইয়া আছে। এক পর্যায়ে সে মেয়েটারে দেখাইয়া লোকটারে বলল ‘এইটা আমার ছেলের বউ।‘ মেয়েটা একটা শুকনা হাসি দিল, কিন্তু কিছুই বলল না।

পাঁচ-সাত বছরের একটা ছোট ছেলে বয়স্কা মহিলার কোল থাইকা মেয়েটার কোলে সুইচ কইরা, ফ্লোরে গড়াগড়ি খাইয়া, একটা ঘোড়া আকৃতির প্লাস্টিকের খেলনায় চইড়া, হালকা পাতলা কিচিরমিচির কইরা, একটু আধটু বকা খাইয়া খেইলা যাইতেছে সেই প্রথম থাইকা। ঘোড়া আকৃতির এইরকম খেলনা আমি পার্কে দেখছি। কিন্তু হসপিটালে এইটা কিভাবে আসল সেইটা ঠিক মাথায় ঢুকতেছিল না। পিচ্চিটার চেহারাটা সুন্দর। দেখলেই আদর কইরা দিতে ইচ্ছা করে। এখন আমারও করতেছে। কিন্ত আদর করতেছি না। কেন করতেছি না সেইটার কারণ বোধয় পাশে বসা মেয়েটাই। তবে সুন্দর বাচ্চা বেশীক্ষণ সামনে ঘুরাঘুরি করলে আদর না কইরা থাকা যায় না। আচ্ছা, বাচ্চারা কি অসুন্দরও হয়? হয় বোধয়, এর মধ্যেই আরেকটা লোকের সাথে একই বয়সের একটা ছেলে কিছুক্ষন দাঁড়াইয়া ছিল। কিন্তু তাঁরে আদর কইরা দিতে ইচ্ছা করে নাই। এইটা হিউম্যান মাইন্ডের বায়াসনেস। সে শুধু সুন্দররেই আদর করতে চায়।

আমি একসময় ছেলেটার দুই গাল চাইপা ধরলাম বা হাত দিয়া। ছেলেটা নজর দিল আমার হাতের ফাইল ফোল্ডারটার দিকে। তাঁর হাতে দিলাম ফোল্ডারটা। সে নিয়াও যেন নিল না। বাচ্চারা এমনই। তাঁর চুলগুলা হাত দিয়া নাড়াইয়া দিলাম। মনে হইল ছেলেটা আমারে আপন কইরা নিছে মুহূর্তের মধ্যেই। আমার ডান গালে ধইরা আমার চোখের পাশে আচমকা সে একটা ঘুষি বসাইয়া দিল। দিয়াই আমি ব্যথা পাইতে পারি বুঝতে পাইরা সে নিজেই হাত দিয়া আমার চোখের পাশটা ঘষতে লাগল। বাচ্চাদের এইরকম কমন সেন্স থাকতে পারে দেইখা অবাক হওয়া উচিত মনে কইরা একটু অবাক হইলাম।

বাচ্চাটার সাথে যে এতকিছু ঘইটা যাইতেছে এর সবকিছুই আমার বা পাশের মেয়েটা খেয়াল কইরা বাচ্চাটারে হালকা স্বভাব সুলভ বকা দিতে লাগল, কিন্তু সে বকায় কোন জোর নাই। আমার মনে হইতে লাগল মেয়েটা যেন আমার অস্তিত্ব টের পাইতেছে না। যেন তাঁর পাশের সিটে কেউ নাই। সে একবারও আমার দিকে তাকায় নাই, চোখ দুইটা এখনো দেখি নাই। একটা মানুষের পাশে বইসাও অস্তিত্বহীন হইয়া থাকাটা অদ্ভুত।

ডাক্তার এখনো আসে নাই। আসবে। কম্পাউণ্ডারের দিকে চোখ তুইলা তাকানোতে সে চোখ দিয়াই আমারে বইলা দিল, ‘স্যার আসতেছে, পথে’।

পুরা লাউঞ্জ মানুষে ভরা। তবে সবাই রোগী না। কিন্তু সবাই কখনো না কখনো রোগী হয়। হইতে হয়। জীবন এমনই, রোগ দিয়া টুইষ্ট দিয়া নিজের বোরডেম কাটায়। লাউঞ্জে কোন সিট ফাঁকা নাই। একটা মহিলারে দেখলাম লাউঞ্জের মাঝখানের পিলারে পিঠ ঠেকাইয়া দাঁড়াইয়া আছে। পরনে তাঁর সস্তা চেক শাড়ি। হাতে একটা পাতলা ব্যাগ। ওইটার ভিতরে রিপোর্টগুলারে রাখছে। বগলে একটা প্লাস্টিকের খালি পানির বোতল। গ্রামের মহিলা, শহরে কোন আত্মীয়রে নিয়া হয়তো আসছে চিকিৎসা করাইতে। সে এদিক ওদিক তাকাইয়া সবাইরে অবজারব করতেছে, নাকি কখন কোন সিট খালি হবে সেই প্রতীক্ষায় আছে সেইটা প্রথমদিকে বোঝা গেল না।

পিচ্চিটার সাথে আমি দুষ্টামি কইরাই যাইতেছি। আমি তাঁরে মুখ ভেংচাই, সেও ভেংচায় আমারে। মেয়েটা সবই দেখতেছে, কিন্তু এমনভাবে যেন আমি এইখানে নাই। বাচ্চাটা যে মেয়েটার পেটে ধরা ছেলে এই ব্যপারে আমার কোন সন্দেহ হইল না। আমার মন বাচ্চা আর তাঁর মায়ের চেহারার মধ্যে মিল খুইজা একটা কানেকশন প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা অনেকক্ষণ ধইরা কইরা গেল। হিউম্যান মাইন্ডের এইটা আরেকটা অভ্যাস। সবকিছুর মধ্যে কানেকশন খুইজা বেড়ানো। বিবর্তনের পথে সারভাইব করার জন্যে মাইন্ডের এই কাজটা করা লাগছে। কিন্তু মাইন্ড এইটা থাইকা এখন আর বাহির হইতে পারতেছে না। তাই সে এখন সর্বদাই কানেকশন কইরা বেড়ায়। এর মধ্যে বেশীর ভাগই হয় ভুল।

একটু পরপরই পিচ্চিটা এইটা সেইটা খাইতে চায়। মাইয়াটাও যখন যা চায় সেইটা ব্যাগ থাইকা বাহির কইরা দেয়। মনে হয় সে যেন হাসপাতাল না, নিজের ঘরেই আছে। মেয়েদের এইটা একটা বড় গুণ। দুনিয়ার সব জায়গারেই সে নিজের ঘর বানাইয়া ফেলতে পারে, আপন কইরা নিতে পারে। অবশ্য এইটা করার সময় তাঁদের সাথে সরঞ্জামও থাকে। সরঞ্জামগুলাই হয়তো এদেরকে এইটা করতে সাহায্য করে। তবে যেইভাবেই করুক ব্যপারটা ভালো। স্পিরিচুয়াল প্র্যাকটিসের সবচাইতে গভীর দর্শন হইল, পৃথিবীটারে আপন কইরা নেয়া। কারণ আমরা আসলে অন্য কোন জায়গা থাইকা এই পৃথিবীতে আসি নাই, এই পৃথিবীর পেট থাইকাই বাহির হইছি। সুতরাং যেইখানেই আপনি থাকেন না কেন সেইটাই আপনার ঘর, আপনার জায়গা। এইটা অনুধাবন করতে পারলে নির্বাণ মেলে। মেয়েরা এইদিক থেকে হয়তো আগাইয়া আছে। কিন্তু ছেলেরা এইটা তেমন পারে না। এরা যেইখানেই যায়, একটা অতিথি অতিথি ভাব নিয়া থাকে, এমনকি নিজের ঘরেও। আমার বেলায় তো এইটা খুবই কড়া। এবং নিজের এই ব্যপারটা আমার পছন্দ না। গ্রামে থাকার সময় একবার আমার চাচার ঘরে ক্লাস ফাইভে পড়া এক মেয়ে বেড়াইতে আসছিল চার-পাঁচদিনের জন্যে। মেয়েটা খুবই চঞ্চল। সারাক্ষণ এ ঘর – ও ঘর আর পুকুরঘাটে দৌড়াদৌড়ি করে। বাড়ির সবার সাথেই তাঁর বেশ খাতির জইমা গেল। হঠাৎ সে আমার ভাবীরে আইসা  প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, আপনাদের ঘরে যে একটা ছেলে বেড়াইতে আসছে, শুইয়া শুইয়া খালি বই পড়ে, উনি আপনাদের কি ধরণের আত্মীয় লাগে?’ আমার ভাবী প্রশ্নটা শুইনা হাসি দিয়া বলল, ‘ছেলেটা আমাদের এইখানে বেড়াইতে আসে নাই। সে এই ঘরেরই মানুষ। সে আমার দেবর।‘

বা’ পাশের মেয়েটার হ্যান্ড ব্যাগটা অনেক ছোট। ভিতরে দুইটা ফোন। একটু পর পর বাহির করে আবার ঢুকাইয়া রাইখা দেয়। শাশুড়ি মহিলাটা একবার কানে কানে কি জানি জিজ্ঞেস করাতে সে ছোট্ট ব্যাগ থাইকা মোড়ানো কয়েকটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে শাশুড়িকে গুনে দেখাইল। তিনটা নোট। আবার মোড়াইয়া ব্যাগে ঢুকাইয়া ফেলল। এর মধ্যে পিচ্চিটা বইলা উঠল ‘মা কখন আসবে?’ মাইয়াটা তখন উত্তর দিল ‘মা ভিতরে আছে, চলে আসবে বাবা একটু পরেই।’ বুঝলাম এরা আসলে মা-ছেলে না। মাইয়াটার একটু পর পর ফোন আসতে লাগল। সে ফোনে কথা বলে। কণ্ঠটা খুব একটা সুন্দর না, তবে স্বরটায় একটা গভীর যত্নের ভাব আছে। ফোন রাইখা শাশুড়ির সাথে মিনমিন কইরা কি জানি বলে। শাশুড়ির সাথে বউদের সম্পর্ক সাধারণত ভালো হয় না। তবে এদের দুইজনের সম্পর্কটার মধ্যে একটা সৌন্দর্য দেখা গেল। হঠাৎ আমার বুকের মধ্যে একটা মোচড় দিয়া উঠল। মনে হইল যেন কিছুক্ষনের জন্যে আমার সন্ন্যাসী মনটা সংসারী হওয়ার জন্যে বিদ্রোহ কইরা উঠল।

দেয়ালে ঠেস দিয়া সস্তা চেকের শাড়ি পড়া মহিলা দাঁড়াইয়া থাইকা যে খালি সিট খুঁজতেছে সেইটা আমি ইতিমধ্যে টের পাইলাম। খুব ইচ্ছা হইল উইঠা তাঁরে বসতে বলি। বললেই সে তাড়াহুড়া কইরা ধন্যবাদ না দিয়াই খুশি মনে বইসা পড়বে। ধন্যবাদ দেওয়াটা গ্রামের মানুষের কাছে হাস্যকর ঠেকে। তাই এরা শহুরে মেকি ধন্যবাদের ধার ধারে না। কিন্তু আমি উঠতেছি না, নাকি পারতেছি না? কি যেন এক শক্তি আমারে সিটের সাথে আটকাইয়া রাখছে শক্ত কইরা। আমি বইসাই রইলাম।

ডাক্তার আসবে।

এর মধ্যে কম্পাউণ্ডার আমারে ইশারায় কাছে ডাইকা আমার আগের দেখানো প্রেসক্রিপশনটা চাইল। দিলাম। ফিরা আইসা দেখি আমার সিটে দেয়ালে হেলান দেয়া সেই মহিলা বইসা আছে। ভাবলাম ভালোই হইল। অনিচ্ছায় হইলেও আমার ইচ্ছাটা পূরণ হইল। মহিলাটা বসার পরেই মেয়েটা তাঁর সাথে আলাপ শুরু কইরা দিল। আমি ফাইল ফোল্ডারটা হাতে নিয়ে ওদের সামনেই পায়চারি করা শুরু করলাম। কারণ বসার আর কোন জায়গা নাই। মহিলাটা যে আমার সিটে বইসা পড়ল আর আমি যে তাঁর সামনে হাঁটতেছি এই ব্যাপারে তাঁর কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। যেন সে শুরু থাইকা এইখানেই বইসা ছিল। আমি পায়চারি করতেছি। মেয়েটার দিকেও মাঝে মাঝে তাকাইতেছি। এর মধ্যে সে একবার আমার চোখে চোখ রাখল। প্রথমবারের মত আমি তাঁর চোখ দেখলাম। আমার গা শিউরে উঠল। দেখলাম তাঁর দুই চোখ ভরা আগুন। জ্বলজ্বল করতেছে। এই আগুন কোন পুরুষকে জ্বালিয়ে দেওয়ার আগুন না, সিডিউস করারও আগুন না। এইটা প্রশ্ন বোধক আগুন। সে হয়তো জানেই না সেই আগুনের খবর। বুঝলাম মেয়েটা চোখে এই আগুন নিয়েই জন্মাইছে। এই আগুনই সে সারা জীবন চোখে বইয়া বেড়াবে। এইরকম এক প্রশ্নবোধক আগুনের অস্তিত্ব আমি নিজের বুকের ভেতরে টের পাইছিলাম সেই বহুকাল আগেই। এখনো বইয়া বেড়াইতেছি।

ডাক্তার আইসা পড়ছে।

গল্প। শরিফুল ইসলাম
এপ্রিল ২২, ২০১৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *