“ফ্যামিলি জিনিসটা হইলো সোসাইটির আবিষ্কার করা সবচাইতে বড় ফাঁদ, যা মিলিয়ন বছর ধইরা মানুষরে দাস বানাইয়া রাখার জন্যে ব্যবহৃত হইয়া আসছে” — এইরকম একটা কথা যদি কেউ আপনার কানের কাছে আইসা বইলা উঠে, তাইলে খুব সম্ভবত আপনার চেহারায় এমন একটা ভাব ফুইটা উঠব যেন এমন আজগুবি কথা আপনে গত কয়েক মিলিয়ন বছরেও শোনেন নাই। যদি সে আরও বইলা উঠে যে “ফ্যামিলি বন্ডিংস” নামে যেই পবিত্র বন্ধনের কথা আপনে জানেন তাঁর পুরা জিনিসটাই আসলে একটা মিথ্যা আবেগ, তাইলে আপনার চেহারা তখন যে সম্পূর্ণরূপে দেখার মত হইয়া উঠব এই ব্যপারে কোন সন্দেহ নাই। আপনার চেহারা নিয়া আমার এইরকম নিশ্চিত হইয়া যাওয়াটারে আপনার কাছে একগুঁয়েমি মনে হইতে পারে। তবে এইখানে এই “আপনি”টা আসলে আপনি না, এইটা হইলো পুরা হিউম্যান রেইসের নিরানব্বই শতাংশ, সেই অংশে আপনে পড়তেও পারেন, আবার নাও পারেন। সোসাইটি মানুষরে রুল করার জন্যে এখন পর্যন্ত যতগুলা তন্ত্র, আর সিস্টেম বানাইয়া রাখছে তাঁর মধ্যে সবচাইতে শক্তিশালী হইলো ‘ফ্যামিলি’। কারণ এইটা যে স্রেফ মানুষের দাসত্ব চালাইয়া নেওয়ার একটা পন্থা, সেইটা মানুষরে চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিলেও সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইব না। এবং এইটারে সবাই ইনটেলেকচুয়াল পাগলের প্রলাপ বইলা উড়াইয়া দিব। এই লেখাও সেইরকম উইড়া যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
প্রতিটা শিশু ভিতরে একটা আন-প্রেজুডিসড সীমাহীন শূন্যতা নিয়া জন্ম নেয়। এই শূন্যতার সীমাহীনতা যদি শিশুটা বড় হইয়া কোনরকমে আচ করতে পারে, তখন তাঁরে ঠিক মত শাসন এবং শোষণ কোনটাই করা যায় না। তাই তাঁর সেন্সগুলারে সবসময় একটা লিমিটেশনের মধ্যে রাখা হয়। আর এইটা রাখার জন্যে তাঁর সেন্সগুলারে কিছু জিনিসের সাথে আটকাইয়া দেওয়া হয়। ‘ফ্যামিলি’ হইলো এমনই একটা জিনিস। ‘ফ্যামিলি’ জিনিসটা তাঁর মধ্যে একটা ছোট্ট “Sense of belongingness” তৈরি করে। সে মনে করে এই সেন্সটা হইলো একটা ডিভাইন সেন্স। এইখান থাইকা সে শুধু তাঁর পরিবারের মানুষগুলারেই আপন ভাবা শুরু কইরা দেয়। পরিবারের বাইরে অন্য সবাইরে সে আলাদা চোখে দেখে। সে পরিবারের সবকিছু রক্ষা করার জন্যে ভায়োলেন্টও হইয়া উঠতে পারে। সে ভুইলা যায় সে শুধু একটা পরিবারেই বিলং করে না, সে আসলে এই মহাবিশ্বের একজন সন্তান। এই পরিবারকে কেন্দ্র কইরাই গইড়া উঠে তাঁর জীবনের সব চাওয়া, পাওয়া, প্রাপ্তি, আর অপ্রাপ্তি, এবং এইগুলাই তাঁরে ড্রাইভ কইরা নিয়া যায় কবর পর্যন্ত। এর ফাঁকে সে কখনই নিজেরে ঠিকভাবে আবিষ্কার করার সুযোগ পাইয়া উঠে না। এখন কথা হইলো, ব্যপারটা কি আসলেই এইরকম? উত্তর হইলো, ব্যপারটা অলমোস্ট এইরকম। তারপরে প্রশ্ন আসতে পারে (যদি উপরের কথাগুলা আপনার কাছে সেন্সিবল মনে হয় আর কি!), যুগে যুগে সমাজের মাথাগুলা ছাড়া তাইলে পুরা মানবজাতি এইভাবে দাস হইয়া আছে কিন্তু টের পাইতেছে না? কেন পাইতেছে না? উত্তর হইলো, বেশীরভাগ মানুষেরই সিস্টেমের ভিতরে থাইকা সিস্টেমের বিগ পিকচার ধরার ক্যাপাসিটি থাকে না, থাকতে দেয়া হয় না। তবে কিছু লোক নিজগুনে সেই ক্যাপাসিটি ধইরা রাখতে পারে। যারা পারে তারা চেষ্টা করে বিভিন্ন ‘পয়েন্ট অব ভিউ’ থাইকা মানুষরে বিগ পিকচারটা দেখানোর। এইরকমই একটা চেষ্টা হইলো মুভি ‘ক্যা-পাক্স’।
মুভিটা আপনারে একটা এলিয়েনের মাথার ভিতরে নিয়া বসাইব এবং সেইখান থাইকা আপনি পুরা দুনিয়া এবং দুনিয়ার মানুশগুলারে অবজার্ব করবেন। মুভির শুরুতেই দেখা যায় চোখে কালো চশমা পড়া দেখতে হুবহু মানুষের মত এক ভদ্রলোক দাবি করতে থাকে যে সে নাকি অন্য গ্রহ থাইকা আসা এলিয়েন। তাঁর গ্রহের নাম ক্যা-পাক্স এবং তাঁর নিজের নাম হইলো প্রোট। তো আমাদের এই কেন্দ্রিয় চরিত্র এলিয়েন ভদ্দরলোক প্রোটের কথা শুইনা লোকে তাঁরে পাগল সাব্যস্ত কইরা একটা পাগলা গারদে পাঠাইয়া দেয়। সেইখানে একজন সাইকাআট্রিস্টের আন্ডারে সে সার্বক্ষণিক তদারকিতে থাকে। সাইকাআট্রিস্ট ভদ্রলোক মনে করে প্রোট লোকটার মাথায় সমস্যা আছে এবং সে বিশ্বাস করে যে সে ধীরে চিকিৎসা দিয়া এই সমস্যা সে দূর করতে পারবে। এবং এই লোক মোটেও এলিয়েন না, সে স্রেফ একটা মানসিক রোগী। কিন্তু প্রোটের কথাবার্তা, আচরণ, নলেজ আর উইজডম তাঁর এই বিশ্বাসের মধ্যে ফাটল ধরাইতে শুরু করে। এবং পাগলাগারদের অন্যসব পাগলদের উপরও প্রোট ব্যাপক ভাবে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। সাইকাআট্রিস্টের এই বিশ্বাসের ফাটলের বাইড়া যাওয়া, আর অন্য সব পাগলদের সাথে এলিয়েন বেটার সম্পর্ক নিয়া আগাইতে থাকে মুভির কাহিনী।
মুভির কেন্দ্রীয় চরিত্রের কথাবার্তার মধ্য দিয়া আপনে দেখতে পাইবেন পুরা মানব প্রজাতির সত্যিকারের চেহারা। দেখতে পাইবেন মানুষগুলা সব কতটা অসহায় এবং একই সময়ে কতটা হিংস্র। প্রোটের কথার মাধ্যমে জানা যায় যে তাঁর গ্রহ ক্যা-পাক্সে ‘ফ্যামিলি’ বইলা কিছু নাই, সেইখানে কোন আইন নাই, কোন তন্ত্রও নাই। প্রতিটা শিশু জন্মের পরই ডাইভার্স পরিবেশে বড় হয়। কেবল বায়োলজিক্যাল বাপ-মার সাথেই লাইগা থাকে না। এতে কইরা প্রতিটা শিশু যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞান নিয়া সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। এবং অবশ্যই তাঁর মধ্যে ক্ষুদ্র ফ্যামিলির জন্যে “Sense of belongingness” তৈরি হয় না। সে পুরা মহাবিশ্বরেই নিজের মনে করতে পারে। আমাদের এই দুনিয়ার মানুষের এক অদ্ভুদ আচরণ হইলো, সে শুধু বায়োলজিক্যাল রিলেশন দিয়াই মানুষরে আপন আর পর কইরা নেয়। আর এই আপন পরের সেন্স থাইকা তৈরি হয় “Sense of violence”. আর এই ভায়োলেন্স থামানোর জন্যে সমাজ কিছু আইন তৈরি কইরা রাখছে যেগুলা আরও মারত্মক ভায়োলেন্ট। মানুষের এই স্টুপিড আচরণ নিয়া এলিয়েন ভদ্রলোক আমাদেরকে যা বইলা যায় তা হইলো — তোমরা মানুষরা, তোমাদের বেশীরভাগই, চোখের বিপরীতে চোখ, জীবনের বিপরীতে জীবন নেয়ার একটা পলিসিতে বিশ্বাস কইরা বইসা আছো, যেই পলিসি পুরা মহাবিশ্বে বিখ্যাত হইয়া গেছে এইটার স্টুপিডিটির জন্যে। এমনকি তোমাদের বুদ্ধা এবং ক্রাইস্টেরও চিন্তাধারা ছিল ভিন্ন। কিন্তু কেহই তাঁদের দিকে ঠিকমত মনযোগ দেয় নাই, এমনকি বুদ্ধিস্টরাও না এবং ক্রিচশিয়ানরাও না। তোমরা মানুষরা, মাঝে মাঝে কল্পনা করতেও কষ্ট হয় কিভাবে তোমরা এতদূর পর্যন্ত টিকে আছো।
এখন সবচাইতে বড় প্রশ্ন যেইটা আপনার মনের মধ্যে উঁকি দিতে পারে সেইটা হইলো, আপনি যাই বলেন ভাই, পরিবার ছাড়া আবার মানুষ টিকে ক্যামনে? এইটা কি সম্ভব? মজার ব্যাপার হইলো, ইতিমধ্যেই এক লোক দুনিয়াতে মানুষের জন্যে এইরকম একটা পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা চালাইয়া গেছে। উনি হইলেন ভারতীয় দার্শনিক ওশো। এই রিভিওর প্রথম লাইনটা এই দার্শনিকেরই মুখের কথা। সারা দুনিয়ায় তাঁর বেশ কিছু কমিউনে এইরকম পরিবেশ ছিল। তবে মিলিয়ন বছরের সিস্টেম তো আর এত সহজে ভাঙ্গে না। তো এইখানে মুভির মূল ইন্সাইট হইলো, আপনি পরিবারে থাইকাও চাইলে নিজের সেন্সটারে এক্সপান্ড করতে পারেন। একটা “Sense of inclusiveness” নিজের মধ্যে গ্রো করতে পারেন। যদিও এইটা গ্রো করা আসলে লাগে না, এইটা জন্মগত। আপনারে কেবল এই সেন্সটারে ছড়াইয়া দিতে হইব।
পুরা মানবজাতি শুধু এই সেন্সের অভাবে নিজের ভায়োলেন্সের কাছে নিজেই অসহায় হইয়া পড়ছে।
মুভির অন্যান্য পাগল চরিত্রগুলাও মানবতার বিভিন্ন দিক সিগনিফাই করে। যেমন এর মধ্যে একজন পাগল আছে যার সমস্যা হইলো সে প্রায় সব মানুষের শরীর থাইকাই দুর্গন্ধ পায়। যখন সে মানুষরে বলা শুরু করে যে তাঁদের শরীর থাইকা দুর্গন্ধ আসতেছে, তাঁরে পাগল সাব্যস্ত কইরা পাগলা গারদে নিয়া আসা হয়। এই দুর্গন্ধ আসলে শরীরের না, এইটা আসলে মানবতার ভেতরটা পচে যাওয়ার গন্ধ। আর যখন কোন ইনডিভিজুয়াল ব্যক্তি গোটা মানবজাতির সত্যিকারের রোগটা ধইরা ফেলে, তখনই সমাজ তাঁরে পাগল বইলা লেবেল লাগাইয়া দেয়।
মুভিটা অফিসিয়ালি সাই-ফাই, ড্রামা জানরার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এইটা আন-অফিসিয়ালি একটা ফিলসফিক্যাল মুভি। তবে এইসব দার্শনিক তত্ত্ব বাদ দিয়া যদি আপনি মুভিটা দেখতে বসেন, তাইলেও মজা পাইবেন কাহিনীতে। পাইবেন সাই-ফাই থ্রিল। তবে মুভিতে আপনে আহামরি কোন দৃশ্যের দেখা হয়তো নাও পাইতে পারেন। মানুষের যেই বীভৎস চেহারার কথা রিভিওর টাইটেলে বলা হইছে, সেইটাও সরাসরি দেখতে পাইবেন না। মুভির সব দৃশ্যই অসাধারন ভাবে সাদামাটা।
মুভির কেন্দ্রীয় এলিয়েন চরিত্রে অভিনয় করছে বিখ্যাত মেধাবী অভিনেতা কেভিন স্পেইসি। আর সাইকাআট্রিস্ট চরিত্রে ছিল জেফ ব্রিজেস। দুইজনের অভিনয়ই চোখ জুড়ানোর মত। পুরা মুভির কাহিনীতে বিরাজ করে একটা টানটান ঠাণ্ডা উত্তেজনা। শেষের দিকে গিয়া টুইস্টের দেখাও মিলতে পারে।
দুই চরিত্রের মনমুগ্ধকর অভিনয় আর মুভির দার্শনিক ইন্সাইট আপনারে মুভির মেকিং নিয়া অতটা মাথা ঘামাইতে দিব না। তবে রটেন টমেটোতে ক্রিটিকদের মাত্র ৪১% রেটিং দেইখা মনে হয় মুভির মেকিং-এ হয়তো কোন ধরণের ঘাপলা আছে অথবা তাঁরা সিমিলার গল্পের অন্যান্য মুভির সাথে তুলনা কইরা এমন রেটিং দিছে। তবে সেইটা যাই হোক, অডিয়েন্স মুভিটারে প্রশংসা করতে ছাড় দেয় নাই মোটেও। অডিয়েন্সের রিয়েকশন অনুযায়ী এইটারে বলাই যায় যে এইটা একটা আন্ডাররেটেড মাস্টারপিস।
আইএমডিবিতে মুভিটার রেটিং ৭.৪।