এইমাত্র একটা ছারপোকা মারলাম। একটা ট্রাঙ্কে কিছু পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটছিলাম। সেখানেই হঠাৎ সাইয়িদ ভাইজানের একটা ফটো খুঁজে পেলাম। টেবিলের উপর পড়ে থাকা একটা খালি ফ্রেমে ভাইজানের ফটোটা গুঁজে দিয়ে চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ধোবি আসবে।
প্রতি রবিবারেই আমি এভাবে বসে অপেক্ষা করি, কারণ সপ্তাহ শেষ হলেই আমার পরিষ্কার কাপড়ের সাপ্লাই ফুরিয়ে যায়। এটাকে ঠিক ‘সাপ্লাই’ বলা উচিত হবে না; দারিদ্রতার সেই দিনগুলোতে, পাঁচ-ছয় দিনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার মত যথেষ্ট কাপড় আমার ছিলো না। তখন আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছিলো, আর সে জন্যে গত দুই-তিন রবিবার আমাকে মাহিমের কাছে বেশ কয়েকবার যেতে হয়েছিলো।
ধোবি লোকটা বড় ভালো মানুষ। মাঝে মাঝেই আমি তাঁর বিল পরিশোধ করতে পারি না, তারপরও প্রতি রবিবার ঠিক দশটার মধ্যেই ধোবি আমার পরিষ্কার কাপড় নিয়ে এসে হাজির হয়ে যায়। আমি ভয়ে থাকি, কখন জানি ধোবি বেটা বিল না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে আমার সব কাপড়-চোপড় বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দেয়। তাহলে বস্ত্রহীন শরীরেই আমাকে বিয়ের কথাবার্তা সারতে হবে। ব্যাপারটা যে বড় অপমানকর হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মরা ছারপোকার সুস্পষ্ট, জঘন্য, বিশ্রী দুর্গন্ধে আমার ঘরটা ভরে গেল। গন্ধটা কিভাবে দূর করা যায় এই কথা যখন ভাবছিলাম, তখনই ধোবি এসে হাজির। ‘সালাম সাব’ বলে সে তাঁর পরিষ্কার কাপড়ের পোঁটলাটা খুলে সেখান থেকে আমার কাপড়গুলো নিয়ে টেবিলের উপর রাখলো। রাখতে গিয়ে তাঁর চোখ পড়লো সাইয়িদ ভাইজানের ফটোর উপর। ফটোটা দেখে সে চমকে উঠলো। কাছে গিয়ে ফটোটাকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে দেখলো, আর তাঁর গলা থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ নির্গত হলোঃ ‘অ্যাঁ, অ্যাঁ, অ্যাঁ?”
“কি হয়েছে, ধোবি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ধোবির ছানাবড়া চোখ দুটো ছবিটার উপরেই সেঁটে রইলো। “কিন্তু এটা, এটা তো ব্যারিস্টার সাইয়িদ সেলিম!”
“তুমি চেন তাঁকে?”
ধোবি সবলে মাথা ঝাঁকালো। “হ্যাঁ, দুই ভাই। কোলাবাতে থাকতো। সাইয়িদ সেলিম, ব্যারিস্টার। আমি তাঁর কাপড় ধুয়ে দিতাম।”
সাইয়িদ হাসান ভাইজান আর মাহমুদ হাসান ভাইজান, ফিজিতে চলে যাওয়ার আগে দুজনেই বোম্বেতে বছর খানেক আইন অনুশীলন করেছিলো, কিন্তু সেটা বেশ কয়েক বছর আগের কথা।
আমি বললাম, “তুমি কি কয়েক বছর আগের কথা বলছো?”
ধোবি আবারো সবলে মাথা ঝাঁকালো। “সাইয়িদ সেলিম ব্যারিস্টার চলে যাওয়ার সময় আমাকে একটা পাগড়ি, একটা ধূতি, একটা কুর্তা দিয়ে গিয়েছিলেন। নতুন। তাঁরা খুব ভালো লোক ছিলেন। একজনের মুখে দাঁড়ি ছিলো, ইয়া বড়।” সে হাত দিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে দাঁড়ির দৈর্ঘ্যটা আমাকে দেখালো। তারপর সাইয়িদ ভাইজানের ছবিটাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “ইনি ছিলেন ছোট। তাঁর তিনটা ছেলে-মেয়ে ছিলো…তাঁরা আমার সাথে খেলা করতে চাইতো। কোলাবায় তাঁদের একটা বাড়ি ছিলো; আলিশান বাড়ি!”
আমি বললাম, “ধোবি, তাঁরা আমার ভাই।”
ধোবির মুখ থেকে আবার সেই অদ্ভুত আওয়াজটা বেরুলো, “অ্যাঁ, অ্যাঁ, অ্যাঁ।” তারপর বলল, “সাইয়িদ সেলিম, ব্যারিস্টার?”
তাঁর বিস্ময় কমাতে আমি বললাম, “এটা সাইয়িদ হাসানের ফটো আর দাঁড়িওয়ালাটা মাহমুদ হাসানের, উনি বড়।”
ধোবি বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে, তারপর আমার ঘরের আবর্জনাগুলো নিরীক্ষণ করলো। আমার ঘরটা ছোট, ঘরে একটা বৈদ্যুতিক বাতিও নেই। আছে একটা টেবিল, একটা চেয়ার আর চাদরে ঢাকা ছোট একটা খাট, যেখানে হাজারো ছারপোকার বসবাস। তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল না আমি ব্যারিস্টার সাইয়িদ সেলিমের ভাই, কিন্তু যখন তাঁকে অনেকগুলো গল্প শোনালাম, সে অবিশ্বাসে মাথা নেড়ে বললো, “সাইয়িদ সেলিম, ব্যারিস্টার কোলাবাতে থাকতো, আর আপনি এই কোয়ার্টারে?”
আমার দার্শনিক উত্তরঃ “দুনিয়াটার অনেক রং, ধোবি। এইখানে আলো তো ওইখানে আঁধার। হাতের পাঁচটা আঙুল তো আর সমান হয় না।”
“হা, সাব। এটা ঠিক বলেছেন।”
এটা বলেই সে কাপড়ের পোঁটলাটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে হাঁটা দিলো। বিলের কথাটা আমার মনে পড়লো। পকেটে আমার আট আনা ছিলো, যা দিয়ে আমি কোনরকমে মাহিমের কাছে গিয়ে আবার ফিরে আসতে পারবো। কিন্তু সে জানতো আমি মানুষটা একবারেই নীতিহীন নই, “ধোবি, আশা করি তুমি হিসেব রাখছো। আল্লাই জানে, তুমি আমার কাছে কতগুলো কাপড় ধোয়ার টাকা পাও।”
ধোবি ধূতির ভাঁজ ঠিক করতে করতে বললো, “সাব, আমি হিসেব রাখি না। সাইয়িদ সেলিম ব্যারিস্টারের হয়ে আমি এক বছর কাজ করেছি। তিনি যা দিতেন, আমি নিতাম। হিসেব কি করে রাখতে হয় সেটা আমি জানি না।”
এটা বলেই সে চলে গেলো। আমি কাপড় পড়া শুরু করলাম। মাহিমের কাছে যাবো।
কথাবার্তা পাকাপাকি। বিয়েটা করে ফেললাম। আমার অর্থনৈতিক অবস্থারও উন্নতি হলো। সুতরাং, সেকেন্ড পীর খান এস্টেটে মাসিক নয় রুপির ছোট রুমটা ছেড়ে আমি গিয়ে উঠলাম ক্লিয়ার রোডের একটা ফ্ল্যাটে, যেখানে ভাড়াটা ছিল আমার সধ্যের মধ্যেই—মাসিক পয়ত্রিশ রুপি। ধোবিও যথা সময়ে তাঁর পারিশ্রমিক পাওয়া শুরু করলো।
আমার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি দেখে সে খুশি হয়েছিলো। আমার স্ত্রীকে সে বললো, “বেগম সাব, সাবের ভাই সাইয়িদ সেলিম ব্যারিস্টার একজন বড় মানুষ ছিলো। তিনি কোলাবায় থাকতেন। যাওয়ার সময় আমাকে একটা পাগড়ি, একটা কুর্তা, একটা ধূতি দিয়েছিলেন। আপনার সাবও একদিন বড় মানুষ হবে।”
আমি আমার স্ত্রীকে ফটোর গল্পটা বললাম এবং আমার অভাব-অনটনের দিনগুলিতে ধোবি আমার প্রতি যে উদারতা দেখিয়েছিলো সে কথাও বললাম। যখন পেরেছি, তখন তাঁর বিল পরিশোধ করেছি, কিন্তু কখনই সে কোন অভিযোগ করেনি। কিন্তু শিগ্রি আমার স্ত্রী অভিযোগ করা শুরু করলো যে ধোবি কখনই হিসেব রাখে না। “সে গত চার বছর ধরে আমার জন্যে কাজ করছে,” আমি তাঁকে বললাম,
“সে কখনই হিসেব রাখেনি।”
সে উত্তর দিল, “হিসেব রাখবে কেন? এভাবে যে সে দিগুন, চারগুণ টাকা আদায় করে নিতে পারে।”
“কিভাবে?”
“তোমার কোন ধারণাই নাই। ব্যাচেলর বাড়িগুলোতে, যেখানে কোন রমণী থাকে না, সেখানে সবসময় কিছু লোক থাকে যারা জানে কিভাবে তাঁদের মালিককে বোকা বানাতে হয়।”
প্রায় প্রতি মাসেই আমার স্ত্রী আর ধোবির মাঝে কাপড় ধোয়ার হিসেব না রাখা নিয়ে ঝগড়া বেঁধে যায়। বেচরা ধোবি পুরোপুরি নিরীহের মত উত্তর দেয়। সে বলে, ‘বেগাম সাব, আমি হিসেব জানি না, কিন্তু আমি জানি আপনি মিথ্যা বলবেন না। সাইয়িদ সেলিম ব্যারিস্টার, আপনার সাবের ভাই, উনার জন্যে আমি এক বছর কাজ করেছি। উনার বেগম সাব বলতো, “ধোবি, এই নাও তোমার টাকা।” আমি বলতাম, “ঠিক আছে।”’
কোন এক মাসে, একশ পঞ্চাশটা কাপড় ধৌত করতে দেয়া হলো। ধোবিকে পরীক্ষা করার জন্যে আমার স্ত্রী বললো, “ধোবি, এই মাসে মোট ষাটটা কাপড় ধোয়া হয়েছে।”
সে বললো, “ঠিক আছে, বেগম সাব, আপনি তো আর মিথ্যে বলবেন না।” আমার স্ত্রী যখন ষাটটা কাপড়ের দাম তাঁকে দিলো, সে টাকাটা কপালে ঠেকিয়ে বাহিরের দিকে রওয়ানা হলো।
আমার স্ত্রী তাঁকে ডেকে দাঁড় করালো। “ধোবি, দাঁড়াও, কাপড় ষাটটা ছিলো না, কাপড় ছিলো একশ পঞ্চাশটা। এই নাও বাকী টাকা, আমি মজা করছিলাম।”
ধোবি শুধু বললো, “বেগম সাব, আপনি তো আর মিথ্যে বলবেন না।” বাকী টাকাটা কপালে ঠেকিয়ে ‘সালাম’ বলে সে বেরিয়ে গেলো।
বিয়ের দুই বছর পর, আমি দিল্লিতে স্থানান্তরিত হলাম। বোম্বেতে ফিরে আসার আগে সেখানে দেড় বছর ছিলাম। বোম্বেতে এসে মাহিমের ওখানে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম। তিন মাসের মধ্যে আমরা ধোবি পাল্টেছি চারবার, কারণ তাঁরা সবাই ছিলো ঝগড়াটে আর জোচ্চোর। প্রতিবারই কাপড় ধোয়ার পর একটা কাণ্ড বাঁধতো। মাঝে মাঝে কাপড় ধোয়ার গুনগত মান ছিলো খুবই জঘন্য, নিম্নপর্যায়ের; অনেক সময়, কিছু কাপড় ফেরত আসতো না। আমাদের পুরনো ধোবির কথা খুব মনে পড়ছিলো। একদিন যখন আমাদের সব ধরনের ধোবি পরিবর্তন শেষ হলো, কথা নেই বার্তা নেই আমাদের পুরনো ধোবি এসে হাজির, বললো, “আমি সাবকে একদিন বাসে দেখেছি। ভাবলাম, এ কি করে সম্ভব? সাব তাহলে বোম্বেতে ফিরে এসেছে। তারপর আমি বিকুলাতে খোঁজ লাগালাম, কাগজ ওয়ালা বললো আপনাকে মাহিমের এখানে খোঁজে দেখতে। পাশের ফ্ল্যাটেই সাবের বন্ধুর খোঁজ পেলাম, তারপর এখানে চলে আসলাম।”
ধোবিকে পেয়ে আমরা রোমাঞ্চিত হলাম, অন্তত লন্ড্রির সামনে একটা আনন্দ আর পূর্ণতার সময় শুরু হলো।
একটা কংগ্রেস দল ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করলো। মদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলো। তখনো বিদেশী মদ পাওয়া যেতো, কিন্তু ভারতীয় মদ বানানো ও বিক্রি করাটা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলো। শতকরা নব্বই ভাগ ধোবিই ছিলো মদ্যপ। সারাটা দিন পানিতে আর সাবানে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ঐ কোয়ার্টার কিংবা আধা বোতল মদ খাওয়াটা ছিলো তাঁদের জীবনের একটা প্রথা। আমাদের ধোবি অসুস্থ হয়ে পড়লো, এবং সে লুকিয়ে বিক্রি করা অবৈধ ভেজাল মদ দিয়ে তাঁর রোগের চিকিৎসা করতে লাগলো। এতে সে আরও ভয়ানকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লো, মৃতপ্রায় অবস্থা।
সেই সময়টায় আমি ছিলাম প্রচণ্ড ব্যস্ত, ভোর ছয়টায় বাসা থেকে বের হতাম, ফিরতাম রাত দশটায়, সাড়ে দশটায়। কিন্তু আমার স্ত্রী ধোবির অসুস্থতার কথা শুনে সরাসরি তাঁর বাড়িতে চলে গেলো। একজন ভৃত্য আর ট্যাক্সি চালকের সাহায্যে, তাঁকে ট্যাক্সিতে তুলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। ধোবির অবস্থা দেখে ডাক্তারের মায়া হলো, তিনি তাঁর চিকিৎসার টাকা নিতে চাইলেন না। কিন্তু আমার স্ত্রী বললো, “ডাক্তার সাহেব, ভালো কাজের পুরো কৃতিত্বটা আপনি একলা নিতে পারেন না।”
ডাক্তার মুচকি হেসে বললো, “ঠিক আছে, চলুন ভাগ করে নেই।” তিনি চিকিৎসার অর্ধেক টাকা নিলেন।
যথাসময়ে ধোবি সুস্থ হয়ে উঠলো। কয়েকটা ইঞ্জেকশনে তাঁর পাকস্থলীর সংক্রমণটা সেরে গেলো, আর শক্তিশালী ওষুধে তাঁর শরীরের দুর্বলতাও ধীরে কেটে গেলো। কয়েকমাসের মধ্যেই ধোবি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলো। প্রতি বার উঠতে, বসতে, সে আমাদের জন্যে দোয়া করতে লাগলো, “ভগবান যেন সাবকে সাইয়িদ সেলিম ব্যারিস্টারের মত বড় মানুষ বানিয়ে দেন; সাব যেন কোলাবায় থাকতে পারেন; ভগবান যেন উনাকে একটা ছোট্ট ফুটফুটে সন্তান দেন; অনেক অনেক টাকা দেন। বেগম সাব একটা মোটর গাড়িতে করে ধোবিকে নিতে এসেছিলেন; তিনি ধোবিকে দুর্গের পাশে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন; ভগবান বেগম সাবকে সুখে রাখুন।”
অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেলো। দেশের মানুষ অনেক উথান পতন দেখেছে। ধোবি প্রতি রবিবার নিয়মিত আসে, যায়, নির্ভুল। সে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ; আমরা তাঁর জন্যে যা করেছি সেটা সে কখনই ভুলেনি; এখনো সে আমাদের জন্যে দোয়া করে। সে মদ খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে। প্রথম দিকে, তাঁর একটু আধটু খারাপ লাগতো, কিন্তু এখন সে মদের নামটি মুখেও আনে না। সারাদিন পানিতে পড়ে থাকার অবসাদ কাটানো ছাড়া সে মদের আর কোন প্রয়োজন অনুভব করে না।
তারপর আসলো খারাপ সময়; দেশ ভাগ হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হলো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। দিনের আলোয়, রাতের অন্ধকারে, হিন্দু পাড়ায় মুসলিম, মুসলিম পাড়ায় হিন্দু, বেঘোরে খুন হচ্ছিলো। আমার স্ত্রী লাহোরে চলে গেলো।
পরিস্থিতি যখন চরমে, আমি ধোবিকে বললাম, “শোন ধোবি, তুমি বরং এখন কাজ করা বন্ধ করে দাও। এটা মুসলিম পাড়া। তুমি নিশ্চয়ই এখানে মারা পড়তে চাও না।”
ধোবি মুচকি হাসলো, “সাব, আমাকে কেউ মারবে না।”
আমার নিজের পাড়ায় অনেক মারামারির ঘটনা ঘটছিলো, কিন্তু ধোবির আসা-যাওয়া বন্ধ হলো না।
এক রবিবার সকালে, আমি বাড়িতে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম। খেলার পাতায় ছিলো ক্রিকেট স্কোরের টালি, আর প্রথম পাতায় ছিলো দাঙ্গায় হিন্দু এবং মুসলিমের মৃতের সংখ্যা। আমি খেয়াল করছিলাম দুইটা স্কোরের মধ্যে কি ভয়ঙ্কর মিল! তখন ধোবি আসলো। আমি কপিবইটা খুলে কাপড় গুলো চেক করলাম। ধোবি হাসতে হাসতে গল্প করা শুরু করলো, “সাইয়িদ সেলিম ব্যারিস্টার বড় ভালো মানুষ ছিলেন। যাওয়ার সময় আমাকে একটা পাগড়ি, একটা কুর্তা এবং একটা ধূতি দিয়েছিলেন। আপনার বেগম সাবও একজন উঁচু মানের মানুষ ছিলেন। তিনি চলে গেছেন, না? দেশের বাড়িতে? উনাকে যদি কোন চিঠি লিখেন, আমার ‘সালাম’ পাঠাবেন। তিনি মোটর গাড়িতে করে আমার ঘরে এসেছিলেন। আমার সে কি ডায়রিয়া হয়েছিলো! ডাক্তার আমাকে ইঞ্জেকশন দিলো। আমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে গেলাম। আপনি যদি উনাকে চিঠি লেখেন, আমার ‘সালাম’ পাঠাবেন। এটাও বলবেন, রাম খিলাভান উনাকে চিঠি লিখতে বলেছে।”
আমি ধমক দিয়ে তাঁকে থামিয়ে দিলাম। “ধোবি, তুমি কি আবার মদ খাওয়া শুরু করেছ?”
সে হাসলো, “মদ? মদ কোথায় পাব?”
এর বেশী কিছু বলাটা আমার কাছে যথোপযুক্ত মনে হলো না। সে ময়লা কাপড়গুলো একটা পোঁটলায় পেঁচিয়ে চলে গেলো।
কিছুদিনের মধ্যে, পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেলো। লাহোর থেকে একের পর এক টেলিগ্রাম আসা শুরু হলোঃ “সব ছেড়ে এখনি চলে আসো।” সপ্তাহের শুরুতে ভেবেছিলাম পরের রবিবারে চলে যাব, কিন্তু অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে পরের দিন সকালেই আমাকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছিল।
কিন্তু কাপড়গুলো ছিলো ধোবির কাছে। ভাবলাম, কারফিউ শুরু হওয়ার আগে আমিই গিয়ে তাঁর কাছ থেকে কাপড়গুলো নিয়ে আসবো।
সুতরাং সন্ধ্যায় একটা ভিক্টোরিয়াতে চড়ে মহালক্ষ্মী চলে গেলাম। কারফিউর এখনো এক ঘণ্টা বাকী, রাস্তায় এখনো গাড়ি-ঘোড়া দেখা যাচ্ছে, ট্রামগুলো এখনো চলছে। আমার ভিক্টোরিয়াটা যখন ব্রিজের কাছে পৌঁছালো, হঠাৎ একটা গোলমাল শুরু হয়ে গেলো। লোকজন অন্ধের মত ছোটাছুটি শুরু করে দিল। ভিড়টা যখন একটু কমলো, দেখলাম দূরে অনেকগুলো ধোবি লাঠি হাতে, নাচছে। অদ্ভুত, অস্পষ্ট আওয়াজ বেরিয়ে আসছিলো তাঁদের গলা দিয়ে। আমি সেদিকেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু যখন ভিক্টোরিয়ার চালককে বললাম, সে যেতে চাইলো না। ভাড়াটা মিটিয়ে পায়ে হাঁটা শুরু করলাম। যখন ধোবিদের কাছাকাছি গেলাম, তাঁরা আমাকে দেখে চুপ মেরে গেলো।
একজন ধোবিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “রাম খিলাভান কোথায় থাকে?” লাঠি হাতে একটা ধোবি হেলেদুলে আমাদের দিকে এগিয়ে আসলো। “ইনি কি জিজ্ঞেস করছেন?” আমি যে ধোবিকে প্রশ্ন করেছিলাম তাঁকে সে জিজ্ঞেস করলো।
“ইনি জানতে চাইছেন রাম খিলাভান কোথায় থাকে।”
নেশায় বুঁদ, মাতাল ধোবিটা আমার গায়ে এসে ঢলে পড়লো। “কে আপনি?”
“আমি? রাম খিলাভান আমার ধোবি।”
“রাম খিলাভান আপনার ধোবি। কিন্তু কোন ধোবির বাচ্চা আপনি?”
একজন চিৎকার করলো, “হিন্দু ধোবির, নাকি মুসলিম ধোবির?”
সবগুলো ধোবি, বেহুঁশ মাতাল, খুব নিকটে, আমার চারপাশে হাত উঁচিয়ে তাঁদের লাঠিগুলো দোলাচ্ছিল। আমাকে তাঁদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হচ্ছিলঃ আমি মুসলিম নাকি হিন্দু? আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। দৌড়ে পালানোর চিন্তাটা মাথায় আসেনি কারণ তাঁরা সবাই আমায় ঘিরে ফেলেছিলো। আশেপাশে কোন পুলিশও ছিলো না যে চিৎকার করে সাহায্য চাইবো। ভঁয়ে হতবিহ্বল হয়ে আমি ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাক্যে কথা বলা শুরু করলাম। “রাম খিলাভান একজন হিন্দু…… আমি জানতে চাইছি সে কোথায় থাকে…… তাঁর ঘরটা কোন দিকে…… সে দশ বছর ধরে আমার ধোবি…… সে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো…… আমি তাঁকে সারিয়ে তুলেছি……আমার বেগম……আমার মেমসাব একটা মোটর গাড়ি নিয়ে এসেছিলো…” আমি একটু বেশীই বলে ফেলেছিলাম, নিজের জন্যে তখন আমার ভয়ানক করুণা হলো। গভীরে, আমার ভেতরটা ভরে উঠলো লজ্জায়, জীবন বাঁচানোর জন্যে যে লজ্জায় মানুষ আনায়াসে ডুব দেয়। আমার হীনাবস্থা আমাকে বেপরোয়া করে তুললো। “আমি মুসলিম” আমি বললাম।
ভিড়ের সবাই চিৎকার করে উঠলো, “মেরে ফেলো, মেরে ফেলো তাঁকে।”
মাতলামিতে বেহুঁশ একজন ধোবি ঘুরে একপাশে গিয়ে বললো, “দাঁড়াও। রাম খিলাভান তাঁকে মারবে।”
আমি ঘুরে উপরে তাকালাম। রাম খিলাভান দাঁড়িয়ে আছে আমার উপর, হাতে ঘুরাচ্ছে একটা মুণ্ডর। সে আমার দিকে তাকিয়ে তাঁর নিজস্ব ভাষায় মুসলিমদের উপর কদুক্তি ছোঁরা শুরু করলো। মুণ্ডরটা উঁচিয়ে গজগজ করতে করতে সে ঝাপিয়ে পড়লো আমার উপর।
“রাম খিলাভান!” আমি কর্তৃত্বপূর্ণ গলায় বললাম।
“চুপ কর!” সে গর্জন করলো।
“রাম খিলাভান…”
আমার শেষ আশাটাও চলে গেল। সে যখন আমার খুব কাছে, আমি নরমভাবে শুষ্ক গলায় বললাম, “তুমি আমাকে চিনতে পারছ না, রাম খিলাভান?”
রাম খিলাভান আক্রমণ করতে মুণ্ডর উঁচিয়ে ধরলো। তারপর তাঁর চোখগুলো সরু হয়ে গেলো, ছড়ালো, আবার সরু হলো। মুণ্ডরটা তাঁর হাত থেকে পড়ে গেলো। সে আরও কাছে এসে মনযোগ দিয়ে আমাকে দেখলো এবং কেঁদে উঠলো, “সাব!”
সে দ্রুত তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের দিকে ঘুরে বললো, “ইনি মুসলিম নন। ইনি আমার সাব। বেগম সাবের সাব। বেগম সাবই আমাকে মোটর গাড়িতে করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে আমার ডায়রিয়া ভালো করেছিলো।”
রাম খিলাভান তাঁদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু তাঁরা তাঁর কথা শুনবে না। সবগুলো মাতাল। সবাই এদিকে-ওদিকে আঙুল তুলে নির্দেশ করছিল। কোন কোন ধোবি রাম খিলাভানের পক্ষ নিলো। তাঁদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে গেলো। এই সুযোগে আমি পিছলে বেরিয়ে গেলাম।
পরের দিন সকাল নয়টায় আমি সব জিনিসপত্র গুছিয়ে তৈরি। টিকিটের জন্যে বসে ছিলাম। আমার এক বন্ধু কালো বাজারে টিকিট কিনতে গেছে।
আমি তখন মারাত্মকভাবে অস্থির। কখন টিকিটটা আসবে, আর কখন আমি বন্দরে যাব! মনে হচ্ছিল, একটু দেরি হলেই আমি আমার ফ্ল্যাটেই বোধয় কারাবন্দী হয়ে পড়বো।
দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। ভাবলাম টিকিট চলে এসেছে। দরজা খোলে দেখলাম ধোবি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
“সালাম সাব!”
“সালাম!”
“আমি কি ভেতরে আসতে পারি?”
“আসো”
ধোবি নীরবে ভেতরে প্রবেশ করলো। তাঁর পোঁটলাটা খুলে কাপড়গুলো বিছানার উপরে রাখলো। ধূতিতে সে চোখ মুছলো, ভেজা গলায় বলল, “আপনি চলে যাচ্ছেন, সাব?”
“হ্যাঁ”
সে কান্না শুরু করলো। “সাব, দয়া করে আমাকে মাফ করে দেবেন। সব দোষ ঐ মদ খাওয়ার…আর……আর আজকাল ফ্রিতে মদ পাওয়া যায়। ব্যবসায়ীরা মদ বিলি করে এবং বলে, ‘মদ খাও আর মুসলিম মারো।’ মদকে কি আর না বলা যায়? দয়া করে আমাকে মাফ করে দিন। আমি মাতাল ছিলাম। সাইয়িদ সেলিম ব্যারিস্টার অনেক ভালো লোক ছিলেন। তিনি আমাকে একটা পাগড়ি, একটা ধূতি, একটা কুর্তা দিয়েছিলেন। বেগম সাব আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। আমি পেটের ব্যামোয় মরেই যেতাম। তিনি একটা মোটর গাড়ি নিয়ে আসলেন। আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। কতগুলো টাকা খরচা করলেন। আপনি নতুন দেশে যাচ্ছেন। দয়া করে বেগম সাবকে বলবেন না
যে রাম খিলাভান……”
তাঁর গলাটা ধরে এলো। আর কিছুই বলতে পারলো না। পোঁটলাটা কাঁধে নিয়ে সে বাইরের দিকে হাঁটা দিলো। আমি তাঁকে থামালাম। “রাম খিলাভান, দাঁড়াও……”
কিন্তু সে ধূতির ভাঁজ ঠিক করতে করতে দ্রুত বেগে বেরিয়ে গেলো।
মূলঃ রাম খিলাভান — সাদাত হাসান মান্টো