এরাবি

নর্থ রিচমণ্ড সড়কটি ছিল নিঝুম একটা কানা গলি। শুধুমাত্র ক্রিশ্চিয়ান ব্রাদার্স স্কুলের ছুটির সময়টায় কিছুক্ষণের জন্য কোলাহলে জেগে উঠত গলিটা। তারপর আবার ডুবে যেত নির্জনতায়। গলির কানা মাথায় এক খণ্ড চৌকো জমিতে দাড়িয়ে ছিল একটা দোতলা বিচ্ছিন্ন বাড়ি, পরিত্যক্ত। নিজেদের ভেতরের বাস করা আভিজাত্যে সজাগ বাদ বাকি বাড়িগুলো বাদামি শান্ত চেহারা নিয়ে একে অন্যের দিকে পলকহীন চোখে চেয়ে থাকত।

আমাদের বাড়ির আগের ভাড়াটিয়াটা ছিল একজন পাদ্রি। পেছনের ড্রয়িং রুমেই তিনি মারা যান। দীর্ঘদিনের বদ্ধ বাসি বাতাসে ভারাক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল সব গুলো ঘর। রান্না ঘরের পেছনের ঘরটা ছিল পুরনো অকেজো ছেড়া কাগজপত্রে ঠাসা। ঐসব জঞ্জালের মধ্যেই আমি কিছু পেপার কাভারের বই খুঁজে পেয়েছিলাম। বইয়ের পাতা গুলো ছিল স্যাঁতস্যাঁতে আর কুঁচকানো। বইগুলো ছিলঃ ওয়াল্টার স্কটের দ্যা অ্যাবট, দ্যা ডেভউট কমুনিকেন্ট এবং দ্যা মেমরি অব ভিদক। শেষ বইটাই আমার প্রিয় ছিল কারন তাঁর পাতাগুলো ছিল হলদে। বাড়ির পেছনের জঙ্গল সদৃশ বাগানের মাঝখানে ছিল একটা আপেল গাছ আর এলোমেলো কিছু ঝোপঝাড়। যার নিচেই আমি মরা ভাড়াটিয়ার ফেলে যাওয়া জং ধরা একটা সাইকেল পাম্পার পেয়েছিলাম। পাদ্রি মানুষটা বড় পরোপকারী ছিল। তাঁর সকল অর্থকড়ি সে দান করে গিয়েছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আর ঘরের সব আসবাবপত্র দিয়ে গিয়েছিল নিজের বোনকে।

শীতের ছোট দিনগুলি যখন আসত, আমাদের রাতের খাবার সেরে উঠার আগেই নেমে আসত ঘোর সন্ধ্যা। রাস্তায় যখন বাড়িগুলোর সাথে দেখা হত, তখন তাঁদেরকে দেখে খুব বিষণ্ণ মনে হত। মাথার উপরের আকাশের রঙটা চির-পরিবর্তনশীল বেগুনী রং ধারন করত যার দিকে ক্ষীণ আলোয় মিটি মিটি জ্বলা লণ্ঠন তুলে ধরত স্ট্রীট ল্যাম্প গুলি। শীতের ঠাণ্ডা বাতাস আমাদের গায়ে এসে হুল ফোটাত। শরীর উত্তপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা খেলেই যেতাম। নিঝুম রাস্তার নীরবতায় প্রতিধ্বনিত হত আমাদের হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজ। আমরা খেলতে খেলতে বাড়িগুলোর পেছনে কাদা থকথকে অন্ধকার চোরা গলিতে ঢুকে পড়তাম, যেখানে কঠিন চেহারার উপজাতিদের কুটির থেকে তাঁদের হাতের দস্তানা নিয়ে দৌড় দিতাম। বাড়ির পেছনে অন্ধকারে ডুবে থাকা বাগানগুলো ভরে উঠত কয়লাখনির পোড়া গন্ধে। গন্ধটা অন্ধকার বেয়ে বেয়ে সেই জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়াত যেখানে গাড়োয়ান ঘোড়া গুলোর শরীরে হাত বোলাত অথবা ঘোড়ার সাজ পরানোর টুং টাং আওয়াজে সঙ্গীত বেজে উঠত। যখন আমরা রাস্তায় ফিরে আসতাম, রান্না ঘরের জানালা চুইয়ে আলোয় আলোয় ভরে উঠত এলাকাটা। যদি চাচাকে রাস্তার বাঁকে দেখতাম, আমরা ছায়ায় লুকিয়ে থাকতাম চাচা নিরাপদে ঘরে ঢোকার আগ পর্যন্ত। অথবা যদি মাঙ্গানের বোন ঘরের বাহিরে তাঁকে চা খেতে ডাকতে আসতো, আমরা মেয়েটাকে রাস্তার ছায়া থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। সে কি দাড়িয়ে থাকবে নাকি ভিতরে যাবে সেটা দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম; যদি দাড়িয়ে থাকত আমরা নিজেদের ছায়া ছেড়ে মাঙ্গানের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটা শুরু করতাম। আধ খোলা দরজার আলোয় তাঁর অবয়ব দেখেই বোঝা যেত সে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। যখন সে ভাইয়ের অবাধ্যতায় তাঁর সাথে খুনসুটি করত, আমি পাশের রেলিং-এ দাড়িয়ে তাঁকে দেখতাম। সে নড়ে উঠলেই তাঁর জামায় ঢেউ খেলে যেত, এবং তাঁর চুলের নরম বেণীটা এপাশ থেকে উপাশে দুলতে থাকত।

প্রত্যেক সকালেই আমি সামনের ফ্লোরে শুয়ে শুয়ে তাঁর দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। পর্দাটাকে টেনে ইঞ্চি খানেক নিচে নামিয়ে রাখতাম যাতে আমায় দেখা না যায়। যখনি সে দরজার ধারটায় আসত, আমার হৃদপিণ্ডটা লাফ মেরে উঠত। আমি দৌড়ে হলের দিকে যেতাম, বইগুলো হাতে নিয়ে তাঁকে অনুসরণ করতাম। পুরো সময়টা আমার চোখ সেটে থাকত তাঁর বাদামী অবয়বে, আর যেই না আমাদের পথ আলাদা হওয়ার জায়গাটা চলে আসত, আমি দ্রুত পদে তাঁকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম। এমনটা প্রতিদিন সকালেই ঘটত। দুয়েকটি মামুলি শব্দ বিনিময় ছাড়া তাঁর সাথে আমার তেমন কোন কথাই হয়নি, তারপরও তাঁর নামটা যেন আমার শরীরের প্রতিটা রক্ত কণাকে বশ করে ফেলেছিল।

যেসব জায়গায় প্রেম-ভালবাসার চিন্তা মাথা থেকে ছুটে পালায়, সেখানেও তাঁর অস্তিত্ব আমাকে সঙ্গ দিত। শনিবারের সন্ধ্যা গুলোতে চাচী যখন কেনাকাটা করতে বাজারে যেত, তাঁর সাথে জিনিস পত্র বহন করার জন্যে আমাকেও যেতে হত। আলোকোজ্জ্বল রাস্তাগুলোর উপর দিয়ে আমরা হেঁটে যেতাম। রাস্তাগুলোতে ছিল মাতাল লোকজনের ঠাসাঠাসি, কোথাও মহিলারা দর কষাকষি করছিল, শ্রমিকেরা অভিশাপ ছুড়ে দিচ্ছিল, দোকানী ছেলেগুলোর উগ্র প্রার্থনা সঙ্গীত শোনা যাচ্ছিল, এবং ভেসে আসছিল ভিক্ষুকদের নাকি সঙ্গীতের সুর যেখানে উঠে আসত তাঁদের জন্মভূমির দুঃখ দুর্দশার কথা অথবা তাঁরা গান গাচ্ছিল জনপ্রিয় হিরো রোসাকে নিয়ে। এই সমস্ত কোলাহলগুলো এক বিন্দুতে মিলিত হয়ে আমার জন্যে জীবনের একটা একক অনুভুতিতে রুপ নিয়েছিলঃ আমি কল্পনা করতাম যে আমি নিরাপদে আমার পানপাত্র হাতে নিয়ে যাচ্ছি একদল শত্রুর ভিড়ের মধ্য দিয়ে। অদ্ভুত সব প্রার্থনায় তাঁর নাম আমার ঠোঁটের ডগা কাঁপিয়ে তুলত, যা আমি নিজেও কি তা বুঝতাম না। প্রায়ই আমার দুচোখ জলে ভরে উঠত (আমি জানতাম না কেন), এবং কখনও কখনও মনে হত হৃদপিণ্ড থেকে একটা বানের স্রোত এসে আমার বুক ভাসিয়ে দিবে। আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব কমই ভাবতাম। আমি জানতাম না আদৌ আমি তাঁর সাথে কখনও কথা বলতে পারব কিনা; আর যদি পারিও, কিভাবে তাঁর কাছে আমি আমার গভীর দ্বিধান্বিত অনুভূতি প্রকাশ করব! কিন্তু আমার শরীরটা যেন একটা হার্প আর তাঁর কথা, অঙ্গভঙ্গিরা যেন আঙ্গুল হয়ে সে হার্প-এর তার গুলোয় সুর বাজিয়ে যায়!

এক সন্ধ্যায় আমি পেছনের ড্রয়িং রুমটায় গিয়েছিলাম যেখানে পাদ্রি মারা গিয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যাটা ছিল অন্ধকার বৃষ্টিস্নাত, বাড়িতে কোন শব্দ ছিল না, শুধুই শুনশান নীরবতা। জানালার ভাঙ্গা কাঁচের ভেতর দিয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম পৃথিবীর বুকে বৃষ্টির আঘাত হানার আওয়াজ, বৃষ্টি ফোঁটার সরু সুঁইগুলো বিরামহীন খেলে যাচ্ছিল মাটির সিক্ত বিছানায়। একটা দূরবর্তী বাতি অথবা আলোকিত জানালা জ্বল জ্বল করছিল আমাকে লক্ষ্য করেই। এইটুকু দেখতে পেরেই আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সবকটি ইন্দ্রিয় যেন আড়ালে গাঁ ঢাকা দিতে চাইছিল, এবং মনে হচ্ছিল যেন আমি তাঁদের কাছ থেকে ছিটকে সরে যাচ্ছি। আমি দুহাতের তালু একসাথে চেপে ধরে রাখলাম তাঁরা কেঁপে উঠার আগ পর্যন্ত। আমার ভেতর থেকে একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসলোঃ আহ প্রেম! আহ ভালোবাসা! অনেকবার।

অবশেষে একদিন সে কথা বলল আমার সাথে। যখন সে আমার দিকে প্রথম শব্দগুলো ছুড়ে দিল, আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি উত্তর দিব। সে জানতে চাইল আমি এরাবিতে যাচ্ছি কিনা। ভুলে গেছি সেদিন আমি উত্তরে কি বলেছিলাম।

‘এটা একটা জমকালো বাজার’, সে বলছিল। সে যেতে খুব আগ্রহী।

‘তাহলে কেন যাচ্ছ না?’ আমি জানতে চাইলাম।

কথা বলার ফাঁকে সে তাঁর হাতের কব্জির রূপালী ব্রেসলেটটা ঘুরাচ্ছিল। সে যেতে পারবে না, সে বলল, কারন ঐ সপ্তাহে তাঁর আশ্রমে একটা অনুষ্ঠান ছিল। তাঁর ভাই আর অন্য দুটি ছেলে ক্যাপ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিল, আমি একলা দাড়িয়ে ছিলাম রেলিং-এর ধাঁরে। সে আমার দিকে ঝুঁকে একটা গজাল নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। বিপরীত দিক থেকে আসা ল্যাম্পের আলোয় তাঁর ঘাড়ের শুভ্র রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তাঁর এলোমেলো চুল, রেলিং-এর উপরে রাখা তাঁর হাত। আলোটা পড়ছিল তাঁর জামার এক পাশে, দেখা যাচ্ছিল তাঁর পেটিকোটের সাদা বর্ডার। দেখা যাচ্ছিল তাঁর প্রশান্তিতে দাঁড়ানোর ভঙ্গি।

‘তুমি গেলে খুব ভালো হত’, সে বলল।

‘আমি যদি যাই’, বললাম আমি, ‘তোমার জন্য কিছু একটা নিয়ে আসবো’।

ঐ সন্ধ্যার পর কত আজগুবি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল আমার ঘুমে, আমার জাগরণে! ইচ্ছে করছিল মাঝখানের ক্লান্তিকর দিনগুলিকে মুছে ফেলি। স্কুলের কথা মনে আসতেই বিরক্ত লাগতো। রাতে শোবার ঘরে এবং দিনে ক্লাসরুমে তাঁর ছবিই ঘুরেফিরে ভেসে উঠত আমার আর জোর করে পড়ার চেষ্টা করা বইয়ের পাতার মাঝখানে। ‘এরাবি’ শব্দটার প্রতিটা বর্ণ আমায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল একটা গভীর নীরবতায় যেখানে আমার বিলাসী আত্মাটা আমাকে সম্মোহিত করে রেখেছিল। শনিবার রাতে আমি বাজারে যেতে ছুটি চাইলাম চাচীর কাছে। চাচী শুনে খুব বিস্মিত হলেন এবং ভাবলেন আমি যেন রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার না হই। ক্লাসে আমি কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম। আমি খেয়াল করছিলাম শিক্ষকের চেহারাটা ধীরে কোমল থেকে কঠিন হচ্ছে এবং তিনি আশা করছিলেন আমি যেন অলস না হয়ে যাই। আমি আমার এলোমেলো চিন্তাগুলোকে গোছাতে পারছিলামনা। জীবনের কোন গুরুতর কাজেই আমার ধৈর্য ছিলনা যা এখন আমার আর আমার ইচ্ছার মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনের এইসব কাজকে মনে হচ্ছিল ছেলেখেলা, কদাকার একগেয়ে ছেলেখেলা।

শনিবার সকালে আমি চাচাকে মনে করিয়ে দিলাম যে আমি সন্ধ্যায় বাজারে যাচ্ছি। চাচা হলের মুখে দাড়িয়ে কি যেন একটা ভাবছিল আর টুপির ব্রাশ খুঁজছিল। আমাকে সংক্ষেপে গা ছাড়া ভাবে উত্তর দিল,

‘হ্যাঁ, বেটা, আমি জানি’।

যেহেতু তিনি হলের ভেতরে ছিলেন তাই আমি জানালার পাশটায় যেতে পারছিলাম না মেয়েটাকে দেখতে। আমি মন খারাপ করে বাড়ি ছেড়ে স্কুলের দিকে হাটা শুরু করলাম। বাতাসটা ছিল নিষ্ঠুরভাবে কর্কশ এবং আমার হৃদপিণ্ডটা ইতিমধ্যেই শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যখন ডিনারে গেলাম তখনো চাচা ফেরেনি। তখনো হাতে বেশ সময় ছিল। বসে বসে ঘড়িটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম, ঘড়িটার টিক টিক শব্দে বিরক্তি ধরে গিয়েছিল। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। সিঁড়ি ভেঙ্গে বাড়ির উপরের তলাটায় গেলাম। সেখানকার ঠাণ্ডা, খালি, অন্ধকার ঘর গুলো আমাকে মুক্তি দিল। আমি গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে এ ঘর থেকে ও ঘরে ঘুরতে থাকলাম। সামনের জানলাটা দিয়ে দেখলাম আমার সঙ্গী সাথীরা রাস্তার উপর খেলছে। তাদের হৈ- হুল্লোড় এর অস্পষ্ট, ক্ষীণ আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসছিল। আমি জানালার শীতল কাঁচে কপালটা ঠেকিয়ে তাকিয়ে ছিলাম মেয়েটার অন্ধকার বাড়িটার দিকে। আমি বোধয় সেখানে ঘণ্টা খানেক এভাবে দাড়িয়ে ছিলাম, কিছুই দেখলাম না, শুধু কল্পনায় সেই বাদামী আলোকাবৃত্ত অবয়ব ছাড়াঃ ল্যাম্প লাইটের আলো আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁর ভাজ পরা কাঁধে, রেলিং এর উপরে রাখা হাতে আর জামার বর্ডারে।

যখন আবার নিচতলায় নেমে আসলাম, দেখলাম মিসেস মারসার আগুনের পাশে বসে আছে। তিনি একজন বয়স্ক, বাঁচাল কিছিমের বিধবা মহিলা। তাঁর স্বামী ছিল একজন মহাজন। তিনি কোন এক ধর্মীয় উদ্দেশ্যে পুরনো স্ট্যাম্প সংগ্রহ করতেন। চায়ের টেবিলে তাঁদের গাল গল্প আমাকে সহ্য করতে হয়েছিল। খাওয়ার সময়টা আরও ঘণ্টা খানেক দীর্ঘায়িত করা হয়েছিল, তখনো চাচা বাড়ি ফেরেনি। মিসেস মারসার চলে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ালেনঃ তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন যে তিনি আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারছেন না। আঁটটা বেজে গেছে। তিনি বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে চান না, কারন রাতের হাওয়াটা তাঁর সয় না। তিনি চলে যাওয়ার পর আমি আঙ্গুল মটকাতে মটকাতে ঘরের এপাশ ওপাশ ঘুরতে থাকলাম। চাচী আমায় বললেন,

‘আজ রাতে মনে হয় তোমার বাজারে না গেলেই ভালো হয়।’

রাত ন’টায় বাইরে হল ঘরের দরজায় চাচার চাবির আওয়াজ কানে আসলো। শুনতে পেলাম সে নিজের সাথে নিজে কথা বলছে, শুনতে পেলাম তাঁর রাখা ওভার কোটের ভারে স্ট্যান্ডটা দুলছে। এই আওয়াজ গুলো শুনেই আমি বুঝতে পারতাম কি হচ্ছে। চাচার খাওয়ার মাঝখানেই আমি তাঁর কাছে বাজারে যাওয়ার জন্যে টাকা চাইলাম। সে ব্যাপারটা ভুলে বসে আছে।

‘মানুষজন এখন বিছানায় এবং তাঁরা ইতিমধ্যেই এক দফা ঘুমিয়ে ফেলেছে’, তিনি বললেন।

আমি হাসতে পারলাম না। চাচী জোর গলায় চাচাকে বললেন,

‘তুমি টাকাটা দিয়ে তাঁকে বিদায় করনা কেন? তুমিই তো তাঁকে এতটা দেরি করালে’।

চাচা বিষয়টা ভুলে যাওয়ার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন যে তিনি ঐ পুরানো প্রবাদে বিশ্বাস করেন,

‘অল ওয়ার্ক এন্ড নো প্লে মেকস জ্যাক এ ডাল বয়।’

তিনি জানতে চাইলেন আমি কোথায় যাচ্ছি, যখন আমি দ্বিতীয়বারের মত তাঁকে বললাম, তখন তিনি জানতে চাইলেন আমি ‘দ্যা এরাবস ফেয়ারওয়েল টু হিজ স্টিড’ সম্পর্কে কিছু জানি কিনা। যখন আমি রান্নাঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লাম, চাচা ঐ বইয়ের শুরুর লাইন গুলি চাচীকে আবৃত্তি করে শুনানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

আমি হাতে একটা দুই শিলিং এর কয়েন শক্ত করে ধরেছিলাম যখন বাকিংহাম সড়কে বড় বড় পা ফেলে ষ্টেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। রাস্তায় ক্রেতাদের ভিড় আর চোখ ধাঁধানো আলো আমাকে মনে করিয়ে দিল আমার যাত্রার উদ্দেশ্য। আমি একটা বিচ্ছিন্ন ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীর বগিতে গিয়ে বসলাম। দেরি করতে করতে সহ্য সীমা অতিক্রমের পর ট্রেনটি ধীরে স্টেশন ত্যাগ করল। ট্রেনটা বিধ্বংস ঘরবাড়ি আর চকচকে নদীর উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে এগুচ্ছিল। ওয়েস্টল্যান্ড রো স্টেশনে একটা মানুষের জটলা এসে বগির দরজায় ধাক্কাচ্ছিল; কিন্তু দ্বাররক্ষীরা তাঁদেরকে পেছনে ঠেলে দিয়ে বলল যে এটা শধুমাত্র বাজারের জন্য বিশেষ ট্রেন। আমি ফাঁকা কামড়াটায় একলা বসে রইলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ট্রেনটা একটা কাঠের প্লাটফর্মের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। রাস্তায় নেমে একটা আলোকিত ঘড়িতে দেখলাম দশটা বাজতে এখনো দশ মিনিট বাকী। আমার সামনে দাড়িয়ে আছে বিশাল একটি ভবন যার গায়ে সেই যাদুময় নামটি দৃশ্যমান।

আমি ছয় পেনির কোন প্রবেশ দ্বার খুঁজে পাচ্ছিলাম না, ভঁয় পাচ্ছিলাম বাজার বন্ধ হয়ে গেল কিনা। দ্রুত একটা ঘূর্ণায়মান দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম, শ্রান্ত চেহারার একটা লোককে একটা শিলিং ধরিয়ে দিয়ে। ভেতরে ঢুকেই নিজেকে একটা বিশাল হল ঘরে আবিষ্কার করলাম। সব গুলো দোকানই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আর হল ঘরের বেশীরভাগ অংশই ছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত। আমি টের পেলাম এখানে একটা নীরবতা বিরাজ করছে যেমনটা করে চার্চে প্রার্থনার পর। আমি ভঁয়ে ভঁয়ে হেঁটে বাজারের কেন্দ্রে চলে গেলাম। খোলা দোকান গুলোর সামনে কিছু লোক তখনো ভিড় করছিল। একটা পর্দার উপরে রঙ্গিন বাতি দিয়ে লেখা ছিল ‘ক্যাফে চ্যানট্যাঁনট’ যেখানে দুটো লোক একটা সালভারের উপর পয়সা গুনছিল। আমি কয়েন গুলোর পতনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।

অনেক কষ্ট করে মনে করলাম আমি এখানে কেন এসেছি। একটা দোকানে গিয়ে কিছু চিনা মাটির ফুলদানি আর ফুল অঙ্কিত চায়ের কাপের সেট নেড়েচেড়ে দেখলাম। দোকানের দরজায় দাড়িয়ে একটা যুবতী মেয়ে দুটো যুবক ভদ্রলোকের সাথে কথা বলছিল আর হাসছিল। আমি তাঁদের ইংরেজির উচ্চারণ-ভঙ্গি লক্ষ্য করছিলাম এবং তাঁদের কথোপকথন অস্পষ্টভাবে শুনছিলাম।

‘না, আমি কখনই এমন কথা বলিনি।’
‘না না, কিন্তু তুমি তো বলেছ।’
‘না আমি বলিনি।’
‘সে (মেয়েটি) এ কথা বলেছিল না?’
‘হ্যা, আমি তাঁকে বলতে শুনেছি।’
‘হুম, এখানে একটা… কিন্তু আছে!’

আমাকে দেখে মেয়েটি এগিয়ে এসে জানতে চাইল আমি কিছু কিনতে চাই কিনা। তাঁর কণ্ঠে কোন উৎসাহ ছিলনা, মনে হচ্ছিল কোন রকম কর্তব্যের খাতিরে সে আমাকে জিজ্ঞেস করছে। দোকানের দরজার দুই দিকে অল্প আলোয় দণ্ডায়মান দুটি মাটির জারের উপর দৃষ্টি ফেলে আমি মিনমিনিয়ে বললামঃ

‘না। ধন্যবাদ আপনাকে।’

যুবতী মেয়েটি একটা ফুলদানির অবস্থান পরিবর্তন করে আবার সেই যুবক দুটির কাছে ফিরে গেল। তাঁরা আবার আগের বিষয় নিয়েই কথা বলা শুরু করল। মেয়েটি কথার ফাঁকে এক-দুবার তাঁর কাঁধের উপর দিয়ে চোখ ফেলেছিল আমার উপর। আমি দোকানটার সামনে কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘুরাঘুরি করলাম, যদিও জানতাম এখানে থাকাটা নিরর্থক। মনে হল তাঁর দোকানের পণ্য গুলির প্রতি আমার আকর্ষণটা ছিল সত্যি। আমি ঘুরে আস্তে করে বাজারের মধ্য দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। হাতে থাকা দুটি পেনি ছেড়ে দিলাম পকেটে থাকা ছয়টি পেনির ভিড়ে। গ্যালারির এক পাশ থেকে একজন চেঁচিয়ে বলল যে সব আলো নিভে যাবে। হল ঘরের উপরের অংশটা পুরোপুরি অন্ধকারে ডুবে গেছে।

অন্ধকারের দিকে চেয়ে থেকে আমি নিজেকে দেখতে পেলাম আত্ম অহংকারে তাড়িত ও উপহাস্য একটা জীব হিসেবে; এবং আমার চোখ দুটি জ্বালা করছিল নিদারুণ ক্ষোভে আর যন্ত্রনায়।

মূলঃ জেমস জয়েস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *