জানালার ধারে বসে সে দেখছিল এভিনিওতে সন্ধ্যা নামার দৃশ্যটা। তাঁর মাথাটা ঝুঁকে ছিল জানালার পর্দাগুলোর দিকে আর তাঁর নাসারন্ধ্রে লেগে ছিল ধূলিমলিন কাপড়ের গন্ধ। সে ছিল ক্লান্ত।
কয়েকটা লোক অতিক্রম করে গেল। সর্বশেষ কুঠি থেকে বের হওয়া লোকটাও রওয়ানা দিল বাড়ির দিকে; শান বাঁধানো রাস্তায় হেঁটে চলা লোকটার পায়ের খটখট আওয়াজ ভেসে আসছিল তাঁর কানে, পরক্ষণেই লোকটা লাল বাড়ি গুলোর সামনের কয়লা কাঠের রাস্তা ধরে কচকচ শব্দে এগুতে লাগলো। এক সময় সেখানটায় একটা মাঠ ছিল যেখানে তাঁরা প্রতি সন্ধ্যায় অন্য ছেলে মেয়েদের সাথে খেলা করত। তারপর বেলফাস্ট থেকে এক লোক এসে কিনে নিলো পুরো মাঠটা, বাড়ি বানালো তাঁর উপর— এই বাড়ি গুলো তাঁদের ছোট্ট বাদামি বাড়ি গুলোর মত নয় বরং চকচকে ছাদ ওয়ালা ইটের ইমারত। সে আর তাঁর ভাইবোন আর ডেবিন, ওয়াটার, ডান পরিবারের বাচ্চারা মিলে খেলা করত সেই মাঠে, সাথে আরও থাকত ছোট্ট বিকলাঙ্গ কয়েগ। আরনেষ্ট কখনো খেলত না, সে ছিল একটু বেশিই বয়:প্রাপ্ত। তাঁর বাবা প্রায়ই তাঁদেরকে একটা কালো লাঠি হাতে তাবড়ে বেড়াত, ছোট্ট কয়েগ সবসময়ই নজর রাখতো আর তাঁর বাবাকে আসতে দেখলেই আওয়াজ দিত। তবু মনে হত তখনি তাঁরা বরং বেশ সুখি ছিল। তাঁর বাবার স্বভাব তেমন খারাপ ছিল না; তাছাড়া তখন তাঁর মাও বেঁচে ছিলেন। সে কতকাল আগের কথা; সে আর তাঁর ভাইবোনেরা ইতিমধ্যেই বড় হয়ে উঠেছিল যখন তাঁদের মা মারা যান। টিজি ডানও মরে গিয়েছিল তখন, আর ওয়াটার পরিবারটা ফিরে গিয়েছিল ইংল্যান্ডে। সবকিছুই বদলে যায়। এখন সেও অন্যদের মত চলে যেতে বসেছে, ছেড়ে যাচ্ছে নিজের ঘর।
ঘর! সে রুমটায় ঘুরে ঘুরে নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো সবগুলো পরিচিত আসবাব আর জিনিসপত্র, যাদেরকে সপ্তাহে অন্তত একবার ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করত সে বছরের পর বছর আর ভাবত কোথা থেকে যে এত ধূলি ময়লা গুলো আসে। হয়তো আর কোনদিনই সে আর এই পরিচিত জিনসপত্র গুলো দেখতে পাবে না। অথচ কখনও সে স্বপ্নেও ভাবেনি তাঁদের সাথে তাঁর বিচ্ছেদের কোন সম্ভাবনা থাকতে পারে। আর এতগুলো বছরেও সে কোনদিন জানতে পারেনি ভাঙ্গা হারমোনিয়ামের উপরের দিকে দেয়ালটায় ঝুলে থাকা হলদে ছবির ঐ পাদ্রিটার নাম কি। পাদ্রি লোকটা ছিল তাঁর বাবার স্কুল-বন্ধু। যখনি তাঁর বাবা কোন অতিথিকে ছবিটা দেখাতো, তখন ছবিটা তাঁর হাতে দিতে দিতে গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলতঃ
“সে এখন মেলবোর্ণে আছে।“
সে চলে যেতে সম্মত হয়েছে, রাজি হয়েছে ছেড়ে যেতে নিজের ঘর। কাজটা কি ঠিক হল? প্রশ্নটার দুই দিকটাই সে সমভার করার চেষ্টা করলো। তাঁর এই ঘরে আশ্রয় ছিল, খাদ্য ছিল; ছিল তাঁরা যাদেরকে সে চিনে এসেছে সারাটি জীবন। অবশ্য তাঁকে কঠোর পরিশ্রম করতে হত, ঘরে আর ব্যাবসা দু’ জায়গাতেই। দোকানের ঐ লোকেরা কি বলবে তাঁকে নিয়ে, যখন জানতে পারবে সে একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে? বলবে মেয়েটা আসলে বোকা, হয়তো; তাঁর থাকার জায়গাটা এখন বিজ্ঞাপনে ভরে যাবে। মিস গাবান খুব খুশি হবে। মহিলাটার সবসময়ই একটা ঝাঁঝ ছিল তাঁর উপর, বিশেষ করে যখন লোকজন শুনতে পেত।
“মিস হিল, তুমি দেখতে পাচ্ছ না মহিলারা অপেক্ষা করছে?”
“একটু প্রাণবন্ত থাকো, মিস হিল, প্লিজ।“
দোকান থেকে বিদায় নিতে সে খুব একটা জল ঝরাবে না চোখে।
কিন্তু তাঁর অজানা দূরের দেশের বাড়িতে কোন কিছুই তো এমন থাকবে না। তখন সে হবে বিবাহিত, বিবাহিত এভেলিন। মানুষজন তাঁকে সম্মান দেখাবে। তাঁর সাথে এমন কোন আচরণ করা হবে না, যা তাঁর মায়ের সাথে করেছিল মানুষ। এমনকি এখনো, যদিও সে এখন উনিশের উপরে, মাঝে মাঝে তাঁর বাবার হিংস্রতায় নিজেকে অনিরাপদ মনে হয়। সে জানত তাঁর বাবার এই হিংস্রতাই তাঁর সকল শিহরণের মূল কারণ। যখন তাঁরা বেড়ে উঠছিল তাঁর বাবা কখনই তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাতো না, সর্বদা হ্যারি আর আরনেষ্টকে মাথায় তুলে রাখতো, কারণ সে ছিল একটা মেয়ে কিন্তু পরবর্তীতে লোকটা তাঁকে হুমকি-ধমকি দেয়া শুরু করল এবং তাঁর মরা মায়ের দোহাই দিয়ে বলতে লাগলো সে তাঁকে কি করত যদি তাঁর মা বেঁচে থাকতো। আর তাঁকে রক্ষা করার মত কেহই ছিল না। আরনেষ্ট ছিল মৃত, আর হ্যারি, যে কিনা গির্জায় সাজগোজের ব্যাবসা করত, সবসময়েই গ্রামের কোন এক কোনায় পড়ে থাকত। তাছাড়া, শনিবারের রাত গুলোতে টাকার জন্যে একগেয়ে তুচ্ছ তুমুল ঝগড়া গুলো তাঁকে অবর্ণনীয় ভাবে ক্লান্ত করে তুলেছিল। সে সর্বদাই তাঁর পারিশ্রমিকের পুরোটা দিয়ে দিত — সাত শিলিং — আর হ্যারি সবসময় যতটুকু পারে পাঠাত কিন্তু সমস্যাটা বাঁধত তাঁর বাবার কাছ থেকে টাকা বের করতে গিয়ে। তাঁর বাবা বলেছিল সে নাকি সব টাকা উড়িয়ে নষ্ট করে ফেলে, তাই তাঁর মাথা এতটা খারাপ হয়নি যে তাঁর কষ্টার্জিত টাকা মেয়েকে দিবে রাস্তায় উড়িয়ে নষ্ট করার জন্যে। আরও এমন অনেক কিছু বলত, যেহেতু শনিবারের রাত গুলোতে সে সাধারণত খারাপের চরমে পৌঁছে যেত। সবশেষে সে টাকাটা মেয়ের হাতে দিত আর জিজ্ঞেস করত রবিবারের ডিনার কেনার তাঁর কোন ইচ্ছা আছে কিনা। তারপর এভেলিন যত দ্রুত সম্ভব দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বাজারে যেত কেনাকাটা করতে, শক্ত হাতে কালো চামড়ার পার্সটা নিয়ে ভিড় ঠেলে নিজের রাস্তা বের করে সে এগুতে থাকত এবং সকল শর্ত বিধির চাপের মধ্যেই দেরি করে ফিরে আসতো বাড়িতে। বাড়ির সবকিছু ঠিকঠাক রাখতে গিয়ে তাঁকে করতে হত কঠোর পরিশ্রম, দেখতে হত তাঁর কাছে থাকা বাচ্চা দুটো ঠিকমত স্কুলে যাচ্ছে কিনা, নিয়মিত চারটে খেতে পাচ্ছে কিনা। এটা ছিল কঠোর পরিশ্রম — একটা কঠিন জীবন — কিন্তু এখন সে ছেড়ে যেতে বসেছে এই সব কিছুই। তাঁর কাছে এই জীবনটা পুরোপুরি অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হল না।
সে ফ্র্যাঙ্কের সাথে সম্পূর্ণ নতুন এক জীবনকে আবিষ্কার করতে যাচ্ছে। ফ্র্যাঙ্ক ছিল দয়ালু, পুরুষালী আর খোলা মনের মানুষ। সে ফ্র্যাঙ্কের হাত ধরে রাতের নৌকায় চড়ে পাড়ি জমাতে যাচ্ছে বুয়েনস আইরসে যেখানে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছে একটা ঘর, যে ঘরে সে হবে ফ্র্যাঙ্কের বিবাহিতা স্ত্রী। কত পরিষ্কার ভাবে এখনো মনে পড়ে ফ্র্যাঙ্কের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের দিনটার কথা; ফ্র্যাঙ্ক প্রধান সড়কটার পাশে একটা কুঠিতে লজিং থাকত, যেখানে সে মাঝে মাঝে যেত। মনে হচ্ছিল যেন এই তো সপ্তাহ খানেক আগের কথা। ফ্র্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে ছিল প্রবেশদ্বারটায়, তাঁর সুচালো ক্যাপটা ছিল মাথার পেছন দিকটায় ঠেলে দেয়া, চুলগুলো তাঁর তামাটে চেহারাটার উপর গড়াগড়ি খাচ্ছিল। তারপর চেনা জানা হল একে অপরের সাথে। ফ্র্যাঙ্ক প্রতি সন্ধ্যায় দোকানের বাইরে তাঁর সাথে দেখা করত এবং তাঁকে বাড়িতে পৌঁছে দিত। সে তাঁকে দ্যা বোহেমিয়ান গার্ল দেখতে নিয়ে যেত আর এভেলিন উল্লসিত বোধ করত যেহেতু সে ফ্র্যাঙ্কের সাথে থিয়েটারের অস্বাভাবিক অংশটায় বসত। ফ্র্যাঙ্ক ছিল ভয়ঙ্কর গান পাগলা এবং সে একটু আধটু গাইতও। মানুষ জানত যে তাঁরা একে অন্যের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে এবং, যখন ফ্র্যাঙ্ক বালিকা মেয়ের গানটা গাইত যাকে নাবিক ভালোবাসে, সে একটা সুখময় দ্বিধান্বিত অনুভবে ডুবে যেত। ফ্র্যাঙ্ক তাঁকে মজা করে পপেন্স নামে ডাকতো। প্রথমত একজন সঙ্গী পাওয়াটা তাঁর কাছে একটা উত্তেজনার বিষয় ছিল এবং তারপর তাঁকে তাঁর ভালো লাগতে শুরু করল। ফ্র্যাঙ্কের জীবনে দূর দেশের অনেক গল্প ছিল। এলান লাইনের কানাডাগামী জাহাজে সে প্রথম মাসিক এক পাউন্ড বেতনে ডেক বয় হিসেবে কাজ শুরু করেছিল। সে কত জাহাজে কত রকমের কাজ করেছে এই সব কিছু নিয়ে এভেলিনের সাথে গল্প করত। সে মাগেলান সাগরে পাড়ি জমিয়েছে এবং সে পেটাগনিয়ানদের ভয়ঙ্কর সব গল্প শোনাত তাঁকে। বুয়েনস আইরসে এসে সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিল, বলল সে, এবং সে তাঁর পুরনো দেশে ফিরে এসেছে শুধুমাত্র ছুটি কাটানোর জন্যে। অবশ্য, এভেলিনের বাবা তাঁদের সম্পর্কের কথাটা ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছিল এবং ফ্র্যাঙ্কের সাথে কোনরূপ যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করে দিয়েছিল।
“এই ধরনের নাবিক ছেলেদের আমার চেনা আছে।“ সে বলল।
একদিন সে ফ্র্যাঙ্কের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছিল এবং তারপর থেকে এভেলিনকে লুকিয়ে দেখা করতে হত ফ্র্যাঙ্কের সাথে।
এভিনিওতে সন্ধ্যাটা গাঢ় হয়ে আসছিল। তাঁর কোলের উপর রাখা দুটি চিঠির শুভ্রতাও ধীরে অস্পষ্ট হয়ে উঠছিল। একটা চিঠি হ্যারিকে লেখা; আরেকটা তাঁর বাবাকে। আরনেষ্টই তাঁর প্রিয় ছিল কিন্তু হ্যারিকেও সে পছন্দ করত। সে খেয়াল করল, সম্প্রতি তাঁর বাবা বুড়িয়ে যাচ্ছে; লোকটা তাঁকে মিস করবে। মাঝে মাঝে তাঁর বাবা খুব সুন্দর ব্যবহার করত। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন সে দিনের বেলায় ঘুমুতে গিয়েছিল, তখন তাঁর বাবা পাশে বসে ভূতের গল্প পড়ে শুনিয়েছিল, আর আগুনের পাশে বসে তাঁর জন্যে টোস্ট বানিয়েছিল। অন্য একদিন, যখন তাঁদের মা বেঁচে ছিলেন, সবাই মিলে তাঁরা পিকনিকে গিয়েছিল হাউথের পাহাড়ে। এখনো মনে পড়ে, তাঁর বাবা বাচ্চাদের হাসানোর জন্যে মায়ের মস্তকাবরণটা পড়িয়ে দিচ্ছিল।
তাঁর সময় ফুরিয়ে আসছিল কিন্তু সে জানালার পাশে বসেই রইল, জানালার পর্দা গুলোয় মাথাটা ঠেকিয়ে, তাঁর নিঃশ্বাসে মিশে ছিল ধূলিমলিন কাপড়ের গন্ধটা। এভিনিওর নিচে দূরে কোথাও থেকে তাঁর কানে ভেসে আসছিল স্ট্রিট অর্গানের সুর। সে অদ্ভুত বাতাসটাকে চিনত যেটা প্রতি রাতে এসে তাঁকে মনে করিয়ে দেয় মাকে দেয়া তাঁর প্রতিজ্ঞা গুলোর কথা, যেখানে সে মাকে বলেছিল ঘরটাকে সে আগলে রাখবে যতদিন সম্ভব। তাঁর মনে পড়ল মায়ের অসুস্থতার শেষ দিনটার কথা; সে আবারো হলের অপর পাশের সেই অন্ধকার বদ্ধ ঘরটায় ছিল এবং শুনতে পাচ্ছিল ইতালির বাতাসে একটা বিষণ্ণ সুর। অরগান-প্লেয়ারটাকে ছ-পেনির পয়সা ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতে বলা হয়েছিল। তাঁর মনে পড়ল, তাঁর বাবা সদর্পে সিক-রুমে ঢুকে বলছিলঃ
“হারামজাদা ইতালিয়ান! আসছে এখানে!”
যেহেতু সে ডুবে গিয়েছিল ধ্যানে, তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল মায়ের করুন জীবন চিত্রটা, যার আবেশ খুব দ্রুত তাঁর পুরো সত্ত্বাটাকে সম্মোহিত করে ফেলেছিল — গতানুগতিক সাধারণ জীবন তাঁর সবকিছুই ত্যাগ করে দেয় শেষ পাগলামিতে। সে কেঁপে উঠলো আবারো তাঁর মায়ের গলার আওয়াজ শুনে, তাঁর আবিরাম একগুঁয়ে অর্থহীন আওড়ানো বুলি শুনেঃ
“দেরেভুয়ান সেরাউন! দেরেভুয়ান সেরাউন!”
সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল একটা আতঙ্কের তাড়নায়। পালাও! তাঁকে যে পালাতে হবে! ফ্র্যাঙ্ক থাকলে এখন তাঁকে রক্ষা করত। ফ্র্যাঙ্ক তাঁর জীবনটা ফিরিয়ে দিত, হয়তো একটু ভালবাসাও দিত। কিন্তু সে তো বাঁচতে চেয়েছে। তাঁকে কেন অসুখি হতে হবে? তাঁরও তো সুখে একটু অধিকার রয়েছে। ফ্র্যাঙ্ক তাঁকে এখন বুকে টেনে নিত, আগলে রাখতো তাঁর দু’ বাহুতে। সে তাঁকে বাঁচাত।
নর্থ ওয়ালের স্টেশনে প্রবল ভিড়ের মধ্যে সে দাঁড়িয়েছিল। ফ্র্যাঙ্ক তাঁর হাতটা ধরেছিল এবং সে জানত ফ্র্যাঙ্ক তাঁর উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলছে, প্যাসেজ সম্পর্কে কিছু একটা বার বার বলেই যাচ্ছে। বাদামী ব্যাগেজ ওয়ালা সৈনিকে ভরে গিয়েছিল পুরো স্টেশনটা। ইঞ্জিনশালার প্রশস্ত দরজা গুলো দিয়ে সে কালো নৌকাটা এক পলক দেখল, নৌকাটা শুয়ে আছে ঘাটের দেয়ালটার পাশে তাঁর আলোক উজ্জ্বল জানালা গুলো নিয়ে। সে কোন উত্তর দিল না। সে অনুভব করল তাঁর গালটা বিবর্ণ শীতল হয়ে উঠছিল, এবং প্রবল মানসিক চাপে সে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করল তাঁকে পথ দেখাতে, সে চাইল ঈশ্বর যেন বলে দেয় তাঁর কি করা উচিত। নৌকাটা একটা দীর্ঘ শোকাবহ হুইশেলের আওয়াজ ছুড়ে দিল কুয়াশায়। যদি সে যেতো, তাহলে আগামীকাল সে ফ্র্যাঙ্কের সাথে সাগরে ভেসে ভুয়েনস আইরসের দিকে এগুত। তাঁদের প্যাসেজ ইতিমধ্যেই সংরক্ষিত হয়ে গিয়েছিল। এত কিছুর পরেও কি সে এখন ফিরে যেতে পারবে? তাঁর এই প্রবল সঙ্কট পুরো শরীরে একটা ঘৃণার জাগরণ সৃষ্টি করল এবং তাঁর ঠোঁট গুলো কাঁপতে লাগলো নীরব আকুল প্রার্থনায়।
তাঁর হৃদপিণ্ডে একটা বেল ঝনঝন করে উঠলো। সে টের পেল ফ্র্যাঙ্ক তাঁর হাতটা চেপে ধরেছেঃ
“আসো!”
পৃথিবীর সবকটি সাগর যেন গড়াগড়ি খেল তাঁর হৃদপিণ্ডের আশে পাশে। ফ্র্যাঙ্ক তাঁকে সেই সাগর গুলোয় টেনে নিয়ে যাচ্ছিলঃ সে তাঁকে ডুবিয়ে মারবে। সে দু’ হাতে শক্ত করে চেপে ধরল লোহার রেলিঙটা।
“আসো!”
না! না! না! এটা ছিল অসম্ভব। তাঁর হাত দুটো উম্মত্ত থাবায় আঁকড়ে ধরল লোহাটাকে। সমুদ্র গুলোর বুকে সে একটা চিৎকারের আওয়াজ ছুড়ে দিল যন্ত্রণায় আর ক্ষোভে।
“এভেলিন! এভি!”
ফ্র্যাঙ্ক দৌড়ে ব্যারিয়ার পাড় হয়ে গেল এবং তাঁকে ডেকে বলল অনুসরণ করতে। সে চিৎকার করছিল নৌকা না থামাতে কিন্তু তবুও সে এভেলিনকে ডাকছিল। এভেলিন তাঁর শুভ্র মুখটাকে তাঁর দিকে তাক করে রাখল, অসাড়, একটা অসহায় প্রাণীর মত। তাঁর চোখে ফ্র্যাঙ্কের জন্যে কোন ভালোবাসা ছিল না, ছিল না কোন বিদায়ের অথবা পরিচয়ের চিহ্ন।