দূরে গলিটার শেষ মাথায় বাচ্চা মেয়েগুলোর সাথে সে খেলছিলো। চালির ভিতরে আনাচে-কানাচে তাঁর মা তাঁকে পাগলের মতো করে খুঁজলো। কিশোরী তাঁদের ঘরে বসে অপেক্ষা করছিলো, কেউ একজন তাঁর জন্যে চা আনতে গেছে। সারিতার মা এখন চালির পুরো তিনটা তলাতেই সারিতাকে খোঁজা শুরু করে দিলো। কে জানে, সারিতা কোন খুপরিতে গিয়ে মরে পড়ে আছে? সে এমনকি গোসলখানা গুলোতেও গিয়ে চিৎকার করে ডাকলো, ‘সারিতা……সারিতা!’ কিন্তু সারিতা যে চালির ভিতরে নেই, ইতোমধ্যেই তাঁর মা এটা অনুধাবন করতে শুরু করলো। চালির বাহিরে গলির মাথায় একটা ময়লার গাদার পাশে সারিতা বাচ্চা মেয়েগুলোর সাথে খেলেই যাচ্ছিলো, পুরোপুরি ভাবনাহীন।
তাঁর মা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। কিশোরী ঘরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। তাঁর দেয়া কথা অনুসারে সে দু’জন মোটর গাড়িওয়ালা ধনী লোককে সাথে নিয়ে এসেছে। লোক দুটো মোটর গাড়ি সহ বাজারে অপেক্ষা করছিলো; কিন্তু মেয়েটা কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো? সে এখন আর আমাশয়ের অজুহাতটাও ব্যবহার করতে পারবে না; এখন সে সুস্থ। আর মোটর গাড়িওয়ালা ধনী ভদ্রলোকরা তো প্রতিদিন আসে না। কিশোরীর বদান্যতায় মাসে দু’একবার মোটর গাড়িওয়ালা মক্কেলরা আসে। পান আর পাতার বিড়ির মিশ্র গন্ধে ভেসে যাওয়া পাড়া গুলোতে আসতে সাধারণত কিশোরী অস্বস্তি বোধ করে। ধনী লোকদের এমন জায়গায় আনা যায় নাকি? কিন্তু যেহেতু কিশোরী অনেক বুদ্ধিমান, তাই সে কখনই লোকদেরকে চালির ভেতরে নিয়ে আসেনি। বরং উল্টো সে সারিতাকে গোসল করিয়ে, কাপড় পড়িয়ে তাঁদের কাছে নিয়ে গেছে। আর তাঁদেরকে বলেছে, “এখন সময়টা বড় খারাপ; জায়গাটার চারিদিকে পুলিশের আনাগোনা; তাঁরা প্রায় শ’খানেক মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে; এমনকি কোর্টে আমার নামে একটা মামলাও আছে, ব্যবসাপাতি একটু সাবধানে করা ভালো।”
এতক্ষণে সারিতার মায়ের রাগ চরমে উঠে গেছে। সে যখন নিচে নামছিলো, সিঁড়ির গোঁড়ায় বসে রামদি বরাবরের মতই বিড়ির পাতা কাটছিলো। “সারিতাকে দেখেছো কোথাও?” সারিতার মা কান্দা-কাটি করতে লাগলো, “ভগবান জানেন, কোন খুপরিতে গিয়ে মেয়েটা মরে পড়ে আছে। আর এতদিন থাকতে, আজকেই! দাঁড়াও, তাঁকে আগে খুঁজে পাই। এমন মার দেবো যে শরীরের প্রতিটা জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা লেগে থাকবে। ধাড়ি মেয়ে, অথচ দেখো শুধু বাচ্চাদের সাথে ঘুরেফিরে সে দিনটা নষ্ট করে।”
রামদি কিছু না বলে এক মনে বিড়ির পাতা কাটতে লাগলো। কিন্তু সারিতার মা আসলে রামদির সাথে কথা বলছিলো না; সে শুধু এদিক দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় অভ্যাসবশত অর্থহীন উচ্চবাচ্চ্য করছিলো।
কিছুদিন পরপরই সে সারিতাকে এভাবে খুঁজে বেড়ায়, আর রামদির কাছে এসে একই শব্দগুলো পুনরায় আওড়ায়।
সারিতার মা চালির সব মহিলাদেরকে বলে বেড়াতো যে, সে এক সময় সারিতাকে একজন কেরানীর সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। এ জন্যেই সে সবসময় সারিতার শিক্ষাদীক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলো। কাছেই পৌরসভা একটা পাঠশালা খুলেছিলো, আর সারিতার মা মেয়েকে সেখানে ভর্তি করানোর কথা মনে মনে ভেবেছিলো। “বুবু, জানো, মেয়ের বাপের বড় স্বাদ ছিলো মেয়েকে লেখাপড়া শিখাবে!” এই কথা বলেই সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তো, এবং তাঁর মৃত স্বামীর গল্পটা আবার পুনরাবৃত্তি করতো, যে গল্প বারবার শুনতে শুনতে দালানের প্রতিটা মহিলার প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। যদি রামদিকে তোমার বলতে হতো, “আচ্ছা, সারিতার বাবা রেলওয়েতে চাকরি করার সময় যখন বড় সাহেব তাঁকে অপমান করেছিলো, কি ঘটেছিলো তখন? প্রশ্নটা করে সে নিজেই তাৎক্ষনিক উত্তরটা দিয়ে দিতো, ‘সারিতার বাবা মুখের উপর ফুঁসে উঠেছিলো, আর সাহেবকে বলেছিলো, “আমি তোমার চাকর নই, আমি সরকারের চাকর। এখানে এসে প্রভাব খাটানোর কোন অধিকার তোমার নেই। এবং সাবধান— ফের যদি আমাকে অপমান করেছো তো তোমার মাড়ি উপড়ে নিয়ে সেগুলো তোমার গলায় ঠেসে দোবো।” তারপর, কি ঘটলো? যা ঘটার তাই ঘটলো! সাহেব ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো, এবং সারিতার বাবাকে আবারো অপমান করলো। সারিতার বাবা সামনে এগিয়ে এসে সাহেবের ঘাড়ে সজোরে এমন এক ঘা মারলো যে সাহেবের মাথার হ্যাট মাথা থেকে উড়ে চলে গেলো। আর সাহেব ছিটকে দশ হাত দূরে গিয়ে পড়লো, এবং দিনের বেলাতেই সে চক্ষে তারা দেখলো! কিন্তু সেই সাহেব বেটাও কম ছিলো না। সেও তাঁর পায়ের আর্মি বুট দিয়ে সারিতার বাবার পিঠে একটা লাথি কষে দিলো। তারপর সেখানেই, রেলওয়ে লাইনের পাশে পড়ে গিয়ে সারিতার বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। সরকার সাহেবের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছিলো এবং সারিতার মায়ের জন্যে সাহেবের কাছ থেকে পাঁচশ রুপি ক্ষতিপূরণও আদায় করেছিলো। কিন্তু সারিতার মায়ের ভাগ্যটাই ছিলো খারাপ। তাঁর মন গেলো লটারির দিকে, এবং পাঁচ মাসের মধ্যে পুরো টাকাটাই সে অপব্যয় করে খোয়ালো।”
এই গল্পটা সারিতার মায়ের ঠোঁটের আগায় সবসময় তৈরি থাকতো, কিন্তু কেউই নিশ্চিত জানতো না গল্পটা আদৌ সত্য ছিলো কিনা। কোনক্রমেই, এই গল্প দালানের কারো মনে সারিতার মায়ের জন্যে কোন প্রকার করুণা জাগাতো না, কারণ হয়তো করুণাটা ছিলো সেখানকার সবারই প্রাপ্য। এবং সেখানে কেউই কারো বন্ধু ছিলো না। বেশীরভাগ পুরুষই দিনের বেলা ঘুমাতো, আর রাত জেগে পাশের মিলে রাতের শিফটে কাজ করতো। তাঁরা একসাথে বাস করতো ঠিকই, কিন্তু কেউই সেখানে কারো জীবনের প্রতি কোন প্রকার আগ্রহ দেখাতো না।
বস্তুত, চালির সবাই জানতো যে সারিতার মা তাঁর বাচ্চা মেয়েটাকে বেশ্যাবৃত্তিতে পাঠিয়েছে। কিন্তু যেহেতু এই মানুষগুলো একে অন্যের প্রতি খারাপ অথবা ভালো কোন প্রকার আচরণই করতো না, তাই সারিতার মায়ের মুখোশ খুলে দেওয়ার কোন দরকারই তাঁরা অনুভব করেনি, যখন সে বলতো, “আমার মেয়েটা এখনো দিন-দুনিয়ার কিছুই জানে না।”
একদিন সকালে, টুকারাম যখন সারিতার জন্যে বায়না করে বসলো, সারিতার মা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলো, “ভগবানের দোহাই, এই বদমাশ টেকো লোকটাকে কেন কেউ সামাল দিচ্ছে না? ভগবান যেন তাঁর চোখ দুটো অন্ধ করে দেয়, যে চোখ দিয়ে সে আমার কুমারী মেয়েটার দিকে কুনজর দিয়েছে! আমি দিব্যি দিয়ে বলছি, একদিন, তোর সাথে আমার এমন অগ্নিকাণ্ড বাঁধবে যে আমি তোর ওই জিনিসটাকে টেনে বের করে এনে আমার জুতোর গোড়ালি দিয়ে এটার মাথাটাকে পিষবো। বাহিরে, সে যা খুশি তা করুক গে, কিন্তু এইখানে বাপু সভ্য মানুষের মত আচরণ করতে হবে, কি বলছি শুনতে পাচ্ছ?”
এই কথা শুনে, টুকারামের ট্যারা চোখের স্ত্রী ধূতিতে গিট দিতে দিতে এগিয়ে আসলো। “তুই ডাইনী মাগী, আর একটা শব্দও যেন তোর ওই ঠোঁট থেকে না বেরোয়! তোর ওই কুমারী মেয়ে হোটেলের আশেপাশে ঘুরঘুর করা ছেলেগুলোর দিকেও নজর দেয়……কি মনে করিস তুই, আমরা সব কানা? তুই মনে করিস তোর ঘরে কেরানীদের আসা যাওয়ার কথা আমরা জানিনা? এই যে তোর মেয়ে, সারিতা, কেন সে এত সাজগোজ করে বাইরে যায়? সত্যিই তোর সাহস আছে বলতে হয়, কিছু বায়বীয় সম্মান নিয়ে এখানে এসে বাসা বেঁধেছিস। যা ভাগ, দূর হ, যা!’
টুকারামের ট্যারা চোখের স্ত্রী সম্পর্কে অনেক বিখ্যাত মুখরোচক গল্প প্রচলিত ছিলো। প্রত্যেকেই জানতো, কেরোসিন তেলের ডিলার যখন আসে, ট্যারা চোখের মহিলা তাঁকে তখন নিজের কোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে দরজায় খিল লাগিয়ে দেয়। এই ব্যাপারটার দিকে মনযোগ টেনে নেয়াটা সারিতার মায়ের খুব পছন্দের। ঘৃণায় উথলে উঠা গলায় সে পুনরাবৃত্তি করে, “আর তোমার নাগর, ওই যে কেরোসিন তেলের ডিলার……প্রতিবার দুই ঘণ্টা ধরে তোমার কোয়ার্টারে নিয়ে খিল দিয়ে রাখো, কি করো তুমি তাঁর সাথে? তাঁর কেরোসিনের গন্ধ শুঁকো?”
টুকারামের বউ আর সারিতার মায়ের মধ্যকার ঝগড়াগুলো কখনই দীর্ঘস্থায়ী হতো না, কারণ এক রাতে সারিতার মা তাঁকে ঘোর অন্ধকারে একজনের সাথে ঠাট্টা তামাশা করা অবস্থায় ধরে ফেলেছে। এবং ঠিক তাঁর পরের রাতেই, টুকারামের বউ সারিতাকে ‘এক ভদ্রলোক’ এর সাথে মোটর গাড়িতে দেখে ফেলেছে। ফল স্বরূপ, দুই মহিলাই নিজেদের মধ্যে একটা চুক্তি করে নিয়েছে, আর এই জন্যেই এখন সারিতার মা টুকারামের বউকে বললো, “সারিতাকে দেখেছো কোথাও?”
টুকারামের বউ তাঁর ট্যারা চোখ গুলো রাস্তার কোনার দিকে ঘুরালো, “ওখানে, ময়লার গাদার কাছে। ম্যানেজারের মেয়েদের সাথে সে খেলা করছে।” তারপর সে নিচু গলায় বললো, “কিশোরী মাত্র উপরের তলায় গেলো। তুমি কি তাঁকে দেখেছিলে?”
সারিতার মা আশেপাশে একটু চোখ বুলিয়ে নিচু গলায় বললো, “কিশোরী ঘরে বসে আছে……কিন্তু এই রকম সময় গুলোতে সারিতাকে কখনই খোঁজে পাওয়া যায় না।” তাঁর মনে হয় না যে সারিতা কিছুই বোঝে না, “মেয়েটার একটাই কাজ— এদিক ওদিক ঘুরেফিরে দিনটাকে পার করে দেয়া।” এই কথা বলেই সারিতার মা ময়লার গাদার দিকে হাঁটা শুরু করলো। মাকে পাকা প্রস্রাবখানার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সারিতা লাফিয়ে উঠলো, প্রাণোচ্ছল হাসির ছায়াটা ধীরে সরে যাচ্ছিলো তাঁর চোখ থেকে……। তাঁর মা শক্ত হাতে তাঁর বাহু আঁকড়ে ধরে বললো, “আয়, বাড়ির ভিতরে আয়, আয়, আজকে তোর মরণ আছে…তুই কি এইসব উচ্ছৃঙ্খল খেলা ছাড়া আর ভালো কিছু করার পাস না?” যেতে যেতে নরম গলায় সে বললো, “কিশোরী এসছে। সে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। সে মোটর গাড়িওয়ালা লোক নিয়ে এসছে। যা, দৌড়ে উপরের তলায় যা, কাপড়-চোপড় পড়ে নে। আর তোর ওই নীল জর্জেট শাড়িটা পড়বি। ওহ আর শোন, তোর চুলের যা অবস্থা, তাড়াতাড়ি কাপড় পড়ে নে, আমি উপরে এসে তোর চুল আঁচরে দেবো।”
ধনী লোকজন মোটর গাড়ি নিয়ে তাঁর জন্যে এসেছে এই কথা শুনে সারিতা খুব খুশী হলো। মোটর গাড়িতে চড়া লোকদের চেয়ে সারিতার আগ্রহটা বরং মোটর গাড়ির প্রতিই বেশী ছিলো। মোটর গাড়িতে চড়তে সে খুব ভালোবাসে। যখন গাড়িটা গড়গড় শব্দে খোলা রাস্তায় গিয়ে নামে আর ঝড়ো হাওয়া এসে তাঁর মুখে বারি খায়, তারপর সবকিছুকে একটা ঘূর্ণিপাকের মত লাগে এবং তাঁর মনে হয় যেন একটা টর্নেডো এসে খালি রাস্তা গুলোর উপর আছড়ে পড়ছে।
সারিতার বয়স পনেরোর বেশী ছিলো না। কিন্তু তাঁর কৌতূহলগুলো ছিলো একটা তের বছরের মেয়ের মত। প্রাপ্ত বয়স্কা মহিলাদের সাথে সময় কাটাতে তাঁর একদমই ভালো লাগতো না। তাঁর পুরো দিনটাই কেটে গেলো বাচ্চা মেয়েগুলোর সাথে তুচ্ছ খেলাধুলায় মেতে থেকে। বাচ্চাগুলো বিশেষ করে রাস্তার কালো পিচের গায়ে চকের লাইন আঁকিবুঁকি করাটাকে বেশ উপভোগ করেছিলো, এবং এই খেলায় তাঁরা এতটাই ডুবে গিয়েছিলো যে কেউ দেখলেই মনে করবে, তাঁদের এই আঁকাবাঁকা লাইনের উপর বোধয় রাস্তার ট্রাফিক চলাচল নির্ভর করে। মাঝে মাঝে সারিতা তাঁর ঘর থেকে পুরনো বস্তার কাপড়ের টুকরো বাহিরে নিয়ে আসতো। আর সে এবং তাঁর ছোট্ট বন্ধুরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই বস্তার কাপড়ের টুকরো গুলোর ধূলি ঝেড়ে রাস্তার উপরে বিছিয়ে সেখানে বসার একঘেয়ে কাজে মগ্ন হয়ে ডুবে থাকতো।
সারিতা সুন্দরি ছিলো না। তাঁর গায়ের রঙ্গটা ছিলো একটা কৃষ্ণকায় গমের মতই কালো, বোম্বের আর্দ্র আবহাওয়ায় তাঁর চামড়াটা হয়ে উঠেছিলো চকচকে মসৃণ। সবেদা ফলের চামড়ার মত তাঁর পাতলা ঠোঁট দুটোও ছিলো কালচে, সবসময় একটা মৃদু কম্পন সেখানে লেগেই থাকতো, এবং কয়েকটা ঘামের বিন্দু তাঁর উপরের ঠোঁটে তিরতির করে কাঁপতো। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করা সত্বেও তাঁকে বেশ স্বাস্থ্যবান দেখাতো; তাঁর শরীরটা ছিলো খর্বকায়, নান্দনিক আর সুসমঁজস। তাঁকে দেখলে মনে হতো তাঁর যৌবনের পুরো জীবনীশক্তিটা যেন সবকটি বিরুদ্ধ শক্তিকে দমিত করে রেখেছে। যখনই ধমকা হাওয়া এসে তাঁর পরনের মলিন স্কার্টটাকে উপরে উঠিয়ে দিতো, রাস্তার লোকজন তাঁর কচি উরু গুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। যৌবন যেন তাঁদের উপর একটা মসৃণ সেগুন কাঠের উজ্জ্বল আভা এনে অর্পণ করেছে। তাঁর লোম বিহীন উরু গুলোতে ছোট ছোট কিছু দাগ ছিলো যা দেখলে মনে হতো যেন রসালো ক্ষুদ্র কমলার সূক্ষ্মরন্ধ্র, হালকা চাপেই ঝর্নার মত ফেটে পড়বে।
তাঁর বাহু দুটো ছিলো খুবই নান্দনিক। পরনের ঢলঢলে, বাজে সেলাইকৃত ব্লাউজের ভিতর দিয়ে তাঁর স্কন্ধের আকর্ষণীয় বর্তুলতাটা দেখা যাচ্ছিলো। তাঁর ছিলো ঘন আর দীর্ঘ কেশ, সবসময় সেখান থেকে নারিকেল তেলের গন্ধ বেরোতো। চাবুকের মত শক্ত বেণীটা তাঁর পিঠের উপর এসে চাপড় মারতো। কিন্তু তাঁর এই লম্বা চুলগুলো তাঁর বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, কারণ খেলার মাঝখানে এগুলো সামনে এসে ঝুলে থাকতো, তাই চুল গুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার বিভিন্ন পন্থা সে আবিষ্কার করেছিলো।
সারিতা ছিলো সকল প্রকার উদ্বিগ্নতা আর দুশ্চিন্তার ঊর্ধ্বে। দিনে দুবেলা খাবার তাঁর ভালোভাবেই জুটে যেতো। তাঁর মা বাড়ির সকল কাজকর্ম পরিচালনা করতো। সারিতার কাজ ছিলো প্রতিদিন সকালে বালতিতে পানি ভরে সেগুলো ঘরের ভিতরে নিয়ে আসা; আর প্রতি সন্ধ্যায় সে এক পয়সা দামের তেল দিয়ে ঘরের বাতিটা ভরে দেয়া। সন্ধ্যা নামলেই অভ্যাসবশত টাকা রাখা কৌটাটার দিকে তাঁর হাতটা চলে যেতো, আর বাতিটা হাতে নিয়ে সে ছুটতো নিচতলার দিকে।
কিশোরীর আয়োজনে প্রতি মাসে চার অথবা পাঁচবার ধনী লোকদের সাথে বিভিন্ন হোটেল আর আলো-আধারি জায়গা গুলোতে আসা-যাওয়া করাটাকে সারিতা প্রমোদ-ভ্রমণ হিসেবে দেখতো। এসব প্রমোদ-ভ্রমণ গুলোর অন্য দৃশ্যপট নিয়ে সে কখনই কিছু ভাবতো না। এমনকি সারিতা বিশ্বাস করতো যে কিশোরী হয়তো অন্য মেয়েদের বাড়িতেও এভাবে আসে এবং অন্য মেয়ে গুলোও ধনী লোকদের সাথে বাহিরে ঘুরতে যায়। এবং ওয়ারলির বেঞ্চে আর জুহুরের ভেজা বেলাভূমিতে সারিতার সাথে যা ঘটেছিলো, তা হয়তো অন্য মেয়েদের সাথেও হরহামেশা ঘটে থাকে। একদিন একটা উপলক্ষে সারিতা তাঁর মাকে বলেও ছিলো, “মা, শান্তা এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে। তাঁকেও কেন আমার সাথে পাঠাও না? ধনী লোক গুলো শুধুমাত্র ডিম খাওয়ানোর জন্যে আমাকে নিতে আসে, আর শান্তা তো ডিম খুব ভালোবাসে।” সারিতার মা মাঝখানেই প্রশ্নটাকে থামিয়ে দিয়েছিলো। “হ্যাঁ, হ্যাঁ, শান্তাকে একদিন আমি তোর সাথে পাঠাবো। আগে তাঁর মাকে পুন থেকে ফিরতে দিবি তো, নাকি?” পরের দিনই শান্তাকে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে সারিতা তাঁর কাছে এই সুসংবাদটা সম্প্রচার করে দিয়েছিলো। “তোমার মা যখন পুন থেকে ফিরবে, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমিও আমার সাথে ওয়ারলিতে যাবে!” সারিতা এমনভাবে তাঁর রাতের কার্যকলাপের বিবরণ দেওয়া শুরু করতো যেন সে একটা সুন্দর স্বপ্নে পুনর্যাপন করছিলো। সারিতার চেয়ে দুই বছরের ছোট শান্তা যখন সারিতার কথা গুলো শুনতো, তাঁর শরীরের মধ্য দিয়ে ছোট্ট একটা ঘণ্টার সুর বেজে যেতো। এমনকি সারিতার সব কথা শোনার পরেও তাঁর কথা শোনার স্বাদ মিটতো না। সে সারিতার বাহু আঁকড়ে ধরে বলতো, “চলো, নিচতলায় যাই, সেখানে কথা বলা যাবে।” সেখানে, প্রসাবখানাটার কাছে, যেখানে সওদাগর গিরিধারি চটের বস্তার উপরে ময়লা নারকেলের খোসা গুলো রোদে শুকাতে দিয়েছে, মেয়ে দুটো রাত অবধি উত্তেজনাপূর্ণ গল্পে মেতে থাকতো।
এখন, একটা অস্থায়ী পর্দার পেছনে জর্জেট শাড়িটা পড়ার সময়, কাপড়টা সুড়সুড়ি দিচ্ছিলো তাঁর শরীরের চামড়ায় আর চিন্তায়, মোটর গাড়িতে চড়ার চিন্তাটা ঠিক একটি পাখি হয়ে ঝাপটানো পাখায় তাঁর মনটাকে অস্থির করে তুলেছিলো। এইবারের ধনী লোকগুলো কেমন হবে; তাঁরা কোথায় নিয়ে যাবে তাঁকে? এইসব, এবং এমন আরও যত প্রশ্ন আছে তাঁর কোনটাই প্রবেশ করলো না তাঁর মনে। বরং মোটর গাড়িটা মাত্র অল্প কয়েক মিনিট চলেই কোন একটা হোটেলের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে কিনা এই নিয়ে সে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। হোটেলের চার দেয়ালের ঘর গুলোয় বন্ধী হয়ে থাকতে তাঁর একদমই ভালো লাগতো না, দুটো লোহার বিছানা, যেখানে সে চাইলেও ঘুমিয়ে পড়তে পারতো না।
জর্জেট শাড়িটা পড়ার পর হাত দিয়ে কাপড়ের কুঞ্চন গুলো মসৃণ করতে করতে সারিতা কিশোরীর সামনে এসে এক মুহূর্তের জন্যে দাঁড়ালো। “দেখো তো, কিশোরী, পেছন দিকে কাপড়টা ঠিক আছে, না?” উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে জাপানী পাউডার আর রুজ রাখা ভাঙ্গা কাঠের সুটকেসটার দিকে এগিয়ে গেলো। একটা ধুলাচ্ছন্ন আয়না হাতে নিয়ে, জানালার রডের চিপায় আয়ানাটাকে গোঁজে দিয়ে, রুজ আর পাউডারের একটু মিশ্রণ হাতে নিয়ে গালে মাখতে লাগলো। যখন সে পুরোপুরি তৈরি, কিশোরীর দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলো, চোখে তাঁর প্রশংসা পাওয়ার আকুলতা।
দিওয়ালির সময় খেলনার দোকান গুলোতে কাদামাটির কিছু রঙ্গিন পুতুল সাজিয়ে রাখা হতো; সারিতাকে তাঁর উজ্জ্বল নীল শাড়িতে, ঠোঁটে লেপটে থাকা লিপস্টিক আর কালো গাল গুলোয় মাখা গোলাপি পাউডারে ওরকম একটা পুতুলের মতই লাগতো।
ইতোমধ্যে, সারিতার মা এসে গেলো। সে তাড়াহুড়ো করে সারিতার চুলটা আচরে দিয়ে বললো, “শোন, মেয়ে, লোকগুলোর সাথে সুন্দর করে কথা বলবি। আর তাঁরা যা করতে বলে তাই করবি। তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ লোক; মোটর গাড়িতে করে এসেছে।” তারপর কিশোরীকে উদ্দেশ্য করে সে বললো, “এখন, তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে যাও ওদের কাছে। বেচারা লোকগুলো, জানিনা কত সময় ধরে তাঁরা অপেক্ষা করে আছে।”
প্রধান বাজারে, একটা লম্বা ফ্যাক্টরির দেয়ালের পাশে হলুদ রঙ্গের একটা গাড়ি পার্ক করা ছিলো, পাশেই একটা ছোট্ট বোর্ডে লেখা ছিলো, “এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ।” নাকে রুমাল চেপে তিনজন হায়দারাবাদী যুবক ভিতরে দাঁড়িয়ে কিশোরীর জন্যে অপেক্ষা করছিলো। গাড়িটাকে সামনে অন্য কোথাও পার্ক করতে পারলে তাঁদের ভালো লাগতো, কিন্তু ফ্যাক্টরির দেয়ালটা ছিলো অনেক লম্বা আর প্রস্রাবের গন্ধটা পুরো এলাকাটাকেই দখল করে রেখেছিলো।
চালকের সিটে বসা যুবকটা রাস্তার কোনায় কিশোরীকে আসতে দেখে তাঁর সাথের দুই বন্ধুকে বললো, “আচ্ছা, বন্ধুরা, সে এসছে। কিশোরী আর……আর, একটা বাচ্চা মেয়ে! তোরা এক পলক দেখ……ঐ যে ওটা, আরে বেটা……নীল শাড়ি পড়া ওটা।”
কিশোরী আর সারিতা যখন এগিয়ে আসলো, পেছনে বসা দুই যুবক তাঁদের মাথার হ্যাট খুলে ফেললো এবং সারিতার জন্যে মাঝখানে জায়গা ছেড়ে দিলো। কিশোরী সামনে এগিয়ে দরজাটা খুলে দ্রুত সারিতাকে পেছনে বসিয়ে দিলো। দরজাটা বন্ধ করে চালকের সিটে বসে থাকা ছেলেটাকে সে বললো, “মাফ করবেন, আমাদের দেরি হয়ে গেলো; মেয়েটা তাঁর বান্ধবীর বাসায় ছিলো। সুতরাং?”
ছেলেটা ঘুরে সারিতার দিকে তাকালো, তারপর কিশোরীকে বললো, “ঠিক আছে, কিন্তু শোন……” সে সিটের উপর দিয়ে পিছলে সরে গিয়ে অপর দিকের জানালায় উদয় হলো। কিশোরীর কানে ফিসফিস করে বললো, “মেয়েটা আবার অযথা হৈচৈ বাধাবে না তো?”
উত্তরে কিশোরী তাঁর বুকের উপর হাত রাখলো। “আমার উপর আপনার বিশ্বাস রাখতে হবে, জনাব!” এটা শুনে, ছেলেটা পকেট থেকে দুই রুপি বের করে কিশোরীর হাতে দিলো। “যাও, ফুর্তি করো।”
কিশোরী হাত নেড়ে বিদায় জানালো আর কাফায়াত ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো।
বিকেল পাঁচটা। বোম্বের বাজারগুলি গাড়ি, বাস, ট্রাম আর পথচারীর ট্রাফিকে গিজগিজ করছিলো। সারিতা দুই যুবকের মাঝখানের চিপায় হারিয়ে গেলো। সে তাঁর উরু দুটোকে শক্ত করে একসাথে চেপে রাখলো, হাত দুটো রাখলো ছেলে গুলোর উপরে, কিছু একটা বলতে শুরু করলো, তারপর অর্ধ বাক্য বলে থেমে গেলো, তারপর শুধুই নিরবতা। চালক ছেলেটাকে সে যা বলতে চেয়েছিলো, “ভগবানের দোহাই, এটা খুলে দাও। আমি এখানে দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছি।”
দীর্ঘক্ষণ, কেউ কোন কথা বললো না। চালকের সিটে বসা ছেলেটা গাড়ি চালিয়ে যেতেই থাকলো, লম্বা কালো রঙ্গের কোট গায়ে পেছনের সিটে বসা দুই হায়দারাবাদী যুবক প্রথমবার কোন যুবতী মেয়ের সংস্পর্শে আসায় এক ধরনের স্নায়ুচাপ অনুভব করছিলো, কোন রকমে তাঁরা সেটা দমিত করে রাখলো, একটা যুবতী মেয়ে, কিছুক্ষণের জন্যে হলেও তাঁরা তাকে নিজের বলে দাবি করতে পারবে, তাঁকে স্পর্শ করতে পারবে কোন প্রকার ভঁয় অথবা বিপদ ছাড়াই।
চালকের সিটে বসা ছেলেটা গত দুই বছর ধরে বোম্বেতে বাস করে আসছে, সে সারিতার মত এমন বহু যুবতী মেয়েকেই দেখেছে, দিনের আলোয়, রাতের অন্ধকারে। তাঁর এই হলুদ গাড়িতে সে বিভিন্ন রঙ্গের, বিভিন্ন রকমের মেয়েকে বয়ে নিয়ে গেছে, সুতরাং এখন সে তেমন কোন স্নায়ুচাপ অনুভব করলো না। তাঁর হায়দারাবাদ থেকে আসা দুই বন্ধুর মধ্যে একজনের নাম শাহাব, সে পুরো বোম্বে শহরটা ঘুরে দেখতে চেয়েছিলো। আর এই সফরের কথা মনে রেখেই গাড়ির মালিক কাফায়াত বন্ধুত্বের খাতিরে কিশোরীকে সারিতার আয়োজনের কথাটা বলেছিলো। তাঁর আরেক বন্ধু আনোয়ারকে কাফায়াত বলেছিলো, “শোন বেটা, যদি শেষ পর্যন্ত তোর জন্যও একজন পেয়ে যাই, তাতে ক্ষতি কি?” কিন্তু মিতভাষী আনোয়ার কখনই তাঁর লজ্জা ভেঙ্গে মুখ ফুটে বলতে পারেনি, “হ্যাঁ, আমার জন্যেও একজন নিয়ে আয়।”
কাফায়াত সারিতাকে আগে কখনো দেখেনি —কিশোরী শেষবার নতুন কোন মেয়ে নিয়ে এসেছিলো সেই অনেকদিন আগে। এই ব্যপারটা ছাড়া, কাফায়াত সারিতার প্রতি কোন আগ্রহই দেখালো না, কারণ হয়তো একজন লোক একসাথে একটি কাজই করতে পারে, সে একই সাথে গাড়ি চালিয়ে পাশাপাশি সারিতার দিকে মনযোগ দিতে পারছিলো না। শহর ছেড়ে গাড়িটা যখন গ্রাম্য রাস্তায় এসে নামলো, সারিতা লাফিয়ে উঠলো। গাড়ির হঠাৎ বেড়ে যাওয়া গতি আর ভিতরে আসা ঠাণ্ডা ধমকা হাওয়া তাঁর আরোপিত গাম্ভীর্র্যটা তুলে দিলো। তাঁর পুরো শরীরের মধ্য দিয়ে একটা বিদ্যুতের বিস্ফোরণ বয়ে গেলো। তাঁর পা দুটো ধড়ফড় করে উঠলো, বাহু দুটো নেচে উঠতে চাইলো, আঙুল গুলো কেঁপে উঠলো, সে দেখলো দুপাশের গাছগুলি পেছনের দিকে ছুটছে।
আনোয়ার আর শাহাব এখন একটু স্বস্তিতে ফিরে আসলো। শাহাব, যে মনে মনে ভাবছিলো সারিতার উপর তাঁরই প্রথম অধিকার রয়েছে, একটা হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে সারিতার ঘাড়ের উপর রাখতে চাইলো। তাঁর এই নড়াচড়াটা সারিতার শরীরে সুড়সুড়ি জাগিয়ে দিলো, সারিতা লাফ মেরে দুম করে গিয়ে আনোয়ারের উপর আছড়ে পড়লো। তাঁর হাসির শব্দ হলুদ গাড়িটার জানালা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দূরে বাতাসে মিলিয়ে গেলো। শাহাব যখন তাঁর হাতটা পুনরায় সারিতার পিঠে রাখতে চাইলো, সারিতা হাসতে হাসতে দ্বিগুণভাবে নুয়ে পড়লো। আনোয়ার গাড়ির এক কোনায় নীরবে শুকনো মুখে বসে রইলো। একরকম লুকিয়েই রইলো।
শাহাবের মনটা রঙ্গিন হয়ে উঠলো। সে কাফায়াতকে বললো, “হে ভগবান, দোস্ত, মেয়েটা তো ছোট্ট একটা মুখরা রে!” এটা বলেই সে সারিতার উরুতে জোরে একটা চিমটি কাটলো। উত্তরে, কাছে বসে থাকা আনোয়ারের কানটা সারিতা আলতো করে মলে দিলো। গাড়িটা হাসির শব্দে ফেটে পড়লো।
কাফায়াত বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখতে লাগলো, যদিও রিয়ারভিও আয়নায় সে সবকিছুই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলো। গাড়ির গতি আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে সে পেছনের সিটের চলমান হৈচৈ উত্তেজনাটায় নতুন মাত্রা যোগ করলো।
সারিতার খুব ইচ্ছে হলো বেয়ে গিয়ে গাড়ির ইঞ্জিনের ঢাকনাটায় চড়ে বসতে। সে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। শাহাব তাঁকে ধরে ফেললো, নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্যে সারিতা হাত দিয়ে কাফায়াতের ঘাড়টা জড়িয়ে ধরলো। অর্থহীনভাবে কাফায়াত তাঁর হাত দুটোতে চুমু খেলো। সারিতার শরীরের মধ্য দিয়ে একটা আলোড়ন বয়ে গেলো এবং সে লাফ মেরে সামনের সিটে চলে গেলো, আর কাফায়াতের গলা বন্ধনীটা নিয়ে খেলা শুরু করলো। “কি নাম তোমার?”, সে কাফায়াতকে জিজ্ঞেস করলো।
“আমার নাম!”, সে বললো। “আমার নাম কাফায়াত।” এটা বলেই সে দশ রুপির একটা নোট সারিতার হাতে গুঁজে দিলো। তাঁর নামের প্রতি সারিতার আর কোন আগ্রহ রইলো না, কিন্তু সে নোটটাকে তাঁর ব্লাউজের নিচে ঠেসে দিয়ে শিশুসুলভ আনন্দে উচ্ছলিত হয়ে উঠলো। “তুমি মানুষটা খুব ভালো। আর তোমার গলার বন্ধনীটাও খুব সুন্দর।”
এই মুহূর্তটায়, সে সবকিছুর মধ্যেই ভালো কিছু দেখতে পেলো, আর সে চাইলো সকল খারাপ যেন ভালোতে রূপান্তরিত হয়ে যায়……এবং…………এবং………তারপর সেটাই ঘটলো……মোটর গাড়িটা চলতেই থাকলো এবং তাঁর চারপাশের সবকিছুই যেন ঘূর্ণিপাকটার অংশ হয়ে গেলো।
হঠাৎ তাঁর গান গাইতে ইচ্ছে করলো। সুতরাং সে কাফায়াতের গলা বন্ধনী নিয়ে খেলাটা বন্ধ করে দিয়ে গান ধরলো, “তুমি আমায় প্রেম শিখালে, ঢেউ জাগালে আমার সুপ্ত হৃদয়ে।”
কিছু সময় ধরে সিনেমার এই গানটা চললো এবং তারপর সারিতা চুপচাপ বসে থাকা আনোয়ারের দিকে ঘুরে তাকালো। “তুমি এমন চুপ করে আছো কেন? কিছু একটা বলো, গাও কিছু একটা!”
এটা বলেই সে লাফিয়ে আবার পেছনের সিটে চলে গেলো এবং শাহাবের মাথায় আঙুল চালানো শুরু করলো। “এই যে, তোমরা দুজন, গাও। তোমাদের কি ঐ গানটা মনে আছে, দেবিকা রানী যেটা গাইতো? ‘আমি বনের পাখি, গেয়ে যাই গান……..’ দেবিকা রানী খুব ভালো, তাই না?”
তারপর সে দুহাত উরুর নিচে রেখে চোখের পাতাগুলি ঝাপটাতে ঝাপটাতে বললো, “অশোক কুমার আর দেবিকা রানী খুব কাছাকাছি দাঁড়ালো। দেবিকা রানী বললো, ‘আমি বনের পাখি, গেয়ে যাই গান।’ আর অশোক কুমার বললো, ‘গাও তাহলে।’
সারিতা গানটা শুরু করলো। ‘আমি বনের পাখি, গেয়ে যাই গান।’
শাহাব তিক্ষ্ম গলায় উচ্চস্বরে উত্তর দিলো, “আমি বনের পাখিই হবো। বনে বনে গেয়ে বেড়াবো।”
হঠাৎ করেই একটা দ্বৈত সঙ্গীত শুরু হয়ে গেলো। কাফায়াত গাড়ির হর্ন দিয়ে তাল মিলাতে লাগলো। সারিতা হাততালি দেয়া শুরু করলো। সারিতার চিকন গলার বালিকা স্বর, শাহাবের কর্কশ সুর, হর্নের আওয়াজ, দমকা হাওয়া আর ইঞ্জিনের গড়গড় শব্দ, সব মিলিয়ে সৃষ্টি হলো একটা ঐকতান।
সারিতা খুশি, শাহাব খুশি, কাফায়াত খুশি, আর তাঁদের সবাইকে এত খুশি দেখে আনোয়ারও বাধ্য হলো খুশি হতে। এতক্ষণ চুপচাপ হয়ে বসে থাকার জন্যে তাঁর অনুশোচনা হলো। তাঁর হাত দুটো নড়তে শুরু করলো। তাঁর সুপ্ত হৃদয়টা আলোড়িত হলো এবং এখন সে সারিতা, কাফায়াত আর শাহাবের উদ্দাম আনন্দে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে তৈরি হয়ে গেলো।
গান গাইতে গাইতে সারিতা আনোয়ারের মাথার হ্যাটটা খুলে নিয়ে নিজের মাথায় পড়ে নিলো। সে লাফ দিয়ে সামনের সিটে গিয়ে ছোট আয়নাটায় দেখে নিলো হ্যাট মাথায় তাঁকে কেমন লাগছে। সে কি পুরোটা সময় জুড়ে হ্যাটটা মাথায় পড়ে ছিলো? আনোয়ার ভাবলো।
সারিতা কাফায়াতের মোটা উরুতে চাপর মেরে বললো, “যদি আমি তোমার পাজামা, তোমার শার্ট আর তোমার গলা বন্ধনীটার মত একটা পড়ে নেই, তবে কি আমি একজন পুরোদস্তুর সাহেব বনে যাবো?”
একথা শুনে শাহাব বুঝে উঠতে পারলোনা কি করা উচিত।
সে আনোয়ারের হাত ধরে ঝাঁকি দিলো, “তুই একটা গণ্ড মূর্খ।”
এক মুহূর্তের জন্যে আনোয়ারও বিশ্বাস করলো তাঁর কথা।
কাফায়াত সারিতাকে জিজ্ঞেস করলো, “কি নাম তোমার?”
“আমার নাম?”, সে উত্তর দিলো, হ্যাটের ফিতেটা তাঁর চিবুকের নিচে টেনে নিতে নিতে বললো, “আমার নাম সারিতা।”
“সারিতা”, শাহাব পেছনের সিট থেকে বললো, “তুমি তো মহিলা নও, তুমি হচ্ছ একটা প্রাণোচ্ছল বালিকা।”
আনোয়ারও কিছু একটা বলতে চাইলো, কিন্তু সারিতা উচ্চস্বরে গান গাওয়া শুরু করলো।
“প্রেমের শহরে, আমি বানাবো আমার ঘর……ছেড়ে দিয়ে পুরো দুনিয়া।”
এবং ঐ দুনিয়ার কিছু অংশ তাঁদের চারপাশে উড়ে বেড়াতে লাগলো। সারিতার চুল গুলো তাঁর বেণীতে আর বাঁধা রইলো না, বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে বিক্ষিপ্ত চুল গুলো কালো ধোয়ার মত এলোমেলো হয়ে উড়তে লাগলো বাতাসে; সে ছিলো খুশি।
শাহাব খুশি, কাফায়াত খুশি, আর এখন আনোয়ারও খুশি হতে তৈরি। গানটা থেমে গেলো, কিছুক্ষণের জন্যে সবারই মনে হলো যেন এতক্ষণ মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলো এবং এখন তা হঠাৎ থেমে গেলো।
“আর কোন গান?” কাফায়াত সারিতাকে জিজ্ঞেস করলো।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ” শাহাব পেছন থেকে বলে উঠলো, “চলো আরেকটা গান গাই। এমন গান যেটা সিনেমার লোকজনও কখনো ভুলবে না!”
সারিতা আবার গান ধরলো। “বসন্ত এলো আমার ঘরে। আমি, আমি নামলাম পথে, একটু একটু মাতলামিতে।”
গাড়িটাও মাতলামিতে জড়িয়ে পড়লো। তারপর সোজা রাস্তা থেকে সমুদ্রের তীরটা দৃষ্টিগোচর হতে লাগলো। সূর্যটা অস্ত যাচ্ছিলো, আর সমুদ্র হাওয়াটা একটা শিরশিরে ভাব জাগিয়ে তুললো বাতাসে।
গাড়িটা থামলো। সারিতা দরজাটা খোলে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড় শুরু করলো তীরের দিকে। কাফায়াত আর শাহাব ছুটলো তাঁর পেছনে।
খোলা বাতাসে, সীমাহীন সমুদ্রের কিনারায়, ভেজা বালি থেকে গজিয়ে উঠা বড় বড় পাম গাছ, সারিতা ভুলে গেলো সে কি চায়। তাঁর ইচ্ছে হলো মিশে যেতে আকাশটায়, ছড়িয়ে পড়তে সমুদ্রের বুকে; উড়ে যেতে উপরে আরও উপরে, যেখান থেকে সে দেখতে পাবে পাম গাছের বাগানটা; তীরের সকল সিক্ততা বালি থেকে চুইয়ে চুইয়ে এসে পড়লো তাঁর পায়ে এবং………তারপর তাঁর ইচ্ছে হলো হারিয়ে যেতে সেই চলমান গাড়িতে, সেই ধমকা হাওয়ায়, সেই হর্নের আওয়াজে — সে ছিলো খুশি।
তিন হায়দারাবাদী যুবক ভেজা বালির উপর বসে তাঁদের বিয়ারের বোতল গুলো খুললো। সারিতা কাফায়াতের হাত থেকে বোতলটা ছিনিয়ে নিলো। “দাঁড়াও, আমি ঢেলে দিচ্ছি।”
সে ঢেলে দিলো, গ্লাসটা ফেনায় ভরে উঠলো। দৃশ্যটা তাঁকে শিহরিত করলো।
বিয়ারের বাদামি ফেনায় সে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে সেটা মুখে নিয়ে চেটে দেখলো। বিয়ারের তিক্ত স্বাদে তাঁর মুখখানা কুচকে উঠলো। শাহাব আর কাফায়াত হেসে গড়াগড়ি খেলো। হাসতে হাসতে কাফায়াত আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে দেখলো আনোয়ারও হাসছিলো।
তাঁরা ছয়টা বিয়ারের বোতল সাবাড় করলো, কিছুটা ঢুকলো তাঁদের পাকস্থলীতে; কিছুটা পরিণত হলো ফেনায় আর কিছুটা শুষে নিলো সমুদ্রের বালি। সারিতা গান গাইতে লাগলো। আনোয়ার সারিতার দিকে তাকালো এবং মুহূর্তের জন্যে তাঁর মনে হলো সারিতা দেখতে যেন বিয়ারের মতই। সাগরের আর্দ্র বাতাসে, সারিতার কৃষ্ণকায় গাল দুটো সিক্ত হয়ে উঠেছিলো। সারিতা একটা গভীর পরিতৃপ্তি বোধ করলো। আনোয়ারও এখন খুশি। তাঁর মনে হলো পুরো সমুদ্রটা যদি বিয়ারে রূপান্তরিত হতো, সেখানে সে সারিতাকে নিয়ে ডুব দিতো।
সারিতা খালি বিয়ারের বোতলগুলো নিয়ে ঠুং ঠুং শব্দ করে বাজাতে লাগলো, আর শব্দটা শুনে সে নিজেই হাসতে লাগলো। কাফায়াত, শাহাব আর আনোয়ারও হেসে উঠলো।
হাসতে হাসতে সারিতা কাফায়াতকে বললো, “চলো, এখন গাড়িতে চড়ি।”
সবাই উঠে পড়লো। বিয়ারের খালি বোতল গুলো আকীর্ণ পড়ে রইলো ভেজা বালির উপর। উৎসবটা এখন ছুটলো গাড়ির দিকে। আরও একবার, শুরু হলো ধমকা হাওয়া, হর্নের আওয়াজ, আর কালো ধোঁয়ার মত উড়তে লাগলো সারিতার মাথার চুল। আবারো শুরু হলো গান।
বাতাসকে ভেদ করে এগুতে লাগলো গাড়িটা। সারিতার গান গাইতে লাগলো। সে পেছনের সিটে শাহাব আর আনোয়ারের মাঝখানে বসলো। আনোয়ারের মাথা এদিক ওদিক দুলতে থাকলো। সারিতা দুষ্ট ভঙ্গিতে শাহাবের মাথার চুলে আঙুল চালাতে লাগলো, শাহাব ঘুমিয়ে পড়লো। আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সেও দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ছে। সে দুজনের মাঝখান থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সামনের সিটের দিকে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে কাফায়াতের কানে বললো, “আমি তোমার দুই বন্ধুকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। এখন তোমাকেও দেবো।”
কাফায়াত মুচকি হাসলো, “তাহলে গাড়ি চালাবে কে, শুনি?”
সারিতাও মুচকি হেসে উত্তর দিলো, “আমিই চালাবো।”
অনেকক্ষণ ধরে দুজন কথাবার্তা বললো। সামনে বাজারটা এসে পড়লো। যখন তাঁরা দেয়ালের উপরে ছোট বোর্ডটা পার হলো, যেখানে লেখা, “এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ”, সারিতা বললো, “এখানে নামিয়ে দিলেই হবে।”
গাড়িটা থামলো। কাফায়াত কিছু বলার আগেই সারিতা লাফিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে সে হেঁটে চলে গেলো।
কাফায়াত স্টিয়ারিঙের উপর এক হাত রেখে ঠায় বসে রইলো, হয়তো সারা দিনের সবগুলো ঘটনার কথাই মনে মনে ভাবছিলো।
সারিতা হঠাৎ থেমে গেলো, ঘুরে গাড়ির কাছে ফিরে এসে ব্লাউজের ভিতর থেকে দশ রুপির নোটটা হাতে নিয়ে কাফায়াতের পাশেই রেখে দিলো।
কাফায়াত বিস্ময়ে নোটটার দিকে তাকিয়ে রইলো। “সারিতা এটা কি করছো?”
“এটা………এই টাকা আমি কেন নেবো?” বলেই সারিতা দৌড়ে চলে গেলো। কাফায়াত স্থির বসে থেকে জবুথবু নোটটার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।
এক পর্যায়ে সে পেছনে ঘুরে তাকালো। সেখানে, শাহাব আর আনোয়ার, নোটটার মতই, জবুথুবু হয়ে পড়ে ছিলো, নিস্তেজ, ঘুমে বিভোর।
মূলঃ টেন রুপিস—সাদাত হাসান মান্টো