সোসাইটির ডিভাইস, ডিভাইড এন্ড রুল, আর সাফল্যের দৌড় — আপনি কোথায়?

সোসাইটি একজন ইনডিভিজুয়ালরে এত সব অভিনব পন্থায় শোষণ কইরা থাকে যে কেউ একজন আসলেই শোষিত হইতেছে কিনা, এবং হইলে কিভাবে হইতেছে সেইটা ডিটেক্ট করা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার হইয়া দাঁড়ায়। মানুষরে শোষণ করার লাইগা সোসাইটি অনেকগুলা ডিভাইস তৈরি কইরা রাখছে। এইসব ডিভাইস দিয়া সমাজ প্রথমেই একজন মানুষের ভেতরের শুদ্ধতা কাইড়া নেয়, তারপর জন্মগতভাবে একজন মানুষ যত ধরনের ন্যাচারাল কোয়ালিটি বহন কইরা বেড়ায় তাঁর সবকিছু খুব চতুর ও ধূর্ত পন্থায় ধীরে ধ্বংস কইরা দেয়। এই কাজগুলা সমাজ এমনভাবে করে যে এই করাকরির প্রসেস চলাকালীন সময়ে কারো মধ্যে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহও জাগে না। কেউ বুঝতেও পারে না তাঁর সাথে আসলে কি করা হচ্ছে। সোসাইটির তৈরি করা ডিভাইসগুলার মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী ডিভাইসটা হইলো — Jealousy (হিংসা)।

একটা শিশুর জন্ম নেওয়ার পরপরই প্রতিটা সমাজ, প্রতিটা কালচার এবং প্রতিটা ধর্ম তাড়াহুড়া কইরা আইসা তাঁর মধ্যে এই ডিভাইসটা ইন্সটল কইরা দেয়। তাঁরে অত্যন্ত গুরুত্বের সহিত শিখাইয়া দেয় — Comparison (তুলনা)। অতঃপর,  শিশুটা অন্য মানুষ, অন্য কালচার, অন্য ধর্মের সাথে নিজেরে তুলনা করতে করতে বড় হইতে থাকে। আর তুলনা করার এই শিক্ষাটা সে গলধকরণ করতে একরকম বাধ্য হয়। কারণ শিশুটা হইলো জাস্ট একটা শূন্য খাতা, যেইখানে এখনো কোন কিছু লেখা হয় নাইঃ সুতরাং তাঁর বাপ-মা, তাঁর শিক্ষাগুরু, আর তাঁর ধর্মগুরুরা সেই খাতায় যা লিখবে সেইটাকেই শিশু তাঁর নিজের ডেস্টিনি, নিজের ভাগ্য বইলা বিশ্বাস কইরা নিবে। এবং সেইটাই নেয়।

একটা মানুষ যখন একজন ইনডিভিজুয়াল হিসেবে আমাদের এই অস্তিত্বের ঘরে প্রবেশ করে, তখন তাঁর জন্যে সবগুলা দরজা খোলা থাকে, এভেইলএবল থাকে সব কয়টা ডিরেকশন এবং জীবনের সব কয়টা ডাইমেনশন তাঁর সামনে আইসা হাজির হয় — তাঁর কাজ হইলো নিজের ইচ্ছামত এক অথবা একাধিক ডাইমেনশন চুজ কইরা নেওয়া। কিন্তু সে নিজে সেইটা চুজ করার আগেই, সে নিজে নিজের মত হওয়ার আগেই, এমনকি সে তাঁর নিজের অস্তিত্বটা ঠিকঠাক অনুভব কইরা উঠার আগেই তাঁরে নষ্ট কইরা দেওয়া হয়। তাঁর মধ্যে ঢুকাইয়া দেওয়া হয় হিংসা। এইটা করে তাঁর সমাজ, তাঁর ধর্ম, তাঁর কালচার। আর এইখানে রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে কাজ কইরা যায় তাঁর বাপ-মা, তাঁর শিক্ষাগুরু, আর তাঁর ধর্মগুরুরা। মানুষের মধ্যে এই হিংসা ঢুকাইয়া দিলে আসলে কি ঘটে? যা ঘটে তা হইলো, একটা মানুষ তুলনার মধ্যে জীবনরে যাপন করতে থাকে। অর্থাৎ, সারা জীবন এইটাই মনে করা যে কেউ কেউ আপনার চাইতে বড়, এবং কেউ কেউ আপনার চাইতে ছোট। এতে কইরা সবসময় আপনে নিজেরে খুইজা পাইবেন ‘সাফল্য’ নামের একটা লেডারের মাঝখানের কোন এক জায়গায় ঝুইলা থাকা অবস্থায়। এবং যেই লেডারের মাঝখানে আপনে ঝুইলা আছেন, সেই লেডারটা খুব সম্ভবত বৃত্তাকার। কারণ কেহই কখনই এই লেডারের শেষ মাথায় পৌঁছাইতে পারে নাই। সবাই লেডারের মাঝখানের কোন না কোন জায়গায় আটকা পইড়া আছে। এবং মজার বিষয় হইলো, সবাই ঝুইলা থাকে ঠিক মাঝখানটায়। সবাই বলতে সবাই। লেডারটা যেন একটা বৃত্তাকার চাকা। শুধু ঘুরতাছে।

এইটা একটা চক্র। সফলতার চক্র। এই চক্রের মধ্যে দেখা যায় কেউ কেউ অবস্থান করতেছে আপনার উপরে। আর কাউরে যখন আপনে আপনার উপরে দেখতে পান, তখন আপনার ভেতরে কষ্ট অনুভূত হয়। খুব কষ্ট। এবং এই কষ্টটাই আপনারে সবসময় একটা চলমান যুদ্ধের মধ্যে, একটা চলমান সংগ্রামের মধ্যে, একটা চলমান স্রোতের মধ্যে ধইরা রাখে। এইখানে টিকে থাকার জন্যে যে কোন সম্ভাব্য পন্থাই আপনে অবলম্বন করেন। যে কোন। কারণ আপনে জানেন যে আপনে কিভাবে সফল হইলেন সেইটা নিয়া কেউ মাথা ঘামায় না, আপনার সফলতাটা নিয়াই কেবল সবাই মাথা ঘামায়। আপনে সফল মানেই আপনে ঠিক, আর আপনে ব্যর্থ হইলেন তো আপনে ভুল। এইখানে ব্যর্থতা হইল পাপ। সুতরাং আপনে যেইভাবেই করেন, যে পন্থায়ই করেন, এইখানে শুধু ম্যাটার করে আপনার ‘সাকসেস’। এইখানে মূল ব্যপারটা হইল, আপনে শুধু লেডার বাইয়া উপরে উঠতে থাকবেন। উঠতেই থাকবেন। কিন্তু আপনে কখনই এই লেডারের চুড়ায় পৌঁছাইতে পারবেন না। কেহই কখনও পারে নাই। কারণ লেডারটার কোন চূড়া নাই, লেডারটা যে বৃত্তাকার! আপনে যতই উপরে উঠতে থাকবেন, দেখবেন সবসময়ই আপনার উপরে কেউ না কেউ আছেই। এবং যে ব্যক্তিটাই আপনার উপরে থাকে, সে আপনার ভিতরে জন্ম দেয় হিংসার। আপনার মনে হয় সে সফল, আর আপনে ব্যর্থ। এখন আপনে যদি শান্ত হইয়া বইসা চক্ষু দুইটা বুইঝা একটু গভীরভাবে ভাবেন, তাইলে এই চক্রের আসল চিত্রটা আপনে দেখতে পাইবেন। তখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আচ্ছা একজন কি চাইলেই এই লেডার থাইকা ঝাপ দিয়া বাইর হইয়া আসতে পারে না? আসলে পারে না। অন্তত ৯৯ ভাগ মানুষই তা পারে না। কারণ সোসাইটি খুবই ধূর্ত, খুবই চালাক। সোসাইটি তাঁর শোষণের মেথডগুলারে হাজার বছর লাগাইয়া ঘইষা-মাইঝা রিফাইন করছে। আপনে চাইলেই সেইখান থাইকা বাইর হইতে পারবেন না সহজে। এইটা সহজ না হওয়ার মূল কারণ হইলো, এইটা একটা সার্কেল, কোন স্ট্রেইট লাইন না। ঠিক যখন আপনে বাইর হওয়ার চিন্তাটা করেন, তখন আপনে দেখতে পান যে আপনার নিচেও মানুষজন আছে। আর আপনার নিচের মানুষগুলারে দেইখা আপনে এক ধরণের সন্তুষ্টি অনুভব করেন। তখন আর আপনে আর এই সার্কেল থাইকা বাইর হইতে চান না। কিন্তু এই সন্তোষ আপনারে চক্রের মধ্যে ধইরা রাখতে সক্ষম হইলেও, আপনে আল্টিমেট সন্তুষ্টির দেখা কখনই পান না।

এখন এইভাবে যদি আপনি সবসময় হিংসায় ডুইবা থাকেন আর আপনার চারপাশের সবার সাথে একটা অস্থির প্রতিযোগিতায় নাইমা থাকেন, তাইলে আপনে ‘আপনি’ হইয়া উঠবেন কিভাবে? নিজের কাছে ফিরা আসবেন কিভাবে? নিজেরে জানবেন কিভাবে?

দুনিয়াটা অনেক বড়, এইখানে অনেক মানুষের বাস। আপনে যদি সবার সাথেই প্রতিযোগিতায় নামেন তাইলে আপনার অবস্থাটা কি দাঁড়াইব চিন্তা করছেন? এবং আসলেই আপনে এই প্রতিযোগিতায় নাইমা আছেন। কারো চেহারা আপনার চাইতে সুন্দর, কারো চুল আপনারগুলার চাইতে সুন্দর, কারো শরীরের আকৃতি আপনার চাইতে সুন্দর, কারো বুদ্ধিমত্তা আপনার চাইতে উত্তম, কেউ কেউ পেইন্টার, কেউ কেউ কবি, আর আপনে কিছুই না। আপনে কি পারবেন এই সবকিছুরে টপকাইয়া সফলতার মইয়ের চুড়ায় পৌঁছাইতে? পারবেন না। আপনে একলা এত সবকিছু হইতে পারবেন না। বরং এইসব করতে গিয়া আপনে নিজেরে এক ধরণের ইনসেনিটির মধ্যে ঢুকাইতে পারবেন, উম্মাদ হইয়া যাইতে পারবেন। এবং এইটাই পুরা মানবজাতি কইরা যাইতেছে।

কমপিটিশন ছাইড়া দেন, হিংসা ঝাইড়া ফেলেন। এইসব ধইরা রাখার কোন মানে নাই। এইগুলা হইলো সমাজের তৈরি ডিভাইস। এইগুলা তৈরি করছে ধর্মগুরুরা, সমাজপতিরা, যাতে কইরা আপনে কখনই নিজেরে চিনতে না পারেন, যাতে কইরা আপনে কখনই সত্যিকারের ‘আপনি’ হইয়া উঠতে না পারেন। এই ডিভাইস দিয়া তৈরি করা হইছে মানুষে মানুষে ডিভিশন। আর মানুষরে ডিভাইড করাই হইলো তাঁরে রুল করার একমাত্র পন্থা। যতগুলা পুরানা ধর্ম আর সোশ্যাল স্ট্রাকচার আছে, সবগুলাই সবসময় ভয়ে থাকে কখন না জানি আপনি জাইনা ফেলেন আপনি আসলে কে। কারণ, নিজেরে জানার মধ্য দিয়াই আসে পূর্ণতা, নিজেরে জানার মধ্য দিয়াই ভাইঙ্গা চুরমার হয় তথাকথিত সফলতার বৃত্তাকার লেডার, আর চোখের সামনে উন্মুক্ত হয় অস্তিত্বের বিস্তৃত পারাবার।

শরিফুল ইসলাম। ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৭।
[উৎসাহ — ফ্রম পারসোনালিটি টু ইনডিভিজুয়ালিটি, ওশো]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *