মুভি সুইস আর্মি ম্যান (২০১৬) — অ্যা জার্নি বাই ডেড বডি

রিভিওর শুরুতেই রবিনসন ক্রুসোর মত আপনারে আমি একটা বিচ্ছিন্ন জনমানবহীন দ্বীপের মধ্যে নিয়া ছাইড়া দিব। তারপর আপনে জীবন বাঁচানোর তাগিদে সেইখান থাইকা নিজের ঘরে ফিরা আসবেন। কিভাবে আসবেন? কোন নৌকা, কোন জাহাজ কিংবা কোন ভেলাও পাইবেন না সেইখান থাইকা আসতে। কারণ দ্বিপটা এতটাই লস্ট যে সেইটার আশপাশ দিয়া কোন কিছু যাইতে তেমন একটা দেখা যায় না, আর গেলেও তাঁরা আপনারে দেখতে পাইব না। কিন্তু এইদিক দিয়া এইরকম একটা দ্বিপে আটকা পইড়া যাওয়ার পড়েও আপনে আসলে আর ঘরে ফিরা আসতে চান না। কারণ আপনার জীবনটা এতটাই মিজারেবল এবং আপনে নিজেরে এতটাই অপদার্থ মনে করেন যে বাইচা থাকার ইচ্ছাটাও আপনার চইলা গেছে। তারপরেও আপনে ঘরে ফিরা আসবেন। এবং এই ফিরা আসার সময় আপনার নৌযান হিসাবে কাজ করব একটা ডেড বডি। অর্থাৎ আপনে কোন নৌকা না, কোন জাহাজ না, কোন ভেলাও না — স্রেফ একটা মরা মানুষের পিঠে চইড়া সমুদ্র পাড়ি দিবেন। এইরকম একটা অদ্ভুদ জার্নিতে কি আপনে যাইতে চান? গেলে চলেন।

আপনে সশরীরে এই ভ্রমণে অংশ নিতে না পারলেও, মুভির কেন্দ্রীয় চরিত্রের সাথে এক হইয়া গিয়া পুরা মুভিতে আপনে জার্নির উপরেই থাকবেন। এখন প্রশ্ন হইলো, মরা লাশের পিঠে চইড়া সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার বিষয়টা একটু বেশী অদ্ভুদ হইয়া গেল না? হ্যাঁ, এইটা শুধু বাস্তবে না, মুভিতে এবং গল্পেও অদ্ভুদের চাইতে অদ্ভুদ শোনায়। কিন্তু মজার বিষয় হইলো, আমাদের আপাত দৃষ্টিতে দেখা বাস্তবতার পেছনে অস্তিত্বের যেই বাস্তবতা বিরাজ করে সেইটা আসলেই অদ্ভুদ। এখন আপাত বাস্তবতার পেছনে আপনে সহজে যাইতে চাইবেন না, এবং তেমন কেউই সেইখানে যাইতে চায় না। কারণ, আমাদের নিজেদের বানাইয়া নেওয়া বাস্তবতার চাইতে অস্তিত্বের নেকেড বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়াটা বড্ড কঠিন। কিন্তু জীবনরে জানতে হইলে আপনারে সেইখানে যাইতেই হইব, কঠিনের চোখের উপর চোখ রাইখা তাকাইয়া দেখতে হইব। অস্তিত্বের নেকেড রিয়্যালিটিরে যেহেতু মানুষ বেশীরভাগ সময় এরাইয়া চলে, এইভাবে চলতে চলতে একটা সময় মানুষের মনেই হয় যে মানুষের নিজের বানানো সাবজেকটিভ রিয়্যালিটির পেছনে আর কোন রিয়্যালিটি থাকতে পারে না। আর এই নিজের বানানো রিয়্যালিটিতে সবসময় বাস করার কারণে মানুষের জীবনটা অত্যন্ত ছোট, মিজারেবল এবং নন–সিগনিফায়িং হইয়া পড়ে। তখন এই মানুষগুলারে এইখান থাইকা বাইর কইরা মুক্তি দেওয়ার জন্যে তাঁদের নিজেদের অস্তিত্বের সাথে পরিচয় করাইয়া দেওয়াটা জরুরি হইয়া পড়ে। এবং এইটা করার জন্যে ইতিমধ্যে নিজের অস্তিত্বের সাথে পরিচিত ব্যক্তিরা গল্প লিখে, উপন্যাস লিখে, সিনেমা বানায়। এই মুভিটাও এই জন্যেই বানানো হইছে। এই মুভি আপনারে আপনার মুখোমুখি কইরা দাড় করাইব। তবে সেইটা বড় অদ্ভুদ উপায়ে। উপায়টা অদ্ভুদ, কারণ আপনার অস্তিত্বের ধরণটাও অদ্ভুদ।

মুভির ওপেনিং সিনেই আপনে দেখতে পাইবেন যে একটা ছেলে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যে ফাঁসি দিয়া মইরা যাওয়ার চেষ্টা করতেছে। ঠিক যেই মুহূর্তে ছেলেটা ফাঁসির দড়িতে ঝুইলা পড়লো সেই মুহূর্তেই সে দেখতে পাইল সমুদ্রের তীরে একটা মানুষের বডি ভাইসা আসছে। এইটা দেইখা ছেলেটার ফাঁসিতে ঝুলার ইচ্ছাটা চইলা গেল। সে কোন রকমে দড়ি থাইকা নিজেরে ছাড়াইয়া বডিটার কাছে গেল। দেখতে চাইল লোকটা এখনো জীবিত কিনা। কিন্তু বোঝা গেল যে লোকটা অনেক আগেই মইরা গেছে। এইটা দেইখা ছেলেটা নিজের জীবনের উপর আবার আগ্রহ হারাইয়া ফেলল। সে লাশটার সাথে আপন মনেই কথা বলা শুরু করলো। তখন হঠাৎ ডেড বডিটা একটা পাদ মারল। পাদের আওয়াজ শুইনা ছেলেটা খানিকটা অবাক হইলেও এইটারে তেমন একটা গুরুত্ব দিল না। আবার সে ফাঁসির দড়িতে ফিরা আসল। ঠিক ঝুইলা পড়ার মুহূর্তে সে আবার শুনতে পাইল লাশটার পাদের আওয়াজ। দীর্ঘ পাদ। চাইলেও ইগনোর করা যায় না। পরে দেখা গেলা লাশটা কাঁপতেছে আর অনবরত পাদতেছে। এই দৃশ্য দেইখা ছেলেটা বুঝতে পারল যে এই লাশই তাঁরে বাড়ি নিয়া যাইব। সে ফাঁসির দড়ি ছাইড়া আইসা লাশের পিঠে চইড়া বসলো। লাশের পাদের আওয়াজ এবং শক্তি বাইড়া গেল। এতটাই বাইড়া গেল যে পাদের বাতাসে লাশটা স্পিড বোটের গতিতে চলা শুরু করলো সমুদ্রের বুকে চিড়া। আর লাশের পিঠে বইসা আছে আমাদের কেন্দ্রীয় ছেলেটা অথবা আপনি নিজে।

এইরকম কইরা লাশের পিঠে ভাসতে ভাসতে ছেলেটা এক সময় মেইনল্যান্ডে গিয়া পৌঁছাইল। কিন্তু এমন জায়গায় গিয়া পড়লো সেইখান থাইকা লোকালয় অনেক দূরে। সেইখানেও কোন জনমানব নাই। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, আর লাশটারে সাথে নিয়া ছেলেটা আগাইতে থাকল। এক পর্যায়ে খেয়াল করল যে লাশটার মুখ থাইকা কথা বাইর হইতেছে, অবশ্য পাদাপাদিও এখনো চলতেছে। কিন্তু কথা বাইর হওয়া মানে এই না যে লাশটা জীবিত হইয়া গেছে, বরং এইটা মরা লাশ হিসেবেই কথা বলা শুরু করছে। এইরকম অদ্ভুদ অদ্ভুদ ঘটনা, লাশের সাথে ডিল করা এবং সেই লাশ নিয়া বাড়ি ফিরার অদ্ভুদ জার্নি নিয়া আগাইতে থাকে মুভির কাহিনী।

মুভিটা দেখতে বইসা যেই জিনিসটা আপনে সবচাইতে বেশী টের পাইবেন সেইটা হইলো একাকীত্ব। একরকম ধইরাও নিতে পারেন যে একাকীত্বই এই মুভির মেইন থিম। একাকীত্ব আসলেই আমাদের এই হিউম্যান রেইসের সবচাইতে বড় রোগ। কেউ একজন একবার বলছিল, “Being alone in this world is the root of all sufferings.” দুঃখজনক বিষয় হইলো, এই দুনিয়ায় প্রায় সব মানুষই একা। এখন প্রশ্ন হইলো, কেন সবাই এইরকমভাবে একা, কিংবা নিজেরে একলা অনুভব করে? এর চাইতে বড় প্রশ্ন হইলো, একাকীত্ব জিনিসটা আসলে কি? একাকীত্ব বলতে আমরা সাধারণত বুঝি একলা থাকা, আশেপাশে এমন কেউ না থাকা যে আমাদের জন্যে কেয়ার করে, এবং আমরা একাকীত্ব বলতে কেবল এইটাই বুঝি। কিন্তু একাকীত্ব আসলে এইটা না। একাকীত্ব হইলো সেন্স অব ডিসকানেকশন, জীবনের সাথে ডিসকানেকশন, প্রকৃতির সাথে ডিসকানেকশন, অস্তিত্বের সাথে ডিসকানেকশন, নিজের সাথে নিজের ডিসকানেকশন। আর এই ডিসকানেকশনটা ধরতে না পারার কারণে আমরা মানুষের সঙ্গ দিয়া, স্বামী দিয়া, স্ত্রী দিয়া, আত্মীয়-স্বজন দিয়া, বন্ধু-বান্ধব দিয়া, বাজারের প্রডাক্ট দিয়া আমাদের এই একাকীত্ব দূর করতে চাই। কিন্তু এইগুলা দিয়াও একাকীত্ব দূর হয় না, দিনশেষে সেই একলা লাগেই। এই একাকীত্ব তখনই দূর হইব যখন আপনে নিজের সাথে নিজে কানেকটেড থাকবেন, অস্তিত্বের সাথে টিউনড থাকবেন। অন্যথায় হাজারো মানুষের ভিড়ে আপনার নিজেরে একলা লাগবই, এবং লাগেও। মুভিতে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ছেলেটা একটা মাইয়ারে পছন্দ করে, কিন্তু কোনদিন তাঁরে সেই কথা কইতে পারে নাই। এই কইতে না পারা এবং জীবনের আরও যত চাওয়া আছে সেইগুলার সাথে নিজেরে কানেক্ট করতে না পারার কারণে এই পৃথিবীর বুকে তাঁর নিজেরে বড় বিচ্ছিন্ন, একলা, এবং অকেজো মনে হইতে লাগল। আর এই মনে হওয়া থাইকাই জীবনের উপর তাঁর আর আগ্রহ রইলো না। লাশের সাথের জার্নিটা তাঁরে দেখাইয়া দিল যে জীবনরে সে এতদিন যেইভাবে দেখছে জীবন আসলে সেইরকম না, এবং এই জীবনের কাছে সে আসলে একলাও না।

পুরা মুভিতে ডেড বডিটা আপনার জন্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ কইরা যাইব। সে আপনারে আপনার আপাত বাস্তবতা, আর মেকি ম্যানারে ভরা জীবনটারে আপনার চোখের সামনে তুইলা ধরব। আপনে দেখতে পাইবেন আপনার এই মেকি বাস্তবতায় ভরা জীবনটা কতটা হাস্যকর। দেখতে পাইবেন বাইচা থাকার ক্ষেত্রে আপনার যে ভয় কাজ করে তাঁর সবই আসলে ভুয়া।

মুভিটারে বলা যায় জীবনের এক গভীর পোয়েটিক এক্সপ্রেশন। অসাধারণ এই মুভিটারে যিনি বানাইছেন তাঁর নাম হইলো ড্যান কোয়ান। কেন্দ্রীয় আর লাশের চরিত্রে অভিনয় করছে পল ড্যানো আর ড্যানিয়েল রেডক্লিফ। ক্রিটিকদের কাছ থাইকা মুভিটা পাইছে অনেক পজিটিভ রিভিও। অডিয়েন্স জানাইছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আইএমডিবিতে মুভিটার রেটিং ৭.২। আর রটেন টমেটোতে ৬৭% ফ্রেশ।

রিভিও শেষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *