কখনো কি নিজের দিকে খেয়াল কইরা তাকাইয়া দেখছেন যে আপনে আসলে একজন ল্যাংড়া, লুলা এবং কানা প্রতিবন্ধী? আপনার একটা ঠ্যাং আছে তো একটা হাত নাই, একটা চোখ আছে তো নাক নাই, অথবা চোখ দুইটাই আছে কিন্তু একটা দিয়াও কিছু দেখেন না, আর সবকিছু ঠিকঠাক মত থাকলেও আপনার মেরুদণ্ডটা একদমই ভাঙ্গা? ভাবতাছেন, এইগুলা আবার খেয়াল কইরা দেখার কি আছে, এমন হইলে তো টেরই পাইতাম! না, আপনে আসলে টের পান না, কারন এইগুলা আপনার শারীরিক পঙ্গুত্ব না। এইগুলা মানসিক। আপনে কি জানেন যে জন্মের সময় আপনে দুই অথবা তারও অধিক পাখা নিয়া জন্মাইছিলেন এবং জন্মের পরেই আপনার এই পাখাগুলা দলা মুচরা কইরা ভাইঙ্গা ফেলা হইছে, কিংবা কাইটা ফালাইয়া দেওয়া হইছে? এবং আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হইল এই যে আপনে নিজেও আপনার সন্তানের পাখাগুলাও এইভাবে ভাইঙ্গা ফেলতেছেন, তারেও লুলা কইরা দিতাছেন নিজের অজান্তেই। জানেন এইগুলা? জানেন বোধয়। তবে জাইনা থাকলেও আপনার কাছে আমার এই প্রশ্নগুলারে একরকম অফেন্সিভ মনে হইতে পারে। ভাবতাছেন, আপনে আমার রিভিওর পাঠক হইছেন বইলা আপনারে আমি এইভাবে এড্রেস কইরা এইসব বলতে পারি না নিশ্চয়ই। কিন্তু এইখানে আসলে ‘আপনি’টা শুধু আপনি না, এইটা সবাই। সবাই না হইলেও বেশীরভাগ, এবং বেশীরভাগটা এইখানে একটু বেশীই। এখন আপনে চাইলে আমারে একটা প্রশ্ন কইরা বসতে পারেন, কারো পঙ্গুত্ব কি আসলেই নেগেটিভ জিনিস, যেমন শারীরিক পঙ্গুত্বের নেগেটিভিটি থাইকাই কি আমি মানসিকটার তুলনা টানলাম? উত্তরটা হ্যাঁ এবং না দুইটাই। কারো শারীরিক পঙ্গুত্ব আসলে কোন নেগেটিভ জিনিস না, এইটা করুণা করারও জিনিস না। কিন্তু সমাজে আমরা এইটা কইরা অভ্যস্ত। এবং সেইটা ভিন্ন আলোচনা। তাই আপাতত এইখানে শারীরিক পঙ্গুত্বের চিত্র দিয়াই আপনার মানসিক পঙ্গুত্বটা বর্ণনা করলাম। আপনি যে এইরকম পঙ্গু হইয়া আছেন, কিংবা পঙ্গুদের মাঝখানে বসবাস করতেছেন, এবং আপনার সন্তানরে পঙ্গু কইরা বড় করতেছেন, এবং এইটার জন্যে আমাদের এই মেকি সভ্যতা কতটা দায়ী সেইটাই চোখে আঙুল দিয়া দেখানোর জন্যেই বানানো হইছে এই মুভি। মুভিতে আপনারে নিয়া যাওয়ার আগে চলেন আমাদের এই সমাজ এবং চিরায়ত প্রথাগুলা আমাদেরকে ক্যামনে লুলা বানাইয়া রাখে সেইটা একটু জাইনা নেই।
সোসাইটি হইলো মানুষরে হ্যাণ্ডিক্যাপ বানানোর বৃহদাকার, প্রায় সফল, প্রাচীন একটা প্রোডাকশন হাউজ। এইখানে দক্ষতার সাথে সেই এগরিকালচার রেভুলুশনের পর থাইকা, অর্থাৎ প্রায় দশ হাজার বছরেরও বেশী সময় ধইরা মানুষরে হ্যাণ্ডিক্যাপ বানানো হইয়া থাকে। সোসাইটি এই কাজটা করে কতগুলা সিস্টেমের সাহায্যে। তাঁর মধ্যে অন্যতম হইলো এডুকেশন সিস্টেম। প্রাতিষ্ঠানিক এডুকেশন আসছেই মানুষরে উন্নতমানের কামলা বানানোর জন্যে, জ্ঞানী বানানোর জন্যে না। তবে সোসাইটি প্রধানত যেই পন্থায় মানুষরে হ্যাণ্ডিক্যাপ বানায় সেইটা হইলো ‘সোশ্যাল নর্ম’ অর্থাৎ ‘সামাজিক রীতিনীতি’ নামক এক চিপা গলির মাধ্যমে। সোশ্যাল নর্মের একটা সফটওয়্যার সমাজ প্রথমেই প্রতিটা বাপ-মায়ের মাথার মধ্যে ইন্সটল কইরা দেয়। ফলে একটা মানুষরে হ্যাণ্ডিক্যাপ বানানোর কাজ সেই শিশুকাল থাইকাই শুরু হইয়া যায়। সাধারণত অসংখ্য মুক্ত চিন্তার ডালপালা আর অসীম ইচ্ছাশক্তির অধিকারী একটা বিশাল মানুষরে সমাজ জোর কইরা, দলা মুচড়া কইরা ঠাইসা রীতিনীতির চিপা গলির এক মাথা দিয়া ঢুকাইয়া দেয়। তারপর মানুষটা গলির অন্য মাথা দিয়া একটা নির্দিষ্ট লিমিটেড শেইপ নিয়া বাহির হইয়া আসে। তাঁর চিন্তা ভাবনাগুলাও হইয়া যায় লিমিটেড। বাহির থাইকা তাঁরে তখন অক্ষত দেখা গেলেও তাঁর ভেতরের চিন্তা চেতনাগুলা সব আসলে ম্যারামোচা হইয়া যায়। সোশ্যাল নর্মের এই চিপা গলির ভেতর দিয়া আসা এই মানুষটারে সোসাইটি তখন ‘নরমাল’ বইলা ঘোষণা দেয়। অর্থাৎ এই সোসাইটিতে যেই ব্যক্তি নর্ম মাইনা চলে তাঁকে বলা হয় ‘নরমাল’। আর কেউ যদি সেই চিপা গলিতে ঢুকতে না চায় অথবা চিপা গলির ভিতর দিয়া আইসাও নিজস্ব শক্তিবলে চিন্তার ডালপালাগুলোরে কোনরকমে অক্ষত রাইখা দেয়, তখন সোসাইটি তাঁরে বলে ‘এবনরমাল’। পাগল অথবা দেশদ্রোহী শব্দগুলোও তাঁর কপালে জুইটা যায়। অবশেষে ফলাফল দাঁড়ায়, সমাজের নিরানব্বই ভাগ মানুষই হইয়া যায় নরমাল অর্থাৎ চিন্তায় তাঁরা ল্যাংড়া এবং লুলা। আর এই লুলাদের নিয়া হাজার বছর ধইরা ব্যাবসা কইরা যায় কর্পোরেশন।—এইভাবেই জইমা উঠে সভ্যতা নামক এই লুলার হাটবাজার!
এই হাটবাজার থাইকা চলেন আপনারে নিয়া এখন মুভিতে ঢুইকা পড়ি। মুভির নাম ‘ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক’। মুভিটার এইরকম নাম কেন হইল সেইটা আপনে কিছুক্ষণ মুভি দেইখা এমনেই বুঝতে পারবেন। মুভিটা শুরুতেই আপনারে নিয়া যাইব প্যাসিফিক নর্থওয়েস্টের জঙ্গলের ভিতরে। আপনে দেখতে পাইবেন ঐ জঙ্গলে গাছের চিপায় ঘর বানাইয়া একটা পরিবার বসবাস করতেছে। এরা বনের পশুপাখি শিকার কইরা খায়। কিন্তু এইটাও আপনে বুঝতে পারবেন যে এরা জঙ্গলে এইভাবে থাকলেও এরা আসলে জংলি টাইপের কিছু না। এরা “সভ্য!” জগত থাইকাই এইখানে আইসা বাস করতেছে। পরিবারটা আসলে একজন বাপ আর বিভিন্ন বয়সের ছয়টা পোলা-মাইয়া নিয়া গঠিত। বাচ্চাগুলার মা আছে, এবং এদের এই মা এই মুভির একটা শক্তিশালী চরিত্র। কিন্তু দুঃখের বিষয় হইলো, মুভিতে আপনে এই ‘মা’ চরিত্রের কোন অভিনয়ই দেখতে পাইবেন না। মুভির কাহিনী কিছুক্ষণ গড়াইলেই আপনে বুঝতে পারবেন যে এই পরিবারটা আসলে ক্যাপিটালিজম আর অ্যামেরিকান “নরমাল” লাইফরে বুড়া আঙুল দেখাইয়া এই জঙ্গলে আইসা বসবাস করা শুরু করছে। এইখানে বাচ্চাগুলার বাপ আপাতদৃষ্টিতে খুবই রুক্ষ হইয়া এদেরকে প্রকৃতিতে সারভাইব করার মত শক্তিশালী এবং স্বনির্ভর কইরা তুলার লক্ষ্যে নিজের জীবন দর্শন এদের উপর চাপাইয়া দেয়। কিন্তু সে যে বাচ্চাগুলারে খুবই ভালোবাসে এবং তাঁর এই ফিলসফি যে এদেরকে মুক্ত স্বাধীন কইরা গইড়া তুলতেছে এইটা বাচ্চাগুলা ভালো কইরাই বুঝতে পারে এবং এরাও এদের বাপকে অনেক ভালোবাসে। এইভাবে যখন চলতে থাকে, হঠাৎ একদিন এরা খবর পায় যে সভ্য জগতের হাসপাতালে থাকা এদের অসুস্থ মা আত্মহত্যা কইরা মইরা গেছে। এখন এরা এদের মায়ের ফিউনারেলেও যোগদান কইরা শেষ দেখাটা দেখতে পারবো না, কারন এদের “সভ্য নানা” এদের জঙ্গলে থাকা অসভ্য বাপরে সেইখানে যাইতে নিষেধ কইরা দিছে, গেলে পুলিশে ধরাইয়া দিব। এরপর এই প্রতিকূলতা কাটাইয়া এদের মায়ের জানাজায় গিয়া, মায়ের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মরদেহের সৎকার করার এডবেঞ্চার নিয়া আগাইতে থাকে মুভির কাহিনী।
মুভির কাহিনীর উপর ভিত্তি কইরা মুভিটারে অফিসিয়ালি বলা যায়, “ফ্যামিলি ড্রামা”। কিন্তু মুভির কাহিনীতে যে জীবন দর্শন ফুইটা উঠছে সেইটার ভিত্তিতে মুভিটারে বলা উচিত, “ফিলসফিকাল ড্রামা”। মুভির একটা থিম আপনারে বইলা দিয়া যাইব কিভাবে নিজের বাচ্চারে বড় করা উচিত। মুভিতে এক পর্যায়ে দেখা যায়, পরিবারের সবচাইতে ছোট মাইয়াটা বাকী সবার সামনেই বাপরে প্রশ্ন কইরা বসে, “বাবা, ধর্ষণ কি জিনিস?” এই প্রশ্নের উত্তরে বাপ লোকটা সবার সামনেই মাইয়ারে ধর্ষণের ডিরেক্ট ন্যাকেড ডেসক্রিপশন দিয়া দেয় দ্বিধাহীন কণ্ঠে। এইরকম আরও অনেক পরিস্থিতিতে দেখা যায় বাপ তাঁর সন্তানদের কাছে সবসময়ই সত্য কথা কইয়া যায়, হউক সেইটা শুনতে যতই “খারাপ”। বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমাজেও আমাদের বাচ্চারা আমাদেরকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রশ্ন কইরা বসে যেগুলার উত্তর আমরা সরাসরি দিতে পারি না, কিংবা দিতে চাই না। বাচ্চারা অনেক কৌতূহলী হওয়াতে, প্রায় সব বাপ মারেই বাচ্চাদের সামনে বিভিন্ন অকওয়ার্ড প্রশ্নের সম্মুখীন হইতে হয়। এবং এইসব ক্ষেত্রে প্রায় সব বাপ মাই তাঁর বাচ্চারে মিথ্যা গোঁজামিল দিয়া একটা উত্তর দিয়া দেয়, কেউ কেউ আবার উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন করার কারণে বাচ্চারে ধইরা মাইরও দিয়া বসে। এই বিষয়টা আপাতদৃষ্টিতে খুবই সাধারণ এবং ইনোসেন্ট একটা ব্যাপার মনে হইলেও, ব্যাপারটা আসলে খুবই জঘন্য। কারণ সত্যরে কাপড় পড়াইয়া যখন আপনে বাচ্চার মাথায় ইনপুট দিবেন, তা পরবর্তীতে মিথ্যার বিষফোঁড়া হইয়া বাইর হবে। মুভিতে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেখা যায়, বাচ্চাগুলার মা মরার আগে উইল কইরা যায় যে মরার পরে তাঁরে যেন খ্রিষ্টান রীতিতে সৎকার করা না হয়, বরং উইলে সে ইচ্ছা পোষণ কইরা যায় যে তাঁর মরদেহ ক্রিমেট কইরা ছাইগুলা যেন টয়লেটে ফ্ল্যাশ কইরা দেওয়া হয়। এবং তাঁর এই ইচ্ছাটারে পূরণ করা নিয়াই মূলত মুভির কাহিনীটা অনেক থ্রিলিং হইয়া উঠে। এইখানে মূল ফিলসফিকাল যে ইনসাইট প্রকাশ পায় তা হইল, মৃত্যু একটা অতি স্বাভাবিক এবং ন্যাচারাল ঘটনা। কিন্তু মৃত্যুরে আমরা সবসময় একটা ভয়ানক ইনসিডেন্ট হিসেবে দেইখা থাকি। মৃত্যুর ভয় আমাদেরকে ঠিকমত বাইচা থাকতেও দেয় না। অথচ মৃত্যু হইলো “সাইকেল অব লাইফ” এর একটা অপরিহার্য অংশ। মৃত্যুরে আমরা যেমন ভয় পাই, তেমনি মরদেহ নিয়াও আমাদের মধ্যে আছে একটা অতিরঞ্জিত সম্মান বোধ। এইসব রীতিনীতির গালে থাপ্পড় বসাইয়া বাচ্চাগুলার মা বইলা যায় যে তাঁর মরদেহের ছাইগুলা যেন টয়লেটে ফ্ল্যাশ করা হয়। এবং সে আরও বইলা যায় তাঁর লাশের সামনে যেন তাঁর প্রিয় গানটারে গাওয়া হয়, যা বুঝাইয়া দেয় মৃত্যু জিনিসটা জীবনের বিপরীত হইলেও মৃত্যু জন্মের মতই সুন্দর। পুরা মুভিটাই এইরকম ছোট বড় অনেকগুলা গভীর জীবন দর্শনে ঠাসা।
মুভির কাহিনী এবং মুভিতে তুইলা ধরা দর্শনরে সামারাইজ কইরা আপনে যদি এক কথায় প্রকাশ করতে যান তাইলে পুরা জিনিসটাই ‘সমাজের গালে বসানো থাপ্পড়’ হইয়াই আপনার চোখে ধরা দিবে। এবং এই থাপ্পড় আপনার নিজের গালেও লাইগা যাইতে পারে, আবার নাও পারে। মুভিতে দেখা যায়, অ্যামেরিকান দার্শনিক নউম চমস্কির জন্মদিন খুবই ফলাও কইরা পালন করা হয় এবং এই লোকের দর্শন নিয়াও বাপ তাঁর পোলা-মাইয়াদের সাথে আলাপ করে। এতে বলা যায় মুভির নির্মাতা এই মুভি বানাইতে গিয়া হয়তো চমস্কির দর্শন দ্বারাও উৎসাহিত হইছে।
মুভির নামটা শুনলে মুভিটারে আপনার কাছে সুপার হিরো টাইপের মুভি মনে হইতে পারে। তবে এইটা আসলে সুপার হিরো মুভিই, কিন্তু সচরাচর আপনে সুপার হিরো বলতে যা বোঝেন সেইরকম না আর কি! এই মুভির কেন্দ্রীয় চরিত্র আসলেই একজন সুপার হিরো। সে সুপার হিরোর মতই উড়তে পারে, সে তাঁর নিজের পাখনাগুলারে অনেক চেষ্টা কইরা অক্ষত রাখছে এবং তাঁর সন্তানের পাখনাগুলারেও অক্ষত রাখার মিশনে নামছে। তবে তাঁদের এইসব পাখা আপনে খালি চোখে দেখতে পাইবেন না, যেমন নিজের গুলাও আপনে দেখতে পান না।
মুভির কেন্দ্রীয় বাপ চরিত্রে অভিনয় করছে ভিগো মরটেনসেন। মুভিতে লোকটার অভিনয় দেইখা চোখ জুড়াইয়া যায়। বাচ্চাগুলার অভিনয়ও ছিল দেখার মত। মুভিটারে যিনি বানাইছেন উনার নাম হইলো ম্যাট রস। এই রকম একটা মুভি বানাইয়া লোকটা নিঃসন্দেহে সাহসিকতার পরিচয় দিছেন। ক্রিটিকদের কাছ থাইকা মুভিটা ভালোই পজিটিভ রিভিও পাইছে। অডিয়েন্স মুভিটারে আইএমডিবিতে ৮/১০ দিলেও অনেকে নেগেটিভ রিভিও দিয়াও ফাটাইয়া ফেলছে। মুভিটা রটেন টমেটোতে ৮২% ফ্রেশ।
রিভিও শেষ।