ভালোবাসেন, দায়িত্ব পালন কইরেন না

প্রশ্নঃ নিগৃহীত মানুষের প্রতি সমাজের কি কোন দায়-দায়িত্ব আছে?

না নাই। কারণ সমাজ প্রথমেই তাঁর মানুষগুলার জীবনটারে ধ্বংস কইরা দেয়। তারপর এইটা দায়িত্বের কথা বলা শুরু করে। প্রতিটা শিশুরেই এই সমাজ ধ্বংস কইরা দিচ্ছে। সমাজ একটা শিশুরে তাঁর নিজের প্রকৃতি থাইকা ডিসট্র্যাক্ট করে, সে যা হইতে যাইতেছে সেইখান থাইকা তাঁরে ডিসট্র্যাক্ট করে, অস্তিত্ব তাঁরে যা বানাইতে যাইতেছে সেইখান থাইকা তাঁরে ডিসট্র্যাক্ট করে। প্রথমে সমাজ তাঁরে এইরকমভাবে ডিসট্র্যাক্ট করে, ডিস্টার্ব করে, এবং যখন সে পুরোপুরি ডিস্টার্বড হইয়া এলোমেলো হইয়া যায়, তখন সমাজের বড় বড় দুনিয়া উদ্ধারকারী মহান লোকগুলা তাঁর কাছে আসা শুরু করে আর বলা শুরু করে যে সমাজ হিসেবে তাঁদের একটা দায়িত্ব আছে। এইটা একটা ধূর্ত খেলা, সমাজ এই খেলা খেইলা যায় প্রতিনিয়ত।

প্রথমে একটা মানুষরে ইচ্ছা কইরা অসুস্থ বানায়, তারপর দৌড়াইয়া আসে তাঁরে সেবা দিতে, দায়িত্ব পালন করতে, মানবতা দেখাইতে, দয়া-মায়া দেখাইতে এবং ঔষধ নিয়া আসে তাঁরে খাওয়াইতে। কিন্তু প্রশ্ন হইলো, প্রথমেই কেন মানুষটারে আঘাত করা হয়? কি দরকার তাঁরে আঘাত কইরা, আহত কইরা তারপর আবার মানবতা দেখাইতে আসার?

সব শিশুই নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক। আপনে শুধু তাঁদেরকে ছাইড়া দেন, তাঁদেরকে তাঁদের মত হইতে দেন, তাঁদেরকে ভালোবাসেন। আর মনে রাইখেন, ভালোবাসা জিনিসটা কোন দায়িত্ব না। আমার এখন একটা ছোট ঘটনার কথা মনে পইড়া গেল। একবার এক হিন্দু মঙ্ক হিমালয়ের অনেক উঁচুতে একটা পবিত্র জায়গা দর্শনে যাইতেছিল। দীর্ঘ পথ, ক্লান্তিকর। সেইখানে হিন্দু লোকটা দেখতে পাইল, একটা তেঁর-চৌদ্দ বছরের মাইয়া কাঁধের উপর একটা মোটা ছেলেরে নিয়া হাটতাছে। লোকটা ছিল খুবই ক্লান্ত। এই দৃশ্য দেইখা সে মাইয়াটারে বলল, “মামনি, তুমি তোমার কাঁধে অনেক ভার বহন করতেছ। নিশ্চয়ই তুমি অনেক ক্লান্ত হইয়া পড়ছ।” এই কথা শুইনা মাইয়াটা রাইগা গিয়া উত্তর দিল, “ভার? ভার তো আপনে বহন করতেছেন! আমার কাঁধে যা আছে সেইটা কোন ভার না, এইটা আমার ভাই।” এইটাই ভালোবাসা। ভালোবাসার কোন ভার থাকে না।

ভালোবাসা কোন দায়িত্ব না, কোন কর্তব্যও না। ভালোবাসা হইলো আপনার বিশুদ্ধ আনন্দ। আর এই ভালোবাসা থাইকা আপনে যা করতে চান তাই করতে পারেন। কিন্তু যাই করেন, ভালোবাসা থাইকা কইরেন, আপনার ধর্মের কথায় কইরেন না, আপনার আদর্শের কথায় কইরেন না, এবং আপনার সেন্স অব রেস্পন্সিবিলিটি থাইকাও কইরেন না। যদি আপনার সন্তানের জন্যে আপনে যা করার তা ধর্ম, আদর্শ আর দায়িত্ব থাইকা করেন, তাইলে আপনে কোনদিন আপনার সন্তানরে ক্ষমা করতে পারবেন না, আপনার সন্তানও কোনদিন আপনারে ক্ষমা করতে পারব না। কারণ “ডিউটি” হইলো একটা চার অক্ষরের নোংরা শব্দ। কখনই দায়িত্বের খাতিরে কিছু কইরেন না, কখনই না। যদি করেন, তাইলে বুইঝা নিয়েন আপনে এইটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে করতেছেন। আর যার জন্যে করতেছেন তাঁরে আপনে আসলে হিউমিলেট করতেছেন।

শিশুরা হইলো ফুলের মত। গোলাপের প্রতি আপনার কি এমন দায়িত্ব থাকতে পারে বলেন? থাকলে সেইটা কি? অবশ্য আপনে ফুল গাছে পানি দেন, কিছু টেইক কেয়ার করেন, কিন্তু এইগুলা আপনে দায়িত্ব থাইকা করেন না। এইগুলা করেন আপনার মনের আনন্দে। গোলাপগুলা বড় হবে, বেশী বেশী সুগন্ধ ছড়াবে। আপনে এইটার প্রতি যতটুকু দয়া দেখান তাঁর তুলনায় আপনে এইটার কাছ থাইকা যা পাইবেন তা অনেক বেশী কিছু। আপনে গোলাপ গাছগুলারে আসলে কোন দয়া করেন না। যেইটা করেন সেইটা ভালোবাসা। গোলাপ গাছগুলা আসলে আপনারে দয়া করে। আপনার একটু পানি দেওয়া আর একটু সেবা যত্নের বিনিময়ে ফুলাগুলা আপনারে যা দেয় তা অনেক বেশী। আপনার পুরা বাড়ি ফুলের সৌরভে ভইরা উঠে, আপনার বাড়িটা কোন সাধারণ বাড়ি থাকে না, আপনার বাড়িটা একটা স্বর্গে পরিণত হইয়া যায়। ঠিক একই ঘটনা ঘটে শিশুদের ক্ষেত্রে। শিশুরাও ফুল। তাঁদেরকে পরিপুষ্ট কইরা তুলেন। কিন্তু এই কইরা তুলাটা আপনার দায়িত্ব না, এইটা হইলো আপনার ভালোবাসা। যদি আপনার এই করার মধ্যে কোন ভালোবাসা না থাকে, তাইলে তাঁদের জন্যে কিছুই কইরেন না, দয়া কইরা। অন্যথায়, আপনে আপনার বাচ্চার জীবনটা ধ্বংস কইরা দিবেন। এইখানে একমাত্র নিরাপত্তা হইলো ভালোবাসা।

একটা বাচ্চা খুবই কোমল, ভঙ্গুর। তাঁরে যত্নের সাথে পরিচালনা করেন। রেস্পন্সিবিলিটি অনেক বড় এবং ভারী একটা শব্দ। এই শব্দের ভারটা আপনার কোমল বাচ্চাটার উপর দিয়েন না, দয়া কইরা। কেন আপনে একটা বাচ্চারে বড় করার মধ্যে শর্তহীন আনন্দ খুইজা পান না? কেন তাঁরে তাঁর নিজের মত কইরা বড় হইতে সাহায্য করার মধ্যে আপনার কোন নিখাদ আনন্দ নাই? উল্টা আপনে তাঁরে তাঁর মত হইতে না দিয়া জন্মের সাথেই সাথেই একটা ধর্মের মধ্যে ঢুকাইয়া দেন। তাঁরে জিজ্ঞেসও করেন না, সে আসলে কোন ধর্মের অনুসারী হইতে চায়। কিংবা সে আদৌ কোন ধর্মের অনুসারী হইতে চায় কিনা। তাঁরে আপনে জোর কইরা ধর্মশালায় নিয়া যান। তাঁরে আপনে জোর কইরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করান। তাঁর মধ্যে আপনে নরকের ভয় ইনপুট করেন, তাঁর মধ্যে আপনে স্বর্গের লোভ ইনপুট করেন। এইটা কইরা আপনে তাঁর পুরা জীবনটাই নষ্ট কইরা দেন। এবং এইগুলা কইরা আপনে অনুভব করেন যে আপনে একটা মহৎ কাজ কইরা ফালাইছেন, আপনে আপনার দায়িত্ব পালন করছেন। এইটা আসলে কোন দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে না। এইটা মূলত দায়িত্বহীনতার মধ্যে পড়ে। যে কোন কাজ, যে কোন রেসপন্স আসা উচিত আপনার প্রেমে ভঁরা হৃদপিণ্ড থাইকা, কোন দায়িত্বের সেন্স থাইকা না। আপনে যদি সত্যিই আপনার বাচ্চারে ভালোবাসেন তাইলে অবশ্যই আপনি তাঁরে তাঁর নিজের সত্য নিজে খুইজা নেওয়ার স্বাধীনতা দিবেন, সানন্দে। আপনে অবশ্যই তাঁরে কোন ধার করা সত্য নিয়া বাইচা থাকতে দিবেন না। আপনার বাচ্চা যদি কোন ধার করা সত্য নিয়া জীবন যাপন করে, তাইলে আপনে আসলে কি করতেছেন? তাঁরে ভিক্ষুক বানাইতেছেন? আপনে যদি তাঁরে ভালোই বাসেন, তাইলে আপনি তাঁরে তাঁর নিজের যুক্তি, বুদ্ধি, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন আদর্শের কাছে নিজেরে সইপা দিতে শিক্ষা দিবেন না। বরং আপনে তাঁরে শিখাইবেন যে কোন আদর্শের কাছে নিজেরে সপে দেওয়াটা কোন গুন না, বরং আদর্শের অবাধ্য হওয়াটাই হইলো গুন। আপনে তাঁরে বলবেন, “তুমি তোমার যা ইচ্ছা পছন্দ কইরা নেও। আমাদের কাছে যা আছে তা তোমারে অফার করতেছি। আমরা যা জানি, যা বুঝি তাই তোমারে জানাইতেছি। এবং আমাদের যা আছে তা অবশ্যই পারফেক্ট না। আমাদের জীবনে আমরা যত অভিজ্ঞতা জমাইছি সবই তোমার সামনে তুইলা ধরতে পারি। বাকীটা তোমার চয়েস। তুমি তোমার মত হও। তুমি শুধু আমার সন্তানই হইবা তা না।”

আপনার সন্তান আপনার মাধ্যমেই দুনিয়াতে আসছে, তাঁর মানে এই না যে সে পুরাটাই আপনার। আপনে শুধু এইখানে একটা প্যাসেজ হিসেবে কাজ করছেন। আপনে আপনার সন্তানের কাছে একটা রাস্তার মত। ধরেন রাস্তার উপর হাঁটার সময় যদি রাস্তা বইলা উঠে, “দাঁড়াও। কই যাও?”, তাইলে ভাবেন জীবন কত কঠিন হইয়া পড়ব! ঠিক আপনেও যদি আপনার বাচ্চারে জীবনের পথে থামাইয়া জিজ্ঞেস করেন, “কি হইবা তুমি জীবনে? এইটা হও, ওইটা হও। আমি যেইটা কই, সেইটাই হইবা তুমি, বুঝলা?”, তাইলে তাঁর জীবনটা কি ওইখানেই নষ্ট হইয়া যাইব না?

তর্জমা © শরিফুল ইসলাম
নভেম্বর ১৮, ২০১৬
অশো। দ্যা লাস্ট টেস্টামেন্ট। ভলিউম ২#৩।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *