আপনার দাসত্বের গল্প

আপনে কিভাবে দাস হইয়া উঠলেন সেই গল্পটাই আপনারে এখন শোনাইতে যাইতেছি। এবং পাশাপাশি কিভাবে আপনে এই দাসত্ব থাইকা মুক্তি পাইতে পারেন সেই উপায়টাও এই গল্পের অন্তর্ভুক্ত। যদিও গল্পটা আপনারে নিয়া, তারপরেও এই গল্পের কাহিনীটা শুইনা আপনার কাছে আজগুবি লাগতে পারে। লাগলেও কিছু করার নাই, অথবা গল্পটা অন্যভাবে বলারও কোন উপায় নাই। বললে সেইটা আপনার সাথে প্রতারণা করা হবে, কারণ এইটা একটা নন-ফিকশন গল্প। যেহেতু নিজেরে নিয়া এইরকম একটা আজগুবি গল্প আপনে এখন শুনতে যাইতেছেন, তাই একটু নইড়াচইড়া সিদা হইয়া বসার জন্যে আপনারে সাজেস্ট করতেছি।

গল্প শুরু হইলো—

অন্যান্য প্রাণীদের মত মানুষও তাঁর আশেপাশের সব রিসোর্সগুলার উপরে দাপট খাটাইতে চায়, সবকিছুরে নিজের বশে আনতে চায়। এবং এই চাওয়া-চাওয়িটা যেহেতু সব প্রাণীদের মধ্যেই কমন, তাই এইটারে আলাদা কইরা তুইলা ধরার আসলে কিছু নাই। কিন্তু এই চাওয়া-চাওয়ির মধ্য দিয়া ‘মানুষ’ নামের প্রাণীটা যেহেতু ইতিমিধ্যে দাসে পরিণত হইয়া গেছে, আর অন্য প্রাণীরা আগের মতই রইয়া গেছে, তাই বিষয়টা আজকে আপনারে আলাদা কইরা শোনাইতে হইতেছে। শুরুর দিকে আপনে অর্থাৎ আমরা সবাই শিকার কইরা, মাছ ধইরা, বনে-জঙ্গলে ঘুইরা ফিরা জীবনরে যাপন করতাম। অন্যান্য প্রাণী আর আপনার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য ছিল না। কিন্তু হঠাৎ একসময় আইসা আমাদের মনে কি জানি এক যাদুকরী এবং পাশাপাশি ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটলো যে এর পর থাইকা আমরা অন্যান্য প্রাণীদের মাঝখানে নিজেরে বড় একলা অনুভব করা শুরু করলাম। আশেপাশের সবকিছুরেই আমাদের কাছে নিজেদের প্রতিকূলে আছে বইলা মনে হইতে লাগল। মৃত্যুর কঠিন ভয় আর ভবিষ্যৎ নিয়া উদ্বিগ্নতা আইসা ভর করলো আমাদের মনে। এবং এইখান থাইকাই শুরু হইল ইতিহাসের সবচাইতে বড় ট্রাজেডি, এবং একই সময়ে খুইলা গেল ইতিহাসের সবচাইতে বড় সম্ভাবনার দুয়ার।

ঠিক যখন আমাদের মনে মরণের ভয়টা ঢুকল, আহত হওয়ার ভয়টা ঢুকল এবং কারাবন্ধি হইয়া যাওয়ার ভয়টা ঢুকল, তখন থাইকাই আমরা নিয়ন্ত্রণযোগ্য প্রাণিতে পরিণত হইয়া গেলাম এবং পাশাপাশি আমরা অনেক মূল্যবানও হইয়া উঠলাম। প্রকৃতিতে মানুষ হইয়া উঠল সবচাইতে মূল্যবান রিসোর্স। মানুষ প্রকৃতিতে যা কিছুরে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তাঁর মধ্যে সবচাইতে বেশী চায় অন্য মানুষরে নিয়ন্ত্রণ করতে। কারণ অন্যান্য প্রাণীরে বশ কইরা তাঁর মধ্য থাইকা খুব বেশী বেনিফিট পাওয়া যায় না, যেমনটা পাওয়া যায় মানুষের কাছ থাইকা। অন্যান্য প্রাণীরে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভয় দেখাইয়া তাঁদের কাছ থাইকা নির্দিষ্ট কিছু জিনিস আপনে আদায় কইরা নিতে পারবেন, তবে সেইটা নির্দিষ্টই। যেমন আপনে একটা কুকুর, বিড়াল, গরু অথবা ছাগলরে চাইলেই তাৎক্ষণিক ভয় দেখাইতে পারবেন। কারণ এই প্রাণীগুলা সাময়িক পেইনরে ভয় পায়। কিন্তু আপনে চাইলেও একটা প্রাণীরে ভবিষ্যতের কথা কইয়া ভয় দেখাইতে পারবেন না, জেল-জরিমানার কথা কইয়া ভয় দেখাইতে পারবেন না, কিংবা টর্চার করার ভয়ও দেখাইতে পারবেন না। ইজরাইলি প্রফেসর হারারি এই বিষয়ে বলছিল, “একটা বানররে স্বর্গে একশোটা কলা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়া তাঁর হাতে থাকা একটা কলা আপনে কিছুতেই নিতে পারবেন না। বানর মানুষের মত কোন প্রকার স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস করে না।” অন্যান্য প্রাণীরা শুধু বর্তমানে বাঁচে, অতীতেও না, ভবিষ্যতেও না। একটা মুরগীরে হুমকি-ধামকি দিয়া আপনে চাইলেও বেশী ডিম পাড়াইতে পারবেন না, কিন্তু একজন ডিমওয়ালারে হুমকি দিয়া আপনে তাঁর কাছ থাইকা নিয়মিত ডিম আদায় কইরা নিতে পারবেন। মানুষ কখনই বর্তমানে থাকতে চায় না, হয় সে অতীতের নস্টালজিয়ায় ভোগে, না হয় ভবিষ্যৎ নিয়া ভয় আর উৎকণ্ঠায় সময় কাটায়। আপনার এই ভয়টা কাজে লাগাইয়াই আপনারে বানানো হইছে দাস — এইটারে বলা হয় “হিউম্যান ফার্মিং”। আর এই “হিউম্যান ফার্মিং” হইলো ইতিহাসের সবাচাইতে লাভজনক এবং ধ্বংসাত্বক ব্যবসা। এইখানে আপনারে যারা ফার্মের ভিতরে রাইখা ব্যাবসা কইরা যাইতাছে তাঁরা আপনার মতই “মানুষ” নামের প্রাণী। তাঁদেরকে এইখানে বলা যায় “ফার্মার”।

মানুষের এই সভ্যতারে যুক্তি দিয়া চিন্তা কইরা আপনে খুব একটা বুইঝা উঠতে পারবে না, যতক্ষণ না আপনে এইটারে খোলা চোখে দেখবেন। এইখানে অনেকগুলা ফার্মে ফার্মারেরা হিউম্যান ফার্মিং কইরা যাইতাছে প্রতিনিয়ত। এখন আপনার কাছে এই কথাগুলারে খুব একটা সত্যি মনে হইব না। কারণ আপনে অনুভব করেন যে আপনে মুরগির মত কোন ফার্মে বসবাস করেন না। আপনার অবশ্যই কিছু স্বাধীনতা আছে। আপনার মনে হইতেছে আপনে আপনার মত জীবন যাপন করতেছেন। আর এইদিক দিয়া আপনার সরকার অর্থাৎ “ফার্মার” আপনারে শিক্ষা, বাসস্থান, খাদ্য, পানি এবং কর্মসংস্থানের সাপ্লাই দিয়া যাইতেছে। এইটা সত্য। কিন্তু এইখানে আরও সত্য হইলো এইসব ফার্মারেরা আপনারে হেলথকেয়ার দিতাছে, কাজ দিতাছে, প্রশিক্ষণ দিতাছে কারণ আপনে হইলেন তাঁদের লাইভস্টক। এবং আপনারে তাঁরা এইসব এমনভাবে দিতাছে যাতে কইরা আপনে কল্পনা করতে পারেন যে আপনার আসলে নিজের স্বাধীনতা বইলা কিছু একটা আছে। আপনে যা করতেছেন নিজের ইচ্ছায় করতেছেন। কিন্তু আসলে মোটেও তা না। আপনারে যত বেশী “স্বাধীন” কল্পনা করাইতে পারব, তাঁরা আপনার কাছ থাইকা তত বেশী প্রডাকশন পাইব। এইটাই হিসাব। আপনে কি এখন একটু একটু দেখতে পাইতেছেন, আপনে কি ধরণের খাঁচার মধ্যে বন্ধী হইয়া আছেন?

হিউম্যান ফার্মিং এর এই প্রসেস এর মধ্যে প্রধানত কয়েকটা ধাপ আছে। প্রথমটা শুরু হইছিল প্রাচীন মিশরে। ওইটা ছিল ডিরেক্ট এবং নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া। এইখানে মানুষরে শারীরিকভাবে টর্চার কইরা তাঁদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা হইত। এবং তাঁদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে খরচ হইত প্রচুর রিসোর্স। কিন্তু এতে প্রডাকশন আসত খুবই কম। পরে দ্বিতীয় ধাপটা শুরু হইল। এইটারে বলা ‘রোমান মডেল’। এইখানে দাসদেরকে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বাধীনতা দেওয়া হইলো। এতে প্রোডাকশন বাইড়া গেল অনেক হারে। রোম সম্পদশালী হইয়া উঠল এবং সরকারের কর পাওয়াও বাইড়া গেল। সাথে আরও কিছু সম্পদ মিলাইয়া গইড়া উঠলো রোমান সাম্রাজ্য। পরে এইখানে মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নষ্ট কইরা ফেলায় এই সাম্রাজের পতন হইলো। এই কথা আপনে বোধয় ইতিমধ্যেই জানেন। এই রোমান মডেলের পতনের পরে যেই মডেলেরর উদয় হইলো সেইটারে বলা হয় “লাইভস্টক অওনারশিপ”। এইখানে আপনে এবং আপনার মত লোকদেরকে “ফার্মার”রা তাদের নিজেদের সিস্টেমের কাছে দায়বদ্ধ রাখল খাজনা আদায়ের মধ্যে দিয়া। এইভাবে খাজনা আদায় করতে করতে একসময় এই মডেলেরও পতন হইলো, কারণ ফার্মিং এর নতুন নতুন টেকনিকের উদ্ভব হইতে লাগল যেইখানে অল্প মানুষ দিয়া বেশী প্রডাকশন পাওয়া যায়। এইসব বর্ধিত প্রডাকশনের কারনে তৈরি হইতে লাগল নতুন নতুন শহর, নগর ও বন্দর। তারপরে চালু হইলো “ডেমোক্রেটিক মডেল”। যখন গ্রামের মানুষ নিজেদের উন্নতি করার জন্যে দলে দলে শহরে আসা শুরু করলো, তখন শিল্প কারখানার মালিকদের অল্প টাকায় প্রচুর শ্রমিক হাতে চইলা আসলো। এরপর এক সময় শাসক শ্রেণীর লোকজন অনুধাবন করতে পারলো যে মানুষরে তাঁর নিজের পেশা বাছাই কইরা নেওয়ার “স্বাধীনতা” দিলে তাঁদের কাছ থাইকা অনেক অনেক বেশী প্রডাকশন আদায় কইরা নেওয়া যাইব। এবং সেইটাই হইলো, এখনো হইতাছে। বর্তমানে আপনে চাইলেই আপনার নিজের পেশা নিজের পছন্দ মত বাইছা নিতে পারেন। যদিও আসলে ভালো কইরা খেয়াল করলে দেখা যায় যে আপনে পারেন না। তারপরেও কিছুটা হইলেও পারেন। এতে কইরা আপনে প্রচুর প্রডাকশন দেন এবং কর দেন, এবং এই সবই দেন আপনার প্রভুদেরকে। আর আপনে যা পান তা খুবই সামান্য।

আপনারে যতটুকু স্বাধীনতা দেওয়া হয়, সেইগুলা কেবলই প্রভুদের সুবিধার্থে। তবে এই “ডেমোক্রেটিক মডেল” এর উৎপাদন আর শ্রমিকদের স্বাধীনতা বেশী হওয়ায় প্রভুরা একটু অসুবিধায়ও পইড়া যায়। মানুষ যখন তাঁর পাওয়া স্বাধীনতায় অভ্যস্ত হইয়া যায়, তখন সে আস্তে আস্তে তাঁর অথোরিটি নিয়া প্রশ্ন তোলা শুরু কইরা দেয়। অবস্থা যখন এইরকম দাঁড়ায়, তখন রুলিং ক্লাসের লোকজন তাঁদের উৎপাদন আর ট্যাক্স পাওয়ার ধারাটা রক্ষা করার জন্যে কয়েকটা পদক্ষেপ নিয়া নেয়, অর্থাৎ নিয়া নিছে।

প্রথমেই তাঁরা সমাজের যুবক-যুবতিদেরকে একটা আদর্শের মধ্যে আটকাইয়া দিছে “শিক্ষা” নামক জিনিসটা দিয়া। আর এই শিক্ষাটা দেওয়া হয় সরকারী স্কুলগুলাতে। যতই প্রডাকশন বাড়তে থাকে, সরকারী স্কুলের সংখ্যাও ততই বাড়তে থাকে। এই শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়াই তাঁদের চিন্তা এবং সত্ত্বাটারে নিয়ন্ত্রন করা হয়। আর এতে কইরা তাঁরা রুলিং ক্লাসের বিরুদ্ধে কথা কওয়ার চিন্তাও করতে পারে না। পরের ধাপে রুলিং ক্লাস যেইটা করে সেইটা হইলো, নাগরিকদের মাঝে বিবাদ লাগাইয়া দেওয়া। মানুষরে আসলে সরাসরি শাসন করা যায় না, কিন্তু তারে যদি বিশ্বাস করানো যায় যে সে স্বাধীন, তাইলে সেই সুযোগে ঘুরাই ফিরাইয়া তারে শোষণ করা যায়। এইটা করার জন্যে রুলিং ক্লাস কিছু শ্রমিকরে তাঁদের নিজের সিস্টেমের বড় বড় পোস্টে বসাইয়া দেয়। এতে কইরা এইসব পোস্টে বসা লোকগুলাই তাঁদের নিজেদের দলের শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রন করতে থাকে শুধু প্রভুদেরকে খুশি রাখার জন্যে। সাধারণ মানুষদের মধ্য থাইকা কেউ যদি কখনো সত্যিকারের স্বাধীনতা চাইয়া বসে, তখন তারে ভায়লেন্ট হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভুদের প্রতি ভক্তি এবং দেশের প্রতি ভক্তি করার একটা মরাল সেন্স ইন্সটল কইরা দেওয়া হইছে। সর্বশেষ যেইটা করা হইছে সেইটা হইলো, সাধারণ মানুষরে একটা চলমান বাহ্যিক হুমকির মধ্যে রাখা হয় যাতে কইরা মানুষজন সব সময় নিজেদের রক্ষা করার লাইগা রুলিং ক্লাসরে রক্ষা কইরা যায়।

হিউম্যান ফার্মিং এর এই সিস্টেমটা এখন প্রায় শেষ হইয়া যাওয়ার পথে। নতুন কোন সিস্টেম আবার হয়তো চালু হইব। এখন এই সিস্টেম থাইকা মুক্তি পাওয়ার উপায় কি? অল্টারনেটিভ কোন পন্থা আছে কি এই সভ্যতারে চালাইয়া নেওয়ার জন্যে? উত্তর হইলো, যেই পন্থাই অবলম্বন করেন সেইটা যদি মানুষরে রুল কইরা সভ্যতা টিকাইয়া রাখতে চায়, তাইলে সমস্যা থাইকাই যাইব। আপনে দাসই থাইকা যাইবেন। কারন যে কোন ছোট ক্ষমতাসীন দলই পরবর্তীতে অনেক বড় হইয়া বাইর হয় এবং সেইখানে ক্ষমতার লোভ সবই নস্যাৎ কইরা দেয়। সুতরাং সিস্টেমের অল্টারনেটিভ অন্য কোন সিস্টেম হইতে পারে না। এমন একটা দুনিয়া দরকার যেইখানে কোন মানুষ অন্য কোন মানুষরে ফার্মিং করে না, যেইখানে কেউ কারো গোলাম না, কেউ কারো মালিকও না। সত্যিকারের মুক্তি পাওয়াটা একই সাথে খুবই সহজ আবার খুবই কঠিন। আপনে যে একজন দাস এই ব্যপারটা আপনে সবসময় এড়াইয়া যান, কারন এই জিনিসটা সরাসরি দেখতে পাইলে সেইটা খুবই পেইনফুল লাগে। তাই আপনে এই সিস্টেমের ভিতরেই শত ভায়লেন্সের মধ্য দিয়া ঘুইরা বেড়ান। কিন্তু এখন আসল কথা হইলো, যতক্ষণ আপনে যেই খাঁচার ভিতর বন্ধি সেই খাঁচাটা চক্ষু মেইলা দেখতে না চাইবেন, ততক্ষণ পর্যন্তই আপনারে খাঁচার মধ্যে বন্ধি কইরা রাখা সম্ভব। যখন সব দেখতে পাইবেন, তখন আর সেইটা সম্ভব না। সুতরাং আর ঘুমাইয়েন না, জাইগা উঠেন। খাঁচাটারে দেখতে পাওয়া মানেই খাঁচা থাইকা মুক্ত হওয়া।

শরিফুল ইসলাম। নভেম্বর ১৪, ২০১৬।
লেখাটি স্টিফান মলিনিউক্স এর “দ্যা স্টোরি অফ ইউর এনস্লেইভমেন্ট” থাইকা উৎসাহিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *