গল্পঃ বর্ষা ও মৃত্যুর পরশ

খস খস শব্দ করে ছোট মামা তাঁর রুক্ষ পা দুটোতে জোরসে তেল মেখে যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে তেলের শিশিটি নিয়ে নিল মামুন। বোতলটি কাত করে সাবধানে হাতের তালুতে একটু ঢেলে নিয়ে সেও মাখতে শুরু করল নিজের পায়ে। এখন আমাকেও মাখতে হবে। এটা মাছ ধরার পূর্ব প্রস্তুতি। বিলের জলে বেশিক্ষণ থাকলে পানি কামড়ায়। আর এই পানির কামড় থেকে রক্ষা পেতেই এত তেল মাখামাখি। পানি আবার কামড়ায় কিভাবে? পানির কি দাঁত আছে নাকি? নাইত! কিন্তু কামড়ায় যে এটাও তো সত্যি। সেদিন আমারও পানি থেকে উঠে আসার পর পা দুটি লাল হয়ে উঠেছিল। সেকি জ্বালা-পোড়া! সবাই বলল পানি কামড়েছে। তাহলে বোধয় পানির দাঁত সত্যিই আছে। অদৃশ্য। দেখতে পাওয়া যায়না। ছোট মামার মৃদু ধমকে পানির দাঁত নিয়ে চিন্তাটা মাথা থেকে উবে গেল। তেল মাখার পালা শেষ। এখন গন্তব্য বিলের দিকে।

বর্ষাকাল। চারিদিকে অথৈ পানি। গ্রামের গাছে ঘেরা বাড়ি গুলো বিচ্ছিন্ন দ্বিপের মত ভেসে আছে। রাতের বেলায় এই বাড়িগুলোর দিকে তাকালে এক একটা অন্ধকারের পিণ্ড মনে হয়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে আমার ভঁয় লাগে, যেন এই পিণ্ড গুলো আমার দিকেই তাকিয়ে ইশারায় ডাকছে। ঘরের জানালা দিয়ে বাহিরে কোন গাছের শাখা দৃষ্টিগোচর হলে সেটাকে শাখা নয়, কারো লম্বা হাত মনে হয়। ভঁয়ে জড়সড় হয়ে বালিশে মুখ লুকাই। রাতকে আমি প্রচণ্ড ভঁয় পাই। সারাদিন ধরে থেমে থেমে ঝরেই চলেছে বারিধারা। এবার একটু থেমেছে। আবার কখন এই গোমড়া মুখো আকাশটা কেঁদে উঠবে তাঁর ঠিক নেই। ছোট মামা লুঙ্গি গোছ দিয়ে কাঁধে ফেলুন জাল( ত্রিভুজাকৃতির জাল) নিয়ে তৈরি। সাথে আমারা দুজন সঙ্গী। আমি আর মামুন। মামুন আমার মামাত ভাই। একজনের মাছ ধরতে দুজন সঙ্গী দিয়ে কি হবে সেটা কিছুতেই মাথায় আসছিলনা। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রশ্ন করার সুযোগ ও সাহস কোনটাই আমার নেই। মামুন মাছের ঝুরিটা নিয়েছে। আমার হাতে একটা সিলভারের বোল। ঝুরির তিন ভাগের একভাগও মাছে ভরবে না। সেক্ষেত্রে আমার বোল নিয়ে যাওয়ার কোন দরকার নেই। কিন্তু নিয়ে যেতে হবে, এটাই যে নিয়ম!

গ্রামের প্রধান সরু মেঠো পথের ধারেই আমার মামা বাড়িটি অবস্থান করছে। ছোট মামা রাস্তায় এসে দাড়িয়ে ভাবছে কোন দিকে গেলে বেশী মাছ পাওয়া যাবে। আমার দৃষ্টি উপরের আকাশটার দিকে। আকাশের এমন গোমড়া মুখ যেন কোনদিনই আর রোদ উঠবে না। আকাশের এই রূপটা আমার একেবারেই ভাল লাগেনা। মামা এখনও সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। উত্তর দিকে আমার শূন্য দৃষ্টি। আঁকাবাঁকা এই পথটাকে বড় একটা জলসাপের মত মনে হয় আমার। যেন অথৈ পানির বুক চিরে একেবেকে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের বাড়ির দিকে। এই পথ দিয়ে কয়েক মিনিট উত্তর দিকে হেঁটে গেলেই আমাদের নিজের বাড়ি। সেখানে কেউ নাই। আছে ভাঙ্গা পুরাতন একটি ঘর, যেখানে এই বর্ষায় হয়তো অনেক সাপ-বিছছু আশ্রয় নিয়েছে। মা আমার ভাই বোন কে নিয়ে জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমিয়েছে চট্টগ্রামের এক বস্তিতে। আমাকে রেখে গেছে “মামা বাড়ি” নামক এই কারাগারে। কারাযাপন করছি, তবে বিনাশ্রম নয়, সশ্রম! আমিও ছিলাম মায়ের সাথে সেখানে। একদিন কি এক অজনা কারণে মা আমাকে এখানে নিয়ে এল। কত কান্নাকাটি করলাম, তাও মা আমাকে এখানেই রেখে গেল। এই বাদলা দিনে মা হয়তো আমাকে চাল ভেজে দিত, চালভাজা হাফপ্যান্টের পকেটে নিয়ে হাঁটতাম আর অল্প অল্প বের করে খেতাম। তাঁর বদলে এখন মাছের বোল হাতে নিয়ে তৈলাক্ত পায়ে ছোট মামার আদেশের অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছি। কি অসুবিধাটা ছিল আমি মায়ের কাছে থাকলে? বস্তির অন্যান্য টোকাইদের সাথে বস্তা নিয়ে কাগজ কুঁড়াতে বেরিয়ে পরতাম। দিন শেষে আধা বস্তা কাগজ নিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়ালেই মা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বুকে টেনে নিত। এখানে এক ঝুরি মাছ নিয়ে মামা-নানীর সামনে রাখলেও কেউ ঠোট দুটো ফাঁক করে একটা শুকনো হাসিও দিবে না। ওখানকার বস্তিতে কত বন্ধু ছিল! এখানে খেলতে ও পারিনা। কোন কাজ না থাকলেও মামা আমাকে তাল গাছের নিচে বসিয়ে রাখে। যখন তাল পরবে সেটা ঘরে নিয়ে আসতে হবে। আদৌ তাল পরবে কিনা তাঁর কোন ইয়ত্তা নেই।

ওখানে ডাস্টবিনে বড়লোকের ফেলে দেয়া খেলনা খুঁজতাম কয়েকজন মিলে। অনেকই ভাল খেলনা পেয়ে যেত। ভাবতাম বড়লোকরা এত বোকা কেন? এত সুন্দর ভাল খেলনা গুলো ডাস্টবিনে ফেলে দেয়! আমি কোনদিনই ভাল কিছু পাইনি। আশায় ছিলাম হয়তো একদিন পাবো। বস্তির পাশের সরু পিচঢালা রাস্তা দিয়ে অনেক রিকশা যেত। চলন্ত রিকশার পেছনে উঠে ঝুলে থাকতাম। রিকশা চলছে। আমিও চলছি। কি মজা! কিন্তু এই মজা বেশিক্ষণ স্থায়ী হতনা। রিকশাওয়ালা টের পেয়ে দিত ধমক। ভাবতাম এদেরকি পেছনে চোখ আছে নাকি! টের পায় কিভাবে? ধমক শুনে লাফ দিয়ে নেমে যেতাম। কিন্তু চলন্ত রিকশা, তাই নেমে সহজে দাড়াতে পারতাম না। পাকা রাস্তায় পড়ে গিয়ে হাঁটু দুটি ছিলে রক্ত বেরুত। তারাতারি বালি মাটি দিয়ে ক্ষতস্থান লেপে দেই যেন মা টের না পায় আমি আবারো রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছি। টের পেলে লম্বা একটা জ্বালাময়ী ভাষণ শুনতে হবে, সাথে দু-একটা চর থাপ্পড় ও ফ্রি। কিন্তু সন্ধ্যায় যখন মা পা দুয়ে দিত তখন পানির ছোঁয়া পেয়ে ক্ষতস্থানে জ্বালা করত। তখন মা বিড়বিড় করে কি যেন বলত তা বোঝার চেষ্টাও করতাম না।

ছোট মামা প্রাইমারি স্কুলটার দিকে ইশারা করে বলল, ওদিকটাতে চল। বর্ষায় স্কুলের নিচু মাঠটাও প্লাবিত। মাঠের আয়তন খুবই ছোট। একপাশে একটা বড় গর্তও আছে। এখন পানিতে ডুবে গিয়ে সকলই সমতল। মাঠে কোমর অবধি পানি। ছোট মামা পানিতে জাল নিয়ে নেমে গেছে। আমার সাতারটা এখনো শিখা হয়নি। মামুনও পানিতে নেমে গেছে। আমার পা যেন জল ছুঁইতে চাইছেনা আজ! অলসতায় শরীর ও মন দুটোই ভার হয়ে আসছে। মায়ের উপর খুবই অভিমান হচ্ছে। এখানে সারাদিন কাজ। আর রাত হলে নেমে আসে ভঁয়। মামাদের একান্নবর্তি পরিবার। রাতের খাবার খেয়ে যে যার মত ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। শুধু অতিরিক্ত থেকে যাই আমি। অবশেষে নানা নানীর বিছানায় গিয়ে শোয়ে পড়ি। নানী যেদিন তাঁর বিছানায় থাকতে দেয় সেদিন নির্ভয়ে ঘুমাই। কিন্তু মাঝে মাঝেই দুর্গন্ধ বায়ু নির্গমনের অপরাধে আমাকে তাঁর বিছানা ছারতে হয়। আমার সর্বশেষ গা এলানোর জায়গা ছোট্ট সেই নামাজের চৌকিটা। যেখানে তোশক নেই, কাঁথা নেই, এমনকি বালিশও নেই। আছে শুধু একটা শীতল পাটি। তাঁর উপরেই জড়সড় হয়ে শুয়ে পড়ি। ভঁয়ে ভঁয়ে এক সময় প্রবেশ করি ঘুমের রাজ্যে। কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে দেখি মা আমার পশমি পোশাক গায়ে দিয়ে আমার পাশে এসে শুয়েছে। তাকে দেখে কিছুই বলতে পারছিনা। শুধু তাঁর বুকে মাথাটা গুজে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। ক্ষণিক পরে মায়ের বুকে আমার অস্বস্তি  লাগতে শুরু করে। কি ব্যাপার! চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠি। মেঝো মামা তারাতারি টর্চ নিয়ে এসে বলে, কি হয়েছে?

আমি আদুরে অভিমানী গলায় আহ্লাদের সুরে বলি, “মামা, বড় বিড়ালটা এসে আমার বুকের মধ্যে শুয়ে আছে। আমি ভঁয় পাইছি।”

বলি আর ভাবি মামা বুঝি এখন বলবে, আহারে ভাগ্নে আমার, চল আমার সাথে ঘুমাবি।

কিন্তু সে উত্তরে বলে, “বিড়াল তো কি হয়েছে। ঘুমাই পর। আর আসবে না।”

উত্তরটা শুনে একেবারে চুপসে যাই। আবার ঘুমানোর চেষ্টায় মত্ত হই। ভাবি, মাকে কাছে পেলে সবকিছু খুলে বলব, নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে যাবে।

 ওখানেও রাত নামে। বস্তির পাশেই কারেন্টের খাম্বায়  সন্ধ্যা হলেই একটা বাতি জ্বলে উঠে আবার সকাল হলেই নিভে যায়। প্রতিদিনই ভাবতাম, কে এই বাতিটা জ্বালায় আবার কে নিভায়? কাউকেই তো কোনদিন সুইচ অন/অফ করতে দেখিনা!

কিরে টানে দাড়িয়ে আছিস কেন? পানিতে নাম।– ছোট মামা ধমক দিলেন। সম্বিত ফিরে পেয়ে পানিতে পা বাড়ালাম। মামা মাছ ধরে চলেছে। মাছের পরিমাণ খুবই কম। মামুনের ঝুরির তলায় কয়েকটা পুঁটি-খইয়া আর অন্যান্য মাছ। সাথে দুটো কালো রঙয়ের চকচকে ছোট(প্রি-ম্যাচিউর)  টাকি মাছ। মাছ গুলকে খুবই কিউট লাগছিল। আমি মাছ দুটিকে হাতে নিয়ে আমার সিলভারের বোলে রাখলাম। বোলের ভিতর পানি দিলাম। মাছ দুটি দৌড়াদৌড়ি করছে। আর বোলটা পানিতে ভাসছে। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে মাছগুলোকে স্পর্শ করছি। কি এক আনন্দে আমার মনটা ভঁরে উঠল। মাছ ধরতে এসেছি না কি করতে এসেছি বেমালুম ভুলে বসে আছি। হঠাৎ বোলটা কাত হয়ে মাছ গুলো পড়ে গেল। মাটি হয়ে গেল পুরটা আনন্দ, মনের উপর এসে ভর করল রাজ্যের ভঁয়। মামুন মামাকে বলে দিতেই একগুচ্ছ গালি সহ ধমক এসে আমার উপর বর্ষিত হল। দুঃখে ও অভিমানে মনটা  ভারি হয়ে উঠল। ঠায় দাড়িয়ে রইলাম এক জায়গায়, কোমর অবধি পানিতে। ছোট মামা আর মামুন মাছের সন্ধ্যানে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। আমার নড়ার ইচ্ছাও নাই। দূরে ওদেরকে দেখা যাচ্ছে। আমি পানিতে মাছ গুলকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। যদি খুঁজে পাই। ছোট মাছ, হয়তো ধরে ফেলতে পারবো। এদিক সেদিক দেখছি। হঠাৎ করে মনে হল পায়ের তলা থেকে মাটি  যেন সরে গেল। ধীরে ডুবে যেতে লাগলাম। হাত পা নাড়ছি। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। একটু আগে যার উপর এত অভিমান ছিল এখন তাকেই “মামা” “মামা” বলে চিৎকার করে ডাকছি। কিন্তু কোন আওয়াজ বেরচ্ছেনা কেন? মাটির নাগাল পাচ্ছিনা কেন? বুঝলাম আমি স্কুলের সামনের সেই গর্তটাতে পড়ে গেছি। হাত পা নাড়ার গতি ধীরে কমে যাচ্ছে। অনেক কষ্ট হচ্ছে। দম নিতে পারছি না। মামাও আসছে না।  কিছুক্ষণ পর একটা আওয়াজ মৃদুভাবে শুনতে পাচ্ছি, কে যেন আসছে। কেউ একজন পানি থেকে টেনে আমাকে উপরে তুলল। কিছুক্ষণ জোরে শ্বাস নিলাম। আমাকে শোয়ানো হল স্কুলের বারান্দায়। চারপাশে মানুষ জড়ো হয়েছে। আর উদ্ধারকারীরা সবাইকে ঘটনা খুলে বলছে। উনারা দুজন এসেছিল স্কুলের বারান্দায়। পানিতে ঝাঁপঝাপটি দেখে মনে করেছে বড় কোন মাছ। ঝাপটা ঝাপটির এক পর্যায়ে আমার হাত খানি পানির উপরে উঠে যায়। আর তাতেই  ওদের ভুল ভাঙ্গে। অতঃপর উদ্ধার করে আমাকে। ইতিমধ্যে খালা-মামারাও এসেছে। তাদের চেহারায় আতঙ্কের ছাপ। তবে সেই চেহারায় আমার জন্য ভালবাসা নেই, আছে ভঁয়।

শরিফুল ইসলাম ১০/১০/২০১২
বই “স্বপ্ন দিয়ে বোনা”য় প্রকাশিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *