মুভি বারাকা, সামসারা, লাইফ ইন অ্যা ডে — জীবনের একই সুরে গাঁথা তিন আখ্যান

ধইরা নিলাম আপনে এই মুভি তিনডার একটাও দেখেন নাই, যদি দেইখাও থাকেন। তাই আপনেরেই বলি, এর আগে যত মুভি দেখছেন, সবগুলা একপেশে ভাবে আপনিই দেখছেন। কিন্তু এইখানে ঘটনাডা ঘটব উল্টা। এইখানে মুভি গুলা আপনারে দেখবো। মুভি আবার দেখে ক্যামনে! হ, মুভিই আপনেরে দেখবো। মুভি প্লে করার কিছুক্ষণের মধ্যে খেয়াল করবেন মুভির স্ক্রিনটা পলকহীন চোখে চাইয়া আছে আপনের দিকে। দেখবেন এমন গভীর ভাবে তাকাইয়া আছে যেইভাবে আপনার প্রেমিক/প্রেমিকাও আপনের দিকে কখনও তাকায় নাই। প্রথমদিকটায় আপনে এক রকম অস্বস্তির মধ্যে পইড়া যাইতে পারেন। ধীরে কিছু সময় গড়ানোর পর টের পাইবেন আপনার আর মুভির মইধ্যে নীরবে চোখাচোখি চলতেছে যেইটারে এক ধরনের সাইলেন্ট কনভারসেশনও বলা যায়। বলে রাখা ভালো এই মুভি তিনটার একটাও কমার্শিয়াল মুভি না, ডকুমেন্টারি মুভি। এখন প্রশ্ন হইল যেই ডকুমেন্টারি মুভি আপনারে দেখবো এমন মুভির সামনে আপনার মুল্যবান সময় ব্যয় কইরা নিজেরে কেন দেখাবেন? চলেন এই প্রশ্নের উত্তরটা নিয়া আলোচনা করি।

এই দুনিয়াডা বড় রহস্যময়। আরও রহস্যময় হইল কোয়ান্টাম ফিজিক্স, টাইম, স্পেস, গ্যালাক্সি, ব্ল্যাকহোল, ইউনিভার্স ইত্যাদি। এতসব রহস্য নিয়া বিজ্ঞ লোকেরা অনেক মাথা ঘামাইলেও সাধারন মানুষ রেস্তোরাঁয় খাওয়া আর সেলফি তোলা নিয়া মাথা ঘামাইতে গিয়া রহস্য ঘাটার টাইম পায়না অথবা জানেওনা কিভাবে রহস্য ঘাটতে হয়। তবে আপনে বিজ্ঞ আর সাধারণ যেই হননা কেন, যেইটা আপনের জানা জরুরি সেইটা হইলঃ সব রহস্যের বড় রহস্য হইল আপনি নিজে। হ, আপনিই। আপনার পায়ের নখ থেকে শুরু কইরা মাথার চুল পর্যন্ত প্রতিটা ক্ষুদ্রাংশে হাজারো রহস্য কিলবিল করে। আপনি রহস্যের আধার। আপনি বিশাল। আপনি যে কত বিশাল তা পরিমাপ করার ক্যাপাসিটি পৃথিবীর কারো নাই, কেবল আপনি ছাড়া। আপনার ভেতরে পুরো ইউনিভার্সের অস্তিত্ব বিরাজ করে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই আপনাকে কেন্দ্র করেই আবর্তন করে। এইসব কথা আপনারে ইন্সপায়ার করার লাইগা বলতাছিনা। কারণ আমার ইনটেনশন আপনারে ইন্সপায়ার করা না, আমার ইনটেনশন হইল শুধু ফ্যাক্ট তুইলা ধরা। তবে এতসব বিশেষণও সত্যিকারের আপনারে তুইলা ধরতে পারেনা। আপনি আরও বড়। কিন্তু এত বড় হইয়াও আপনি অথবা আমি অথবা আমরা কেন একটা ক্ষুদ্র মিজারেবল লাইফস্টাইলে আটকা পইড়া যাই? কারণ আপনি আর আমি একটা বড় ধরণের ইনভিজিবল ষড়যন্ত্রের শিকার। এই ষড়যন্ত্র শুরু হয় আপনের জন্মের পর থাইকাই। আরেকটু আগ বাড়াইয়া বললে বলা যায় মায়ের পেট থাইকাই। প্রশ্ন হইল এই ষড়যন্ত্রকারী কারা? তাঁরা হইল আপনের বাবা-মা, শিক্ষক, পাড়া-প্রতিবেশি, সব মিলাইয়া যেইটারে বলা হয় ‘সোশ্যাল ইনসটিটিউশন’। জন্মের পরপরই এই সামাজিক প্রতিষ্ঠান আপনেরে বলতে থাকে আপনি কি করবেন আর কি করবেন না, আপনে কে আর আপনি কে না, আপনের কি হওয়া উচিত আর কি হওয়া উচিত না। প্রথমেই আপনের একটা নাম রাইখা সেই নামে আপনেরে ডাইকা আপনের গায়ে প্রথম পরিচয়ের সিলডা মাইরা দেয়। এরপর থাইকা আপনের প্রোফাইলে যোগ হইতে থাকে একের পর এক পরিচয়ঃ পারিবারিক পরিচয়, জাতীয় পরিচয়, সামাজিক পরিচয়, একাদেমিক পরিচয় ইত্যাদি। এইসব পরিচয়ের নিচে চাপা পইড়া যাইতে থাকে সত্যিকারের ‘আপনি’টা। আর দিনে দিনে আপনি হইতে থাকেন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর। আপনি হইয়া যান একজন সরু জাতীয়তাবাদী, ভুয়া কিছু পরিচয়ের এক ফেরিওয়ালা। ঘুইরা ঘুইরা নিজেরে বেচেন, যেইটারে বলা হয় চাকুরী। আপনি ভুইলা যান আপনি কে। মুভি তিনডার কাজ হইল আপানারে মনে কইরা দেওয়া আপনি আসলে কে। সে জন্যই আপনে মুভি গুলা দেখবেন।

12400977_1174559682557106_5727858119221587723_n

আসেন এইবার মুভি গুলা নিয়া একটু ক্যাচাল করি। বারাকা (১৯৯২) আর সামসারা (২০১১) একই ডিরেক্টরের বানানো একই রকম মুভি। আপনি চাইলে যে কোন একটা মুভি ইগনোর করতে পারেন। তবে দুইটাই হাইলি রেকমেনডেড। সামসারা (২০১১) বানানো হইছে পাঁচ বছর লাগাইয়া। ২৫ টা দেশে শুটিং হইছে ৭০ এমএম ক্যামেরা ফরমেটে। মুভি দুইটার ইউনিকনেস হইল মুভিতে কোন ডায়লগ নাই, ভয়েস ওভারও নাই অর্থাৎ মুভি গুলা “নন ন্যারেটিভ”। কোন রকম কথা বার্তা ছাড়াই, শুধু মিউজিক আর ভিডিওগ্রাফি দিয়া আপনারে দুই ঘণ্টা কামড় দিয়া ধইরা রাখতে সক্ষম মুভি দুইটা। মুভি গুলা আপনেরে দেখাইব পুরা বিশ্বের হিউম্যান লাইফ, ধর্ম, বর্ণ, রিচুয়াল, টেকনোলজি, মানুষের রং-ঢঙ্গ, বিশ্বাস আর জীবন ধরণের একটা স্যাটেলাইট ভিউ। যেইটা থাইকা আপনি শিশুকাল ধরেই বঞ্চিত। গ্লোবালাইজেশন এর যুগে আপনি অনেক কিছু দেখলেও আসলে কোন কিছুই দেখেন নাই। যা দেখছেন বা জানছেন সবি বায়াসড। কারণ যাই দেখেন সব কিছুই আপনি আপনার সামাজিক প্রতিষ্ঠানের দেয়া মতাদর্শ দিয়া ফিল্টার দিয়া নেন। মুভি গুলা আপনার এই ফিল্টারটা ভাইঙ্গা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আপনেরে মুক্ত করার চেষ্টা করছে আপনার নিজের কাছ থেকেই। মুভি গুলা আপনের লগে কথা বলবে নীরবে এবং শেষ করবে আপানার লগে একটা বোঝাপড়ার মধ্য দিয়া।

lifeinaday

লাইফ ইন অ্যা ডে (২০১১) একই মেসেজের একটু অন্য ধাঁচের মুভি। মুভিটা শুট করা হইছে এক দিনে, জুলাই ২৪, ২০১০। এই মুভির ভিডিওগ্রাফার হইলো সাধারণ মানুষ। ৯৪ মিনিটের এই মুভিটা বানানো হইছে সাধারণ মানুষের পাঠানো ৪৫০০ ঘণ্টার ভিডিও ক্লিপ্স থেকে। ভিডিও ক্লিপ্স আসছিল ১৯২ টা দেশ থেকে। এই মুভিতে বাংলাদেশকেও দুই/তিনবার দেখানো হয়। দেখানো হয় একই দিনে সারা বিশ্বে মানুষ কত ভাবে, কত রকমের অনুভূতি, কত রকম ঘটনার মধ্য দিয়া জীবন অতিবাহিত করে। আপনাকে দেখাবে জীবনের একটা পূর্ণাঙ্গ ছবি যা আপনি সচরাচর দেখেন না, দেখলেও ইগনোর করেন। দেখবেন ঠিক যেই মুহূর্তে আপনি খুব খুশি, সেই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে কেউ খুব দুখি, কোন প্রান্তে কেউ মারা গেছে, কারো বিয়ে হইছে, কারো ব্রেকাপ হইছে আবার ঐ মুহূর্তেই কারো জন্ম হইছে। দেখবেন পৃথিবীর মানুষ কত বিচিত্র, আবার মনে হবে যেন সবাই এক, সবাই আপনার মতই, আমার মতই। সবাই আপনি, সবাই আমি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *