মুভি দ্যা থিন রেড লাইন (১৯৯৮)— একটা আধ্যাত্মিক অ্যান্টি-ওয়ার মাস্টারপিস

রিভিওর শুরুতেই ‘আধ্যাত্মিকতা’ জিনিসটারে সংক্ষেপে একটু খোলাসা কইরা দেই, যেহেতু বিষয়টা খুব ওয়াইডলি মিসআন্ডারস্টুড। তারপর আপানারে নিয়া যাবো দশ হাজার বছর পেছনে। তারপর নিয়া যাবো মুভিতে। যাইবেন? গেলে চলেন। তাঁর আগে আপনার প্রতি জিজ্ঞাসা হইল, ‘আধ্যাত্মিকতা’ শব্দটা শুনলে আপনার মনের আয়নায় ঠিক কি ধরনের চিত্র ভাইসা উঠে? খুব সম্ভবত ইতিমধ্যেই একজন মধ্য বয়স্ক অথবা বয়স্ক দাড়িওয়ালা সাধু টাইপ লোকের ধ্যানের ভঙ্গিতে ঝিম মাইরা বইসা থাকার দৃশ্য, অথবা সেলাই বিহীন কাপড় গায়ে জড়ানো কোন বুদ্ধ ভিক্ষুর চেহারা, অথবা অত্যাধিক ধার্মিক কোন লোকের নিরস লাইফ স্টাইলের দৃশ্য ভাইসা উঠছে। এমন দৃশ্য ভাইসা উঠাটা স্বাভাবিক। কারণ বেশীরভাগ মানুষই ব্যাপারটা এইভাবেই দেখে। কিন্তু মজার বিষয় হইল, আধ্যাত্মিকতার সাথে এই সকল বিষয়ের তেমন জোরালো কোন সম্পর্ক নাই। আধ্যাত্মিক কোন মানুষ যদি এইরকম লাইফ স্টাইলে চলে, তাহলে এইটা হবে তাঁর নিজস্ব চয়েস। আপনি চাইলে ব্যস্ততম কর্পোরেট অফিসের ডেস্কে বইসাও আধ্যাত্মিক হইতে পারেন, এর জন্যে গুহায় বইসা ধ্যান করার কোন দরকার নাই। আধ্যাত্মিকতার শুরু, শেষ আর মূলমন্ত্র নির্ভর করে মূলত একটা প্রশ্নের উপর। প্রশ্নটা হইলঃ আমি, আপনি আর আমরা আসলে কে? যুগে যুগে সকল আধ্যাত্মিক গুরুরা এই একটা প্রশ্নের উত্তর খুইজা বেড়াইছে। অনেক জটিল একটা প্রসেসের মধ্য দিয়া গিয়া উনারা যেই উত্তরটা খুইজা পাইছে তা হইলঃ সকল আরোপিত পরিচয়ের নিচে চাপা পইড়া আছে আমাদের সত্যিকারের পরিচয়। তাঁরা দেখল ‘আমি, তুমি আর সে’ এই রকম কোন ভাগাভাগি আসলে মানুষের মধ্যে নাই, যদিও আমরা কইরা রাখছি। পুরা ভাগাভাগিটাই একটা ইল্যুশন মাত্র। নাই কোন জাতিভেদ, ধর্মভেদ, বর্ণভেদ। পুরো বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড একটা ‘কসমিক ফ্যামিলি’। অর্থাৎ তাঁরা যার দিকেই তাকায় দেখতে পায় সবাই ‘আমি’, সবাই এক, সবকিছুই একটা বিন্দু থাইকা উৎসারিত। এখন প্রশ্ন হইল, বিষয়টা এমন হওয়ার পরেও মানুষে মানুষে কেন এত ভেদাভেদ, ভাগাভাগি, হানাহানি, মারামারি আর যুদ্ধ লাইগাই আছে? এই সবকিছুর মূলে কাজ করে মানুষের ভিতরে বাস করা ‘ফিয়ার’ অর্থাৎ ভয়। এইবার চলেন দশ হাজার বছর পেছনে গিয়া মানুষের এই ‘ভয়’ এর ইতিহাসটা জাইনা নেই।

‘কৃষি বিপ্লব’ এর আগে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন বছর ধরে মানুষ নিজেদের খাবার যোগাইত বন্য গাছপালা আর বন্য পশু পাখী শিকারের মাধ্যমে। তাঁদেরকে বলা হয় ‘হান্টার গ্যাদারার’। তাঁরা দল বাইন্দা থাকত, দল বাইন্দা শিকার করত আর দল বাইন্দা ঘুমাইত। কোন এলাকায় পশু পাখির কমতি দেখা দিলে জায়গা পরিবর্তন করত। তাঁদের মধ্যে তখন কোন ভাগাভাগি ছিল না। যতদূর চোখ যায় অথবা যতদূর পায়ে হাইটা যাওয়া সম্ভব সবটাকেই নিজের ঘর বাড়ি মনে করত। উপরের পুরা আকাশটাকেই নিজের মনে করত। কোন বর্ডার ছিল না, মানচিত্র ছিল না এবং ছিল না কোন জাতীয়তাবাদ। কিন্তু ঝামেলাটা বাঁধছে ৯৫০০-৮৫০০ খ্রিস্ট পূর্বে, যখন মানুষ প্রথম গম আর ছাগল ডোমেসটিকেট করা শুরু করল। তারপর শুরু হইল কৃষি কাজ, এই কাজের জন্যে দরকার পড়ল জমিজমার। যেখানে আগে নারীপুরুষরা দিনের নির্দিষ্ট একটা সময় শিকার কইরা, বাকি সময় খাইয়া দাইয়া, গল্প কইরা, ঘুমাইয়া কাটাইত, সেইখানে কৃষি কাজ শুরুর পর সবাই দিনরাইত মাঠে কাজ করা শুরু করল। শুরু হইল ‘আমার জমি’ আর ‘তোমার জমি’র কনসেপ্ট, শুরু হইল ভাগাভাগি। তারপর আসলো ‘আস ভার্সেস দেম’ অর্থাৎ ‘আমরা বনাম তোমরা’ এই কনসেপ্ট। শুরু হইল শত্রুতা। আর শত্রুদের হাত থাইকা এই ‘আমরা’ কে রক্ষা করার একটা প্রয়াস থেকে মানুষের মনে জায়গা কইরা নিল এক ধরনের ‘ভয়’। আর এই ‘ভয়’ এর উপর ভঁর কইরা পৃথিবীতে সকল মারামারি, হানাহানি আর যুদ্ধ চলতে থাকল। মানুষ ভুইলা গেল যে তাঁরা সবাই আসলে এক।

redlinetrooptransport

এইবার চলেন মুভিতে ঢুইকা পড়ি। যুদ্ধের ভয়াবহতা, নৃশংসতা আর অর্থহীনতাকে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়ায় তুইলা ধরা হইছে এই মুভিতে। মুভির সেটিং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মুভির কাহিনীটারে বলা হয় ‘ব্যাটেল অফ মাউনট অস্টেন’ এর ফিকশনালাইজড ভার্সন। পরিচালক টেরান্স ম্যালিক এই মুভি বানানোর আগে চলচিত্র জগত থাইকা বিশ বছরের একটা দীর্ঘ বিরতি নিছিলেন। তিনি এই মুভিতে কাস্ট করছেন বিখ্যাত সব তারকাদের। এই মুভিতে তারকার পরিমাণ একটু বেশিই। তাঁরা হইলঃ নিক নলতে, এডরিয়েন ব্রডি, জর্জ ক্লুনি, জন কুশ্যাক, ওডি হ্যারালসন, এলিয়াস কটেস, জেয়ারড লেটও, জন রেইলি আর জন ত্রাবলতা। কিন্তু মজার বিষয় হইল, মুভিতে পরিচালক এদের কারো উপরেই ফোকাস করে নাই, কারো উপরেই ক্যামেরা বেশিক্ষণ তাক কইরা রাখে নাই। সোজা কথায় বলা যায়, পরিচালক এই মুভিতে কাউরেই বিশেষভাবে বেইল দেয় নাই। ফলে মুভিতে আপনি কোন কেন্দ্রীয় চরিত্র খুইজা পাইবেন না। আর এইটাই হইল এই মুভির আসল সৌন্দর্য। মুভিতে কোন নির্দিষ্ট ক্যারেক্টার ডেভেলাপম্যানট না পাইয়া অনেকই এই মুভি দেইখা ক্ষেইপা গেছে। আইএমডিবিতে ঢুকলেই তাঁদের রিয়েকশান দেখতে পাইবেন। কারণ, বেশীরভাগ দর্শকই মুভি দেখতে গিয়া একটা নির্দিষ্ট ক্যারেক্টারের উপর ভঁর কইরা তাঁর সাথে নিজেরে রিলেট কইরা মুভি দেখতে পছন্দ করে, এইরকম না হইলে তাঁরা মুভি দেইখা আরাম পায় না। কিন্তু এইটা আর দশটা ওয়ার মুভির মত সস্তা জাতীয়তাবাদ নিয়া বানানো হয় নাই। বরং মানুষের ভিতরে বইসা থাকা সরু জাতীয়তাবাদকে ঝাঁটাইয়া বিদায় করার চেষ্টা করছে। আর যেহেতু এইখানে আধ্যাত্মিকতার ‘সবাই এক’ তত্ত্বটা তুইলা ধরা হইছে, তাই মুভিতে নির্দিষ্ট কোন চরিত্ররে খুব বেশী পাত্তা দেওয়া হয় নাই। সেই জন্য আপনার মুভিটা দেখতে আরাম নাও লাগতে পারে। কেউ কেউ আক্ষেপ কইরা বলে, এই মুভি যেই বছর রিলিজ হইছে সেই বছর ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ রিলিজ হইছিল; আর ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ এর খ্যাতির নিচে চাপা পইড়া এই মুভি আন্ডার এপ্রিশিয়েটেড থাইকা গেছে। কথাডা মনে হয় সত্য, যদিও এই মুভির সাথে অন্য কোন ওয়ার মুভির তুলনা চলে না।

dvd_thin
মুভির রান টাইম ২:৫০ মিনিট। মুভির সেটিং, সাবজেক্ট ম্যাটার আর কাহিনীর ভিত্তিতে বলা যায় এই রান টাইমটা হইল ‘পারফেক্ট লেন্থ’। কিন্তু এই মুভির ফার্স্ট কাটের রান টাইম ছিল ৫ ঘণ্টা, যেইটা একটানা সাত মাস লাগাইয়া এডিট করা হইছিল। ফাইনাল কাটে অনেক কিছু বাদ দিয়া ২:৫০ মিনিটে নিয়া আসছে। পুরা মুভি শুরু থাইকা শেষ পর্যন্ত আপনারে ধইরা রাখব তাঁর ভয়েস ওভার ন্যারেটিভের উপর। অন্য যে কোন ওয়ার মুভির মত এই মুভিটা খুব একটা ইজি ওয়াচ না হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। কারণ মুভির ন্যারেটিভ স্ট্রাকচারটা হইল একটু কমপ্লেক্স।

মুভির শুরুতে দেখা যায় ১৯৪২ সালের দিকে ইউ এস আর্মির পলাতক প্রাইভেট উইট তাঁর ইউনিট নিয়া সাউথ প্যাসিফিক আইল্যান্ডের লোকালদের সাথে সুখে শান্তিতে বসবাস করতেছিল। কিন্তু তাঁর কমান্ডার সার্জেন্ট অয়েলশ তাঁরে খুইজা বাইর কইরা জোর কইরা সেই শান্তির আইল্যান্ড থাইকা নিয়া যায় যুদ্ধের ময়দানে। যুদ্ধটা হয় জাপানিজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে। কাহিনীতে দেখানো হয় সৈন্যদের বিচিত্র রকমের ভাগ্য, যুদ্ধের প্রতি তাঁদের আচরণ, আবেগ এবং জীবন-অথবা-মৃত্যু পরিস্থিতিতে তাঁদের ভয়াবহ অনুভূতি। অন্যসব ওয়ার মুভির সাথে এই মুভির এক জায়গায় মিল আছে। সেইটা হইল, সব ওয়ার মুভিতে দেখবেন সৈন্যরা প্রথমে “দেশপ্রেমে” উল্লসিত হইয়া যুদ্ধ করতে যায়। প্রথম দিকে শরীরে ব্যাপক জোস থাকে। কিন্তু যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যখন সবাই প্রায় বিধ্বস্ত আর ক্লান্ত। যখন চারিদিকে শুধু রক্তের গন্ধ, তখন সবকিছু কেমন জানি একাকার হইয়া যায়। আগের জোসটা আর থাকে না। সৈন্য গুলো তখন অনুভব করে,

কিসের জন্যে যুদ্ধ করছি, কার জন্যে করছি, কেন করছি, কাকে মারছি, কেন মারছি, কে আমার শত্রু, সে কি আসলেই আমার শত্রু, যাকে শত্রু মনে করছি তাঁর আর আমার মাঝে পার্থক্যটা আসলে কোথায়?

এই মুভিতে এই জিনিসটা খুব জোরালো ভাবে দেখানো হয়। মুভিতে এইরকম একটা মুহূর্তে ভয়েস ওভারে বলা সবচেয়ে টাচি আর গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হইল, “কোথায় সেটা, যখন আমরা সবাই একসাথে ছিলাম? তুমি কে, যার সাথে আমি থেকেছি? ভাই। বন্ধু। অন্ধকার। আলো। ক্রোধ আর ভালোবাসা। এই সব কিছুই কি একটা জায়গা থেকে উৎসারিত? এই সব কিছুই কি একই চেহারার বিভিন্ন অংশ? ওহ, আমার আত্মা। আমাকে মিশতে দাও তোমাতে। আমার চক্ষু দিয়ে তাকাও চারিদিকে। দেখো সবকিছু কেমন জ্বল জ্বল করে জ্বলছে।”

রিভিও শেষ। এইবার মুভি দেখতে বইসা যান। হ্যাপি মুভি ওয়াচিং!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *