ধ্বংসের সংস্কৃতি

কেন আমরা কেবল ধ্বংস করা ছাড়া আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াইতে পারি না? কেন আমাদের সমাজ, আমাদের সংস্কৃতি সবসময় আমাদেরকে একটা অনন্য পন্থায় দেখায় যে আমরা যে পরিমাণ টাকা আর শ্রম ইনভেস্ট করি তাঁর উপযুক্ত রিটার্ন আমরা পাই না, আরও পাওয়া দরকার? কেন আমাদেরকে বুঝাইয়া দেওয়া হয় যে আমাদের অর্জিত সফলতা হইল আসলে একটা ব্যর্থতা?

আমরা দিনে দিনে এমন একটা প্রকাণ্ড টেকনোলজিকাল সভ্যতা গইড়া তুলতেছি, যেখানে একটা বাটনে টাচ কইরাই মানুষ তাঁর মনের প্রায় সব ইচ্ছা পূরণ করতে পারে। এবং অনেক কল্প কাহিনীতে যখন একজনের সব ইচ্ছা পূরণ কইরা বাস্তবে রূপ দেওয়া হয়, যেমন ধরেন কেউ অনেক সোনা দানা চাইলো এবং সেইটা সে পাইল, তখন ঐসব সোনা দানারেও কল্পিত সোনা দানাই মনে হয়, বাস্তব মনে হয় না। কারণ তাঁরা বাস্তব না। অন্য কথায়, আমাদের ব্যবহার করা বেশীরভাগ পণ্য — আমাদের গাড়ি, আমাদের বাড়ী, আমাদের পোশাক, আমাদের খাদ্য— এইসব জিনিসরেও দেখলে মনে হয় যেন এইসব আমাদের তাৎক্ষনিক ইচ্ছার ফসল, এইগুলা বাস্তব না। এবং এমন আরও অনেকভাবেই দেখা যায়, আমরা যত সম্পদ অর্জন করি তাঁর সবই ক্ষণস্থায়ী। এবং আমরা যখন দেখি যে সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী, তখন আমরা বিভিন্নভাবে হতাশ হইয়া পড়ি। আমাদের তখন মনে হয় বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হইল বেশী বেশী পাওয়া। আরও বেশী, আরও বেশী। এর ফলে পুরা দুনিয়াডার দিকে তাকাইলে মনে হয় যেন এইটা একটা বখাটে বাচ্চার থাকার ঘর, যেইখানে বাচ্চাটার অনেক গুলা খেলনা আছে কিন্তু সেইগুলা তাঁর ভালো লাগে না। হাতের কাছে পাইলে কয়েক মিনিট খেইলাই সে খেলনা গুলারে দূরে ছুইরা মারে।

এবং আমরা টাইম আর স্পেস এর বেসিক মেটেরিয়াল ডাইমেনশনের সাথে একটা ভয়ঙ্কর যুদ্ধে নিজেদেরকে উৎসর্গ কইরা দিছি। আমরা তাঁদের সকল লিমিটেশনরে মুইছা দিতে চাই। আমরা সব কিছুই খুব দ্রুত কইরা ফেলতে চাই। আমরা কাজের ছন্দ আর দক্ষতারে টাকায় কনভার্ট কইরা ফেলতে চাই, যেইখানে টাকা দিয়া আপনে খাবার কিনতে পারবেন কিন্তু টাকারে খাবার হিসেবে খাইতে পারবেন না। তারপর আমরা কাজ থাইকা পালাইয়া দৌড়াইয়া বাসায় যাই, নিজেদের উপভোগ করতে, জীবনের আসল স্বাদটা পাইতে। তারপর বাসায় গিয়া আমরা কি করি? আমাদের দেখলে মনে হয় যেন জীবনের একমাত্র রিয়েল পয়েন্ট হইল কাজ থাইকা বাসায় ফিরা ‘টিভি’ নামক একটা ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের দিকে তাকাইয়া থাকা। যেইটার ভিতরে জীবনরে রিপ্রডিউস করা হয়, যাকে আপনে স্পর্শ করতে পারেন না, তাঁর গন্ধও নিতে পারেন না, শুধু তাকাইয়া থাকতে পারেন। আপনার মনে হইতে পারে যে মানুষের বাসায় গিয়া আনন্দভোজ করা, সেক্স করা, অথবা ধুম ধারাক্কা গান বাজনা কইরা নাচানাচি করাটাই জীবনের আসল পয়েন্ট। হয়তো তাই। কিন্তু টিভি দেখার মধ্যে মানুষের এই ধরনের কোন একটিভ পার্টিসিপেশন নাই, খালি উত্তেজনাপূর্ণ একটা স্ক্রিনের দিকে তাকাইয়া থাকা। আপনে মাইলের পর মাইল দেখতে পাবেন হাজার হাজার অন্ধকার বাড়ী যেগুলার ভিতরে টিভি স্ক্রিনের আলো সারারাত মিটমিট কইরা জ্বলে। সবাই, একজন আরেকজনের কাছ থাইকা বিচ্ছিন্ন, খালি টিভিই দেখে। কারো মধ্যেই কোন সত্যিকারের কমুনিকেশন নাই। আর এই যার যার নিজস্ব জগতে বিচ্ছিন্ন হইয়া হারাইয়া যাওয়ার কারণে পুরা দুনিয়ায় তৈরি হইছে একটা বিশাল আকারের নির্বোধ জনগোষ্ঠী।

আমরা একে অন্যের সাথে কোন সত্যিকারের যোগাযোগ করি না, যতটুকু করি তা আমাদের পাবলিক এক্সপ্রেশন, অথবা শত্রুতা এড়ানোর জন্যে করি। যেমন আমরা ফুটবল খেলি অথবা বক্সিং খেলি। এমনকি টিভিতে আমরা যেসব দৃশ্য দেখি, সেইখানে মারামারি, খুনাখুনি দেখানোটা পুরোপুরি জায়েজ, কিন্তু সেখানে কোন জৈবিক ভালোবাসার দৃশ্য দেখানো কোনরকমেই জায়েজ না। যদিও দেখায়, তবে সেখানে বোঝাইয়া দেওয়া হয় যে জৈবিক ভালোবাসা, জৈবিক ঘৃণার চাইতেও জঘন্য।

আমার মনে হয়, যেই কালচারে ভালোবাসারে এইভাবে দেখা হয় সেই কালচার মূলত উম্মাদ, মূর্খ। আর এই কালচার প্রকৃতপক্ষে জীবনের দিকে নিজেরে উৎসর্গ না কইরা বরং ধ্বংস যজ্ঞে মত্ত হইয়া আছে।

—তর্জমা ।। এলান ওয়াটস ।। ব্রিটিশ দার্শনিক, লেখক ও বক্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *