চুয়াং জু’র স্বপ্ন, আমাদের বাস্তবতা আর ব্রহ্মাণ্ডের চোর–পলান্তি খেলা

আমি ঘুমাইলেই স্বপ্ন দেখি। দিনে হোক রাইতে হোক যখনই ঘুমাই, যতক্ষণ ঘুমাই ততক্ষণই স্বপ্ন দেখি। এবং আমার বেশীরভাগ স্বপ্ন মনেও থাকে। শেষ কবে আমি স্বপ্ন বিহীন ঘুম ঘুমাইছি আমার মনে নাই। আমি এত এত স্বপ্ন দেখি যে টিভি সিরিজের মত আমার স্বপ্নেরও সিরিজ থাকে। একেক দিন ঘুমাইলে একেকটা এপিসোড দেখি। এত স্বপ্ন দেখার কারণে আমার ঘুম হয় অনেক পাতলা। যার ফলে, মাঝেই মাঝেই আমার ঘুম আর জাগরণ একসাথে মিশা যায়, এবং তখন আমি অনেক সময় বুঝতে পারি না কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা বাস্তবতা। আবার মাঝে মাঝে স্বপ্নের ভিতরেও আমি স্বপ্ন দেখি। ইন্সেপশনের মত আর কি! আমার এই স্বপ্নের পরিমাণ, ধরন এবং অভিজ্ঞতাগুলো কেমন সেইটা কেবল আমার ঘনিষ্ঠ দুই-তিন জন বন্ধুই জানে, আর তেমন কেউ জানে না। অন্যদের এই না জানার কারণ, আমি জানাই নাই। আর না জানানোর কারণ, স্বপ্নরে হয়তো আমি তেমন একটা গুরুত্ব দেই না। আর দিলেও আমি নিজে এখনো কোন খ্যাতিমান ব্যক্তি হইয়া না উঠায় মানুষজনরে জানাইলেও আমার এইসব স্বপ্নরে গুরুত্ব দিবে না। বরং তাঁরা আমার এইসব কমপ্লেক্স স্বপ্নগুলারে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে “স্বপ্নদোষ” বইলা উড়াইয়া দিতে পারে। তবে ভাইবেন না যে আমি আমার স্বপ্নগুলা এখন এইখানে বর্ণনা করতে যাইতেছি। বরং এখন আপনারে একজন খ্যাতিমান ব্যক্তির একটা গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্নের কথা শোনাইতে যাইতেছি।



ব্যক্তিটার নাম হইলো চুয়াং জু। উনি হইলেন একজন প্রভাবশালী চাইনিজ দার্শনিক। সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৪ শতাব্দী। উনার দেখা স্বপ্নটারে বলা হয় “দ্যা বাটারফ্লাই ড্রিম”। এই স্বপ্নটাই সম্ভবত চাইনিজ দর্শন ইতিহাসের সবচেয়ে  প্রখ্যাত স্বপ্ন। তো স্বপ্নটা হইলো,

চুয়াং জু একবার স্বপ্নে দেখলেন যে তিনি একটা প্রজাপতি হইয়া মনের আনন্দে ফুলে ফুলে উইড়া বেড়াইতেছেন। স্বপ্নের মধ্যে প্রজাপতিটা জানতো না যে এইটা আসলে চুয়াং জু স্বপ্ন দেখতাছেন যে উনি একটা প্রজাপতি। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ তিনি ঘুম থাইকা জাইগা উঠলেন। উঠার পরে উনি কনফিউজড হইয়া গেলেন এই ভাইবা যে ‘আমি চুয়াং জু স্বপ্ন দেখলাম যে আমি একটা প্রজাপতি, নাকি একটা প্রজাপতি এখন স্বপ্ন দেখতাছে যে এইটা চুয়াং জু’। চুয়াং জু আর প্রজাপতিটার মধ্যে একটা পার্থক্য অবশ্যই থাকার কথা। আর দুইজনের মধ্যকার এই ট্রানজিশনটারে বলা হয় ‘মেটেসাইকোসিস’

চুয়াং জু’র এই স্বপ্নরে অনেকেই অনেকভাবে ব্যাখ্যা করছে এবং এখন চাইলে আপনেও করতে পারবেন। তবে ইতিমধ্যে করা ব্যাখ্যাগুলার মধ্যে সবচাইতে গ্রহণযোগ্য দাওয়িস্ট ব্যাখ্যাটার আলোকে আমি এইখানে আলোচনা করতে যাইতেছি। স্বপ্নটার প্রেক্ষিতে এইখানে মূল যেই পয়েন্টটা চোখের সামনে ভাইসা উঠে সেইটা হইলো, স্বপ্ন আর বাস্তবতা নিয়া চুয়াং জুর অনুভূত কনফিউশন। তাঁর এই কনফিউশন আমাদের দেখা বাস্তবতারে রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ কইরা যায়। আপনে যা দেখেন তা কি আপনে সত্যিই দেখেন? যারে আপনে বাস্তব মনে করেন তা কি আসলেই বাস্তব, নাকি আপনে যেইটারে স্বপ্ন মনে করেন সেইটাই বাস্তব? এইসব প্রশ্ন নিয়া ভাবতে গেলে আপনার নিজেরে পাগল পাগল লাগতে পারে, মাথায় ঝিম ঝিম অনুভব হইতে পারে। তাই এই দিকে আপনারে না নিয়া গিয়া বরং স্বপ্নটার তুলনামূলক সহজ দার্শনিক দিকটায় আপনারে নিয়া যাই।

স্বপ্নটার মূল দার্শনিক ইন্সাইট হইলো মানুষের অস্তিত্বের অহংকার এবং সেই অস্তিত্বের আকস্মিকতা। মানুষ তাঁর নিজের অস্তিত্ব নিয়া খুব গভীর কোন চিন্তা না করলেও, সে নিজের অস্তিত্ব নিয়া এক ধরণের ফাঁপা গর্ভ অনুভব করে। সে মনে করে যে, অন্যান্য প্রাণীদের চাইতে সে আলাদা এবং শ্রেষ্ঠ।

কিন্তু চুয়াং জুর স্বপ্নটা আমাদেরকে বইলা যায় যে আমরা অন্যান্য প্রাণীদের চাইতে আলাদাও না, শ্রেষ্ঠও না। এইখানে চুয়াং জু ঘুম থাইকা উঠার পরে প্রজাপতিটার সাথে নিজের একটা কানেকশন খুইজা পাইছে। আর এই কারণেই সে কি চুয়াং জু নাকি প্রজাপতি এইটা নিয়া কনফিউশনে পইড়া গেছে। এইখান থাইকা তাঁর মধ্যে প্রকৃতির অন্য সব কিছুর সাথে নিজের একত্বতার একটা অনুভব জাইগা উঠছে। তাঁর এই অনুভূতিটার অর্থ হইলো, এই ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছুই আছে, জড় এবং জীব, সবকিছুই একটা একক লাইফ ফোর্সের সাথে কানেক্টেড। সবকিছুই এক। সবকিছুর মধ্যকার পার্থক্যটা অস্থায়ী এবং অনিশ্চিত। আপনি আসলে আপনার চারপাশের কোন কিছু থাইকাই বিচ্ছিন্ন না। আপনে আপনার পায়ের নিচে মাটি এবং মাথার উপরের আকাশ থাইকা শুরু কইরা অন্যান্য মানুষ, পশু-পাখি, প্রকৃতি সবকিছুর সাথেই নিবিড়ভাবে কানেক্টেড। এইগুলা ছাড়া আপনে সারভাইব করতে পারবেন না কোনভাবেই। এই কানেকশনটা যখন আপনে দেখতে পাইবেন, তখন আপনার কাছে সবকিছুরেই আপন মনে হইব, সবাইরেই আপন মনে হইব। আর এই মনে হওয়া থাইকাই তৈরি হইব সত্যিকারের হারমনি।

কিন্তু চুয়াং জুর এই স্বপ্নের কথা বাদ দিয়া যদি আমরা বাস্তবতার দিকে তাকাই, সেইখানে এইরকম কোন হারমনি দেখতে পাওয়া যায় না। আমাদের বাস্তবতাটা অনেক বিচ্ছিরি, এবং অনেক কেয়টিক (Chaotic)। এইখানে আমরা কেউই কাউরে বিশ্বাস করতে পারি না, এমনকি নিজেরেও না। হারমনি সে তো অনেক দূরের কথা। এখন প্রশ্ন হইলো, আমাদের বাস্তবতা কেন এইরকম? এই প্রশ্নের উত্তরে আপনে কইতে পারেন, বাস্তবতা এইরকমই, এই জন্যেই এইটা বাস্তবতা, স্বপ্ন না। আমাদের এই বাস্তবতারে যদি আমরা সহজে হজম কইরা নিতে পারতাম, তাইলে এই উত্তরটাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আমরা তা পারি না। তাই এই বাস্তবতার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়া আরও ঘাটাঘাটি করাটা জরুরী হইয়া পড়ে। চুয়াং জু তাঁর স্বপ্নটা দেখার পরে সবকিছুর সাথে নিজেরে যেই রকম কানেক্টেড অনুভব করছে, আমরা বাস্তবে ঠিক তাঁর উল্টাটা অনুভব করি। আমাদের এই উল্টা অনুভূতির মূল কারণটা কি চলেন আপনারে সেইদিকে নিয়া যাই।



ইতিহাসের কোন এক সময় মানুষের মধ্যে একটা ফেটাল সেন্স ইন্সটল কইরা দেওয়া হইছে সেইটা হইলো, “সেন্স অব এলিয়েনেশন (Alienation)”। পৃথিবীতে যত বড় বড় আইডিওলজি আর কাল্ট (Cult) আসছে, গেছে এবং বর্তমানে জীবিত আছে তাঁর সবগুলাই এই সেন্সটারে প্রমোট কইরা থাকে। এই সেন্স থাইকা মানুষের মনে একটা প্রবাদের জন্ম হইছে, “আসছি একা, যাবও একা”। অর্থাৎ মানুষ মনে করে সে কোন এক জায়গা থেকে কিছুদিনের জন্যে এই দুনিয়াতে আসছে এবং সে মইরা যাওয়ার পরে আবার যেইখান থাইকা আসছে সেইখানে চইলা যাবে। এতে কইরা এই দুনিয়াটারে সে আপন কইরা নিতে পারে না। সে মনে করে যে সে এই দুনিয়াতে একজন ফরেইনার। মানুষের নিজেরে এই এলিয়েন মনে করাকরিটা তাঁর জীবন এবং পরিবেশের উপর ব্যাপক হারে প্রভাব ফালায়, অর্থাৎ ফালাইতেছে। এই বিচ্ছিন্নতার অনুভব থাইকা সৃষ্টি হয় মানুষে মানুষে ভেদাভেদ এবং মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব। আর এইখান থাইকাই উৎপত্তি হয় মানুষের ‘সেন্স অব ইনসিকিউরিটি’, যেই সেন্স হইলো সকল অপরাধ, ভায়লেন্স আর ধ্বংস যজ্ঞের মূল উৎস। কিন্তু এইখানে সত্যিটা হইলো, আপনে আর আমি আসলে এই দুনিয়ায় ফরেইনার না। আপনে এইখানকার লোকাল বাসিন্দা। আপনে এই ব্রহ্মাণ্ডের ভিতর থাইকাই উদয় হইছেন, বাইরের কোন স্পেস থাইকা এইখানে আসেন নাই এবং এইখান থাইকা আপনার যাওয়ারও কোন জায়গা নাই। এখন প্রশ্ন হইলো, মানুষ কেন নিজেরে এই দুনিয়ায় এলিয়েন মনে করে? এর প্রথম কারণ হইলো, মানুষের অনুসারিত আইডিওলজি তারে এইটা মনে করতে বলে। দ্বিতীয় কারণ, মানুষ নিজেও এইরকম কিছু একটা বিশ্বাস করতে চায়। এই বিশ্বাসটা মানুষের মনে তাঁর সর্বশেষ গন্তব্য নিয়া এক ধরণের ফ্যান্টাসির জন্ম দেয়, যা তাঁকে এই “লিটল শিটি মিজারেবল” লাইফে আটকা পড়া অবস্থায় একটু হইলেও রিলিফ দেয়। কিন্তু মজার বিষয় হইলো, এই দুনিয়ায় নিজেরে মানুষ এলিয়েন মনে করলেও দুনিয়া ছাইড়া মইরা যাইতে সে আবার অনেক ভঁয় পায়! এই অবস্থায় অনেকেই এই দুনিয়া নিয়া দুটানার মধ্যে পইড়া থাকে। আমাদের এলিয়েনেশনের সেন্স নিয়া যেই দুইটা কারণ উল্লেখ করলাম সেই দুইটার পরেও আরেকটা বড় কারণ আছে সেইটা হইলো, এই ধরায় সবিকিছুর জন্ম আর মৃত্যু, সৃষ্টি আর ধ্বংস। সবকিছুর জন্ম আর মৃত্যুই আমাদের ভেতরে এলিয়েনেশনের সেন্সটা জোরালো ভাবে প্রতিষ্ঠিত কইরা থাকে। কারণ নিজেদের এবং আশেপাশের সবকিছুর ক্ষণস্থায়ীত্বটা আমরা ঠিক মাইনা নিতে পারি না। তাই কোথাও থাইকা আসছি আবার কোথাও চইলা যাব এই চিন্তাটা আমাদেরকে একটু আরাম দেয়। এখন মূল প্রশ্ন হইলো, এই যে জন্ম আর মৃত্যু, আসা আর যাওয়া, এইগুলা তো সত্যি, আমাদের চোখের সামনেই তো সবকিছু ঘটতাছে, তো এইটারে কি বলা যায়?

এইটারে বলা হয় ব্রহ্মাণ্ডের চোর-পলান্তি খেলা। এই খেলাটা আপনে নিজে আর বাকী সবকিছু মিলা খেলতেছেন। এই খেলাটাই হইলো আমাদের অস্তিত্বের খেলা। এই খেলাটার কারণেই ব্রহ্মাণ্ডটা এত সুন্দর, জীবন এত পেইনফুল হওয়ার পরেও আকর্ষণীয়। একজন ব্রিটিশ দার্শনিক ব্রহ্মাণ্ডের এই খেলাটা নিয়া বলছিলেন,

“আপনে আপনার বাচ্চার সাথে সর্বপ্রথম কোন খেলাটা খেলেন? নিশ্চয়ই ‘হাইড এন্ড সিক’ খেলাটা।  আপনে যেইটা করেন সেইটা হইলো, মুখের সামনে একটা বই ধইরা মুখটা একবার বইয়ের পেছনে লুকান আবার বাইর করেন। এইটা দেইখা আপনার বাচ্চা খেট খেট কইরা হাইসা উঠে। এই খেলা দেইখা সে কেন হাইসা উঠে? কারণ, একটা বাচ্চা হইলো ‘রিসেন্ট ইনকারনেশন অব গড’। বাচ্চাটা জানে যে এই ব্রহ্মাণ্ডের মূল খেলাটাই হইলো ‘চোর-পলান্তি’ খেলা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে অবশ্য সেইটা ভুইলা যায়।”

এই বাচ্চাটা আসলে আপনেই। আপনারে এখন তা মনে করাইয়া দেওয়ার জন্যেই এত কথা বলা। এইখানে জন্ম আর মৃত্যু হইলো খেলার টুইস্ট। এইখানে আপনেই বার বার মরেন, আবার আপনেই বার বার জন্ম নেন। তবে বইলা রাখি, এইখানে টিপিকাল রেইনকারনেশনের থিউরি নিয়া কথা বলতেছি না। যা বলতেছি তা হইলো, আপনে মরার সাথে সাথে আপনার গল্পটার মৃত্যু হয়, এবং একই সময়ে পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তে আরেক গল্পের জন্ম হয়। এইখানে আসলে গল্প অথবা মেমরির জন্ম-মৃত্যুর খেলা চলতেছে। এই খেলায় আপনার একেবারে নাই হইয়া যাওয়ার ভঁয় নাই। আপনি চাইলেইও একেবারে নাই হইয়া যাইতে পারবেন না। কারণ আপনার অস্তিত্বের ধরন হইলো, আপনে কোথাও যাইতেছেন না, আবার কোথাও হইতে আসতেছেনও না। আপনে শুধু খেলতেছেন, প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে, নতুন কইরা।

শরিফুল ইসলাম। অক্টোবর ১৯, ২০১৬।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *