“আপনি কে?” এই প্রশ্নটার মুখোমুখি আপনে বোধয় খুব একটা হন না। কোন অচেনা লোকের বাড়িতে হঠাৎ ঢুঁ মাইরা বসলে, অথবা কোন অচেনা ফোন নাম্বারে কল দিলে কেউ আপনারে এই প্রশ্নটা কইরা বসতে পারে। আর যখন তখন আপনে নিশ্চয়ই কোন অচেনা বাড়িতে ঢুঁ মারেন না এই যুগে আইসা। সুতরাং কেবল ফোন কল ছাড়া আর তেমন কোন জায়গায় আপনারে এই প্রশ্ন সচরাচর কেউ করে বইলা মনে হয় না। যখন কেউ এই প্রশ্নটা আপনারে করে আপনে প্রথমেই আপনার নাম দিয়া উত্তরটা দিয়া দেন। তারপর আপনার পেশা আর বংশ পরিচয়টাও প্রশ্নকর্তারে জানাইতে পারেন। আর আপনার নাম শুইনাই প্রশ্ন কর্তা বুইঝা নিবে আপনে কোন ধর্মের অনুসারী, যেহেতু ধর্মটা আপনার জীবনে একটা “গুরুত্বপূর্ণ” পরিচয়। তারপর এই ঘটনাটা কোন ভিনদেশে ঘটলে সেইখানে আপনার দেশ ও জাতিগত পরিচয়ও চইলা আসব। এইসব ছাড়াও আপনার আরও অনেকগুলা পরিচয় আছে। এখন প্রশ্ন হইলো, এই পরিচয়গুলা দিয়া কি সত্যিই আপনারে ডিফাইন করা যায়? এতগুলা পরিচয়ের মধ্যে কোনটা আসলে আপনে? নাকি সবগুলাই আপনে? সবগুলা আপনে হইলে তো আপনে আর আপনে থাকলেন না। আপনে তো পরিচয়ের নিচে চাপা পইড়া গেলেন। নাকি গেলেন না? পরিচয়ের নিচে চাপা পড়ার মত কোন “আপনি” বলতে বোধয় কিছু নাই। আপনে কি আসলেই আছেন?
আপনার এই পরিচয় নিয়া আমার এইরকম সন্দেহ পোষণ করাটারে আপনে এখন নিজেও সন্দেহের চোখে দেখবেন। এইটাই স্বাভাবিক। কারণ আপনার পরিচয় নিয়া এইরকম সন্দেহ সচরাচর কেউ পোষণ করে না। কিন্তু আমি না কইরা থাকতে পারি না। এইখানে আপনার পরিচয়টা আসলে আমারই পরিচয়। নিজের অস্তিত্বরে এইভাবে প্রশ্ন করাটারে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক চোখে দেখতে পারে না। তাঁরা ভাইবা নেয় যে এই ধরণের প্রশ্ন হয় পাগলে করে, না হয় আগেকার বুইড়া দার্শনিকরা কইরা গেছে। এই ভাবনাটাও এক রকম সত্যি। নরওয়ের বুদ্ধিজীবী ইয়েস্তেন গার্ডার তাঁর দর্শন নিয়া লেখা বিখ্যাত বই ‘সফির জগৎ’ এ বলছিলেন,
“দুনিয়ার সকল শ্রেণীর সকল মানুষরে জীবনে একবার হইলেও নিজেরে ‘আমি কে?’ এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করা উচিত।”
উনার এই কথাটা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আপনে যেই হন না কেন, যদু-মধু-কদু, আপনারে জানতে হইব আপনে আসলে কে। যদি তা না জাইনাই আপনে মইরা যান তাইলে বলা যায় জীবনটা আপনে ঘুমাইয়াই কাটাইয়া দিছেন।
আপনে যদি এখন ঘুমের মধ্যে থাকেন, তাইলে আপনারে জাগানোর জন্যেই আমি আপনারে প্রশ্ন করতেছি, “আপনি কে?” তবে এইখানে বিছনায় চিত হইয়া নাক ডাইকা ঘুমানোর কথা যে বলতেছি না এইটা নিশ্চয়ই আপনে ইতিমধ্যে বুইঝা ফেলছেন। এইখানে জীবনের ওয়েটিং রুমে বইসা আপনার বেঘোর ঘুম নিয়া আলাপ করতে যাইতেছি।
এখন আপনে যদি জাগার জন্যে তৈরি থাকেন, তাইলে আপনে অবশ্যই জাইগা উঠবেন। কিন্তু আপনে যদি তৈরি না থাকেন, তাইলে আপনে ঘুমের মধ্যেই জাগার ভান কইরা পইড়া থাকবেন আর আপনার সবগুলা পরিচয়ে ঠাসা বস্তাটা কান্দে নিয়া রাস্তায় রাস্তায় ঘুইরা বেড়াইবেন। তবে যেহেতু আপনে এই লেখা এই পর্যন্ত পইড়া ফেলছেন, এবং আপনার পরিচয় নিয়া এইরকম সন্দেহ পোষণ করার পরেও এখনো আপনার চোখ আমার এই লেখার উপরে আছে, তাঁর মানে আমি ধইরা নিতে পারি যে আপনে জাগরণের পথে আছেন, অথবা ইতিমধ্যেই অনেক দূর আগাইয়া গেছেন। আর যদি আমার এই ধারনা ভুল হইয়া থাকে, তাইলে বুঝা গেল আপনে জাগরণ নিয়া নিজের সাথে নিজে মজা করতেছেন। তবে যেইটাই করেন, আপনে যেহেতু এখনো এই পেইজেই আছেন, তাইলে বলা যায় আপনে এই বিষয়ে খুব একটা সিরিয়াস না হইলেও আন্তরিক।
এখন যেহেতু আপনে জাগরণের পথে হাঁটা শুরু করছেন এবং জানতে চাইতেছেন আপনি আসলে কে, তাইলে আপনারে বলা দরকার যে আপনে এখন এই মুহূর্তে যা করতেছেন, পুরা মহাবিশ্বও এখন তাই করতেছে। আপনে এমন একটা জিনিস যে আপনে যখন যাই করেন, মহাবিশ্বও তাই করে। ঠিক যেমন সাগরের একটা ঢেউ যা করে, পুরা সাগরটাও তাই করে। আপনার সত্যিকারের আপনিটা আসলে কোন পাপেট না যে এইটারে নিয়া লাইফ খেলাধুলা করতেছে। আপনার ভেতরের গভীরের আপনিটাই হইলো লাইফ নিজে, এবং এই আপনিটাই পুরো হইলো মহাবিশ্ব।
এখন প্রশ্ন করতে পারেন, এইটা ক্যামনে হয়? আমি তো দেখতাছি আমি পাঁচ-ছয় ফুট লম্বা একটা রক্ত-মাংশের মানুষ মাত্র, আর আপনে বলতেছেন আমি মহাবিশ্ব? হ্যাঁ, আপনে-আমি এই ছোট্ট একটা মানুষই এবং এইটাই ট্রুথ। তবে এইটা আলটিমেট ট্রুথ না। আপনে-আমি রক্ত-মাংসের চাইতেও বেশী কিছু। এইটা আপনে একটু চোখ বুইঝা ভাবলেই দেখতে পাইবেন। অনেক সময় চোখ খোলা অবস্থায় আপনে যা দেখতে পান, চোখ বন্ধ করলে তাঁর চাইতেও বেশী দেখতে পান যদি আপনে দেখতে চান আর কি! এখন প্রশ্ন আসতে পারে, জীবিত থাকা অবস্থায় না হয় আপনে অনেক চেষ্টা কইরা অনুভব করলেন যে আপনে আসলে পুরা মহাবিশ্ব, কিন্তু মরার পরে কি হইব?
আপনে যখন মইরা যান, অর্থাৎ যাইবেন, আপনে কোন অন্তহীন অস্তিত্বহীনতার কূপের মধ্যে পইড়া যাইবেন না। কারণ মরার পরে মানুষের আর কোন অভিজ্ঞতা তৈরি হয় না। বেশীর ভাগ মানুষই ভঁয়ে থাকে যে মইরা যাওয়ার পরে তাঁরা একটা অন্ধকার ছোট্ট ঘরে বন্ধি হইয়া পড়বো অনন্তকালের জন্যে। অথবা পরকাল বইলা কিছু একটা আছে, তবে সেইটা কবে শুরু হইব কেউ জানে না, সেইখানে স্বর্গ-নরক নামের কোন একটাতে অনন্তকাল তাঁরা আটকা পইড়া থাকব। স্বর্গ হইলে তো ভালো, তবে নরকে আটকা পড়লে তো খবরই আছে!
কিন্তু এই দুনিয়ার সবচাইতে ইন্টারেস্টিং ব্যপারটা হইলো, আপনে একটু কল্পনা করেন যে আপনে একদিন ঘুমাইতে গিয়া আর কখনই জাইগা উঠেন নাই। তাইলে কেমন লাগব? চিন্তা করেন। এইটা হইলো ইয়গা (Yoga)— উপলব্ধির রাস্তা। আপনে এইটা নিয়া চিন্তা না করলেও বাচ্চারা কিন্তু এইটা নিয়া ভাবে। এইটা জীবনের একটা বড় বিস্ময়, “কেমন হইব যদি আমি ঘুমাইলাম, তারপর আর কখনই জাইগা উঠলাম না?” আপনে যদি এইটা নিয়া যথেষ্ট সময় ধইরা ভাবেন, ভাবতেই থাকেন। তাইলে আপনার সাথে কিছু একটা ঘটবো। আপনে অন্য সবকিছুর সাথে সবকিছুর একটা রিলেশন খুইজা পাইবেন। তারপর আপনার সামনে আরেকটা প্রশ্ন ভাইসা উঠবো, “কেমন হইব, যদি আমি কখনই ঘুমাইলাম না, কিন্তু হঠাৎ জাইগা উঠলাম?” এইটা হইলো আপনার যখন জন্ম হইছে। আপনার জন্মের আগে আপনে কই ছিলেন, কি ছিলেন তাঁর কিছুই যেমন আপনার মনে নাই, কোন অভিজ্ঞতা নাই, আপনে মরার পরেও একই ঘটনা ঘটবো।
এখন অন্যভাবে এইটারে বলতে গেলে বলা যায় যে, আমরা সবাই জানি একজন মানুষ যখন মইরা যায়, পৃথিবীর অন্য প্রান্তে কারো না কারো তখন জন্ম হয়। এবং যতগুলা মানুষই জন্ম নেয়, ঐ সবগুলা মানুষই আপনি। খালি আপনে আপনার ‘আপনি’টারে একটা লাইফটাইমে অনুভব করেন। খেয়াল কইরা দেখবেন, প্রত্যেকেই নিজেরে ‘আমি’ বইলা সম্বোধন করে। সবার নামই ‘আমি’। এবং আপনে আসলে ভালো কইরাই জানেন যে, সবগুলা মানুষই আপনি। খালি আপনে যে এইটা জানেন সেইটাই আপনে অনুভব করতে পারেন না। মহাবিশ্বে যতগুলা গ্যালাক্সি যতরকম ভাবেই আছে, তাঁদের মাঝে আসলে কোন পার্থক্য নাই। সবগুলাই আপনি। যখন একটা তারার জন্ম হয়, তখন আসলে আপনারই জন্ম হয়। আপনে হয়তো শুইনা থাকবেন বিজ্ঞানীরা প্রায়ই বলে, “You are nothing but stardust.” আপনে শুধু আপনার জন্মের আগের কথাগুলা জানেন না অথবা মনে করতে পারেন না। জানার দরকারও নাই। ঠিক যেমন আপনার গলার থাইরয়েড গ্ল্যান্ডগুলা কিভাবে কাজ করে সেইটা জানাটা আপনার দরকার মনে হয় না অথবা আপনার পুরা শরীরের অরগানিজম কিভাবে কাজ করে প্রতি মুহূর্তে আপনারে সেইগুলা নিয়া ভাবতে হয় না, আপনার অসীমতাটাও তেমনি।
আপনারে কি এই ভাবনাটা সত্যিই বিস্মিত কইরা তুলে না যে আপনে নিজে এইরকম একটা অদ্ভুতভাবে দারুন কমপ্লেক্স জিনিস?
শরিফুল ইসলাম। অক্টোবর ২৩, ২০১৬।
এই লেখা দার্শনিক এলান ওয়াটসের ‘দ্যা রিয়েল ইউ’ লেকচার থাইকা উৎসাহিত।