মুভি দ্যা ফাউনটেইন — বিজ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা, রূপকথা আর ইতিহাসের মিশ্রনে এক সুস্বাদু খিচুড়ি

ছোট বেলায় যখন প্রথম অংক শিখা শুরু করছিলেন সেইটা কি যোগ অংক দিয়া শুরু হইছে নাকি বিয়োগ অংক দিয়া? উত্তর সোজা — যোগ অংক। তারপরেও যদি আপনে ছোট বেলার কথা ভুইলা গিয়া থাকেন, তাইলে আপনেরে বলি এখনকার বাচ্চা গুলার দিকে খেয়াল করেন। দেখবেন ওরা প্রথমে যোগ অংকই শিখে এবং খুব তাড়াতাড়িই শিখে, উৎসাহ নিয়া শিখে, সে যেমন ছাত্র/ছাত্রীই হউক। কিন্তু যোগ অংকের পরে যখন বিয়োগ অংক শুরু হয় তখন উৎসাহটা ধইমা যায় এবং খুব সহজে বিয়োগ অংকের হিসাব মাথায় ঢুকতে চায়না। কেমন জানি একটা পেচ খাইয়া যায়। এমনডা কেন হয়? কারণ হইল, শিশুর জন্মের পর থাইকা শুরু কইরা অংক শিখা পর্যন্ত মাঝখানের সময়টাতে তাঁরে বিভিন্ন ভাবে বুঝাইয়া দেওয়া হয়, যা কিছু যোগ হয় তাহা উত্তম, যা কিছু খোয়া যায় বা হারাইয়া যায় বা বিয়োগ হইয়া যায় তাহা ব্যাথার, কষ্টের এবং মন খারাপের ব্যাপার। সে জন্যেই প্রথম বিয়োগ অংক করতে গেলে শিশু গিঁট খাইয়া যায়। এরপর থাইকা থিওরিটা মাথায় স্থায়ীভাবে সেট হইয়া যায়। এই একই কারণে মৃত্যুরে সবাই এত ভয় পায়, আমিও পাই। মানুষ মরতে চায়না, কাছের কোন মানুষরেও কেউ মরতে দিতে চায় না। মরণরে আমরা কখনই স্বাগত জানাই না। মরণ যেন আমাদের চির শত্রু! মরণ একটা বিয়োগ অংক। অপরদিকে জন্মরে আমরা স্বাগত জানাই। জন্মে খুশি হই। জন্ম সুন্দর, জন্ম আকর্ষণীয়, জন্ম নতুন, জন্ম চকচকা। কারণ জন্ম একটা যোগ অংক। যোগ অংক আনন্দের আর বিয়োগ অংক কষ্টের এই কথাটা কতটুকু সত্য? একটু গভীরে ঘাটলে দেখবেন এই কথাডা পুরাই ভিত্তিহীন। কথাডা একটা ইল্যুশনের উপর খারাইয়া আছে যুগ যুগ ধইরা। এবং মজার বিষয় হইল মরণরে আমরা যতটা ভয় পাই আবার একই সময়ে ততটাই পাই না। আমরা সবাই প্রতিদিন কোন না কোন আত্মহানির কাজে লিপ্ত থাকি। বিভিন্ন জন বিভন্ন ভাবে। আমরা কেউ সিগারেট খাই, কেউ মদ খাই, কেউ বার্গার খাই, কেউ আইস্ক্রিম খাই, কেউ ক্ষতিকর কিছুই খাইনা কিন্তু কথায় কথায় চেইতা যাই যেইটা আরও ক্ষতিকর। আপনি প্রতিদিন কত ভাবে আপানার নিজের ক্ষতি করেন তাঁর হিসাব অনেক লম্বা। পুরা হিসাব এইখানে দেয়া সম্ভব না। তবে করেন যে এইডা শিউর। মানুষের এই বিপরীতধর্মী আচার আচরণ বড়ই অদ্ভুত। মানুষের বিয়োগের প্রতি বা ধ্বংসের প্রতি একটা বিকর্ষণধর্মী আকর্ষণ আছে। তা থাকা সত্ত্বেও মানুষ বিয়োগরে মাইনা লইতে চায়না। বুঝতে চায়না, মরণ জন্মের মতই সুন্দর, মরণ জন্মের মতই আনন্দের। কারণ মরণ নতুনের লাইগা জায়গা কইরা দেয় (এই রিভিও পইড়া আবার নিজের গলায় দড়ি কিংবা অন্যের গলা টিপ্পা ধইরেন না যেন!)। মুভিতে এই না মাইনা লওয়া মরণের সৌন্দর্যকে তুইলা ধরার চেষ্টা করছে।

আসেন এইবার মুভিটা নিয়া একটু বাতচিত করি। মুভির প্লটটা অত্যন্ত জটিল। দেখতে বইসা মাথার এন্টেনা সবগুলা খাড়া কইরা রাখা আবশ্যক। মুভিতে বিজ্ঞান, রূপকথা, আধ্যাত্মিকতা আর ইতিহাসরে এক লগে মিশাইয়া খিচুড়ি বানাইয়া ফেলছে। এই খিচুড়ি খাইতে আপনার বিস্বাদ লাগতে পারে। প্রথম বার খাইতে গিয়া আমারও লাগছিল। কিন্তু এই খিচুড়ির রেসিপিটা যখন আপনি ধরতে পারবেন তখন বড়ই সুস্বাদু লাগবো। এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। মুভিটা আপাত দৃষ্টিতে সিম্পল রোমান্টিক সাই ফাই ক্যাটাগরিতে পড়ে। শুরুতেই দেখায় একবিংশ শতাব্দীর একজন সুদর্শন ডাক্তার তাঁর ল্যাবে খুব উৎকণ্ঠায় দিন কাটায় কারণ তাঁর ভালোবাসার সুন্দরী বউ ক্যান্সারে আক্রান্ত। খুব বেশিদিন বাঁচব না। ডাক্তার কিছুতেই মাইনা নিতে পারেনা তাঁর প্রিয়তমা বউ মইরা যাইব। তাই সে পাগলপ্রায় হইয়া একটা বানরের উপর এক্সপেরিমেন্ট চালায় কিভাবে তাঁর বউয়ের ক্যান্সারের প্রতিশেধক বানানো যায়। দিন নাই, রাইত নাই ল্যাবে পইড়া থাকে। কিন্তু এই স্টোরি লাইনটা মুভির আসল কাহিনী না। মুভির আসল কাহিনী ডিল করে “ ফিয়ার অব ডেথ”, “রিইনকারনেশন” “ট্রি অব নলেজ” আর “ট্রি অব লাইফ” এই কয়টা মেজর থিম নিয়া।

মুভিতে বুঝানো হয় মানব জাতি শুরু থাইকাই একটা বিরাট ভুল কইরা ফালাইছে। সেটা হইল মানুষ জীবনের গাছটারে না খাইয়া, নলেজের গাছটারে খাইয়া ফালাইছে। যার ফলে মানুষ হাজার বছর ধইরা একটা ‘ডুয়ালিটি’র মধ্যে বসবাস করে যেখানে মানুষ সবকিছুরে সবকিছুর লগে রিলেট করার চেষ্টা করে, এবং জীবনটা কাটাইয়া দেয় মরণের ভয় বুকে নিয়া। মানুষ মরণরে ভয় পায়, দারিদ্রতারে ভয়, পেইনরে ভয় পায়। ভয় পাইতে পাইতে আর বাঁচার সময়টা পায়না। ভয়ে ভয়েই জীবনটা কাইটা যায়। নলেজের গাছ খাওয়ার কারনে যুগে যুগে মানুষ প্রচুর জ্ঞান অর্জন করতেছে, উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছাইয়া গেছে, কিন্তু মানুষের ভিতরটার কোন উন্নতি হয় নাই। মানুষ সবি জানে, কিন্তু বাঁচতে জানেনা। যেইভাবে বাঁচে সেইটারে বাঁচা বলা যায় না। ভালো কইরা খেয়াল করলে দেখবেন রাস্তায় সব মরা মানুষ হাটতাছে, কারো ভিতরেই যেন প্রাণ নাই। প্রাণটা যেন কেউ খাবলা মাইরা নিয়া গেছে! এখন খালি শরীরটা হাটা চলা করতাছে। অন্য কথায় বলতে গেলে মানুষের নলেজ বাড়ছে কিন্তু উইজডম বাড়ে নাই। নলেজ হইল আপনি একটা গাইড বই পইড়া খুব ভালো জ্ঞান রাখেন যে কিভাবে সাতার কাটতে হয়, কিন্তু কোনদিন পানিতে নাইমা দেখেন নাই। আর উইজডম হইল পানিতে নাইমা সাতার কাটা। একইভাবে, মানুষ খুব ভালো কইরা জানে যে কিভাবে বাঁচার প্রস্তুতি নিতে হয়, এবং মরার আগ পর্যন্ত খালি প্রস্তুতিই নেয়, শেষে গিয়া খেয়াল করে জীবনে সে একটা দিনও ভালো কইরা বাঁচে নাই। আফসোস!

মুভিটারে বলা যায় একটা আন্ডাররেটেড মাস্টারপিস। আপনার হজম শক্তি বেশী না হইলে মুভিটা আপনের কাছে বাজে ঠেকবো। তাছাড়া প্রথমবার দেইখা ভালো না লাগার সম্ভাবনাই বেশী। তাই একাধিক বার দেখার জন্য রেকমেনড করতাছি। হ্যাপি মুভি ওয়াচিং!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *