শুরুতেই ভুমিকাটা পইড়া নেনঃ যেই লেখাটা আপনে এখন পড়তে যাইতেছেন এইখানে নির্দিষ্ট মতাদর্শের কোন প্রকার চিনি মেশানোর চেষ্টা করা হয় নাই। এইটা একটা চিনিমুক্ত লেখা। কিন্তু আপনার মাথায় যদি আগে থাইকাই কোন কনভার্টার সেট করা থাকে, তাইলে লেখাটা পড়তে গেলে আপনে চিনি অথবা চিরতা যে কোন একটা স্বাদ হয়তো পাইবেন। এইটা হইব আপনার মাথার ভেতরের কনভার্টারের কারণে। সুতরাং আপনে যদি কিছুক্ষণের জন্যে আপনার মাথার কনভার্টারটা ডিজএবল কইরা অথবা পুরা আনইন্সটল কইরা লেখাটা পড়তে বসেন, তাইলে লেখাটা আপনার কাছে তিতা-মিঠা কিছুই লাগব না, বরং পানির মত স্বাদহীন কিন্তু তৃপ্তিকর লাগতে পারে, আবার নাও পারে। তবে এইটা করলে আপনার শরীর ও মনে কোন প্রকার এলার্জি জাগ্রত হইব না, এইটা শিউর। ভূমিকা শেষ। এইবার মূল লেখায় চইলা যাইতে পারেন।
একটা মানব শিশু যখন মায়ের পেট থাইকা ভূমিষ্ঠ হয়, তখন সে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কান্না জড়িত কণ্ঠে একটা চিৎকার দিয়া উঠে। যদি চিৎকার না দেয়, তাইলে চিৎকার দেওয়ানোর জন্যে তাঁরে বুকে-পিঠে চাপ দেওয়া হয়, অনেকে আবার তাঁরে উল্টা কইরা ঝুলাইয়া ধরে। চিৎকার তাঁরে দিতেই হইব। যাইহোক, শিশুটা মৃত না হইলে, অথবা ঘোরতর কোন শারীরিক সমস্যা নিয়া না জন্মাইলে চিৎকার দিয়া উঠবই। শিশুর চিৎকারটা এইখানে একটা স্বতঃফুর্ত ব্যাপার। এই চিৎকার কোন শারীরিক অথবা মানসিক যন্ত্রনা থাইকা উদয় হয় না। এইটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এই প্রথম চিৎকারটা স্বতঃফুর্ত হইলেও, এর পর থাইকা বুড়া হইয়া মইরা যাওয়া পর্যন্ত জীবনে সে যতগুলা চিৎকার দেয় তাঁর কোনটাই স্বতঃফুর্ত না। সবগুলাই কোন না কোন ক্ষুধা অথবা যন্ত্রনা থাইকা আসে। অন্তত আমরা এইভাবেই জানি এবং রেসপন্স করি। সুতরাং চিৎকার হইলো যন্ত্রনার বহিঃপ্রকাশ। তাঁর উল্টাটা হইলো মানুষের হাসি। হাসি সুখকর, মানুষ যত কদাকারই হোক না কেন, হাসলে তাঁরে সুন্দর লাগে। এখন প্রশ্ন হইলো, শিশু প্রথমে দুনিয়াতে নাইমাই চিৎকার মারে কেন? চিৎকারের বদলে খেট খেট কইরা হাইসা উঠতে পারে না? এইটার উত্তরে মেডিকেল সাইন্স কইব যে চিৎকারটা শিশুর ফুসফুসে প্রথম নিঃশ্বাস নেয়ার জন্যে জরুরী। অর্থাৎ চিৎকার দেওয়ার আগে শিশুর ফুসফুসটা পুরা শুন্য থাকে। এইডা মেডিকেল ব্যাখ্যা। কিন্তু শিশুর এই চিৎকার শুধু ফুসফুসের শূন্যতা থাইকা আসে না, এইটা আসে আরও বৃহত্তর শূন্যতা থাইকা। সদ্য জন্ম নেওয়া একটা শিশু পুরা জিনিসটাই একটা শূন্যতা। শিশু কোন নির্দিষ্ট নাম, ধর্ম, দেশ, ভাষা অথবা জাতিগত পরিচয় নিয়া জন্মায় না। পুরা একটা ক্লিন স্লেট হইয়া জন্মায়। এই সবগুলাই জন্মের পরে তাঁর উপর আরোপ করা হয়। আর এই সবিকছুই করা হয় তাঁর শূন্যতাটা পূরণ করার জন্যে। শিশুটারে ধীরে ধীরে বুঝাইয়া দেওয়া হয়, যেই শূন্যতা নিয়া সে জন্মাইছে এইটা একটা নেগেটিভ ব্যাপার। এখন তাঁর কাজ হইলো এই শূন্যতাটা পূরণ করা। প্রথম দিকে শিশু এই শূন্যতাটা টের পায় না, খেলাধুলা কইরা, খাইয়া, ঘুমাইয়া তাঁর দিন চইলা যায়। তখন জীবনের প্রতি থাকে তাঁর গভীর টান, যা দেখে সব কিছুরেই তাঁর কাছে আশ্চর্যজনক মনে হয়। কিন্তু যখন সে বয়ঃসন্ধিকালে পা বাড়ায়, তখন একটা অদ্ভুত জগতে সে ঢুইকা পড়ে। সবকিছুরে তখন ঝাপসা মনে হয়, নিজের শারীরিক আর মানসিক পরিবর্তনগুলারে খুব অপ্রীতিকর লাগে। তখন তাঁর মধ্যে একটা অস্পষ্ট পাপবোধ জন্ম নেয়, যেই বোধ জন্মের পর থাইকাই তাঁর ভিতরে ঢুকানোর চেষ্টা চলতেছে। বয়ঃসন্ধির এই সময়টা যখন শেষ হয়, তখন সে বুঝতে পারে এইটা আসলে তেমন কিছুই ছিল না। এইটা যৌবনে পা রাখারই একটা প্রসেস মাত্র। যৌবনে যখন সে পাও ফালায়, তখন প্রথম সে একটা শূন্যতা অনুভব করে। তাঁর মনে হয় শুধু খেলাধুলাই জীবনে সব না, এইখানে আরও কিছু আছে। আর এই মনে হওয়াটাই হইলো তাঁর শূন্যতা। তারপর সে এই শূন্যতা পূরণের উদ্দেশ্যে ছুটতে থাকে বিপরীত লিঙ্গের পেছনে, যৌনতার পেছনে। তখন তাঁর কাছে এইটাকেই লাইফের প্রধান মিশন বইলা মনে হয়। এক পর্যায়ে যখন তাঁর এই মিশন একমপ্লিশড হইয়া যায়, তখন সে বুঝতে পারে যে যৌনতা আর নারী পুরুষের ভালোবাসাও ছোট বেলার সেই খেলাধুলার মতই। কিছুক্ষণ খেললে আর ভালো লাগে না। তারপর তাঁর ভেতরের খালি জায়গাটা আরেকটু বড় হয়। সে তখন টাকা পয়সার পেছনে দৌড়ানো শুরু করে। ভাবে যে এই জিনিসটা যথেষ্ট পরিমাণ পাইলেই বোধয় সব শূন্যতা পুরা হইব। পরে টাকা দিয়া, খ্যাতি দিয়া, বাড়ি গাড়ি দিয়া জীবন ঠাসাঠাসি হইয়া গেলেও দেখা যায় যে ভেতরে তখনো খালি জায়গা রইয়াই গেছে।
অদ্ভুত ব্যাপার হইলো, এতসব কিছু দিয়া তাঁর শূন্যতা পূরণ না হওয়া সত্ত্বেও সে এইসব জিনিসের উপর সহজে আগ্রহ হারায় না। এইসব সে চালাইয়াই যায়। কিন্তু পাশাপাশি তাঁর ভেতরে বিদ্যমান শূন্যতাটাও তাঁরে বদার করতে থাকে। তাই শিশুকাল থাইকা তাঁর জীবনে প্যারালালি যেই জিনিসটা চইলা আসছে, যেইটারে সে কিছু মানে তো কিছু মানে না, অথবা পুরাটা মানলেও পালন করে না, সেই জিনিস দিয়া সে খালি জায়গাটা পূরণ করার চেষ্টা চালায়। সেই জিনিসটা হইলো ধর্ম। ধর্মের প্রধান হর্তা কর্তা হইল ঈশ্বর। আর ম্যানেজার হইল তাঁর প্রেরিত প্রফেট। মনে করা হয় ঈশ্বরই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি যেহেতু স্রষ্টা, তাই তাঁর অস্তিত্ব মানুষের কাছে একটা অনেক বড় রহস্য। একই ভাবে মানুষের ভেতরের শূন্যতাটাও একটা রহস্য, যেহেতু এইটা কোন কিছু দিয়াই পূরণ করা যায় না। তখন একটা রহস্য দিয়া আরেকটা রহস্যরে ঢাইকা দিয়া সে যদি তাঁর পুরা জীবনটাই পার কইরা দেয়, তখন তাঁরে বলা হয় ধার্মিক অথবা মোটামুটি ধার্মিক।
কিন্তু সে যখন সবগুলা ধর্মের গভীরে গিয়া একটু ভালো কইরা চোখ বুলায়, তখন দেখতে পায় যে সবগুলা ধর্মই তাঁর নিজস্ব ডিভাইন গ্রন্থটারে একটা সার্কুলার লজিক দিয়া ভেলিডেট করে, যেইটা নরমাল যুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক, এবং সবগুলা ধর্মের ঈশ্বর আর রিচুয়ালের ধরনই আলাদা, আর তাঁরা সবাই দাবি করে যে তাঁর ধর্মটাই সত্য, বাকীগুলা ভুয়া অথবা অলমোস্ট ভুয়া। তাঁর উপরে আবার একটা ধর্মের অভ্যন্তরেও একদল আরেক দলরে ডাকে পথভ্রষ্ট। সুতরাং এইসব দেইখা তাঁর যখন ধর্ম আর ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস উইঠা যায়, তখন তাঁরে বলা হয় নাস্তিক। নাস্তিক হওয়ার পর তাঁর ভেতরের শূন্যতাটা আরও বড় হইয়া দেখা দেয়। সে তখন লাইফের পারপাস হারাইয়া ফেলে। তখন সবকিছুরেই তাঁর কাছে একরকম শূন্য মনে হয়। যখন সে দেখে যে এই জীবনের কোন অর্থ নাই এবং মরণের পরেও কোন জীবন নাই, কিন্তু ধর্মগুলা তাঁর উল্টাটা করতাছে, তখন সে এক রকম রাইগা যায়। এই রাইগা গিয়া সে যদি ধর্মরে গালাগালি কইরাই জীবন পার কইরা দেয় তখন তাঁরে বলা হয় ধর্মবিদ্বেষী।
ধর্মরে গালাগালি কইরা যদি সে কোন প্রকার মজা না পায়, অথবা তাঁর কাছে যদি এই জিনিসটা অর্থহীন মনে নয়, তখন তাঁর সমস্যাটা আরও বড় হইয়া যায়, তাঁর ভেতরের শূন্যতাটা আরও বড় হইয়া যায়। শূন্যতা পূরণের আর কোন পন্থা খুইজা না পাইয়া, তখন সে তাঁর এনিমেল ইনস্টিংকট এ ফিরা যায়। এইটা হইল মানুষের জানোয়ারগত দিক। প্রতিটা মানুষই শরীরগত দিক দিয়া একেকটা জানোয়ার। আর এই এনিমেল ইনস্টিংকটরে ফলো কইরা সে তখন ধর্ষণ, সিরিয়াল কিলিং, সন্ত্রাস সহ আরও অনেক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে মত্ত হইয়া যায়। যেহেতু এইটা মানুষের একটা ন্যাচারাল ইনস্টিংকট, তাই সে এইগুলা কইরা কিছু সময়ের জন্যে একরকম পূর্ণতার স্বাদ পায়। কিন্তু এতেও তাঁর ভেতরের খালি জায়গাটা থাইকাই যায়। সেইটা বুইঝা উঠার আগেই তাঁর পরিণতি হয় করুণ। তখন তাঁরে বলা হয় অমানুষ।
কিন্তু যদি সে ধর্মরে গালাগালি না করে এবং তাঁর এনিমেল ইনস্টিংকটরেও ফলো না করে, তখন তাঁর শূন্যতা পূরণের যাত্রা শুরু হয় শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান, আর দর্শন চর্চার মধ্য দিয়া। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ কইরা সে নিজের ভেতরের শূন্যতা এবং মহাবিশ্বের শূন্যতার রহস্য খুইজা বের করার চেষ্টা চালায়। এই খুঁজাখুঁজির মধ্য দিয়া যখন সে জীবন পার কইরা দেয়, তখন তাঁরে বলা হয় এগনষ্টিক।
খুঁজাখুঁজি করতে গিয়া সে যদি দেখে যে এই মহাবিশ্বের সবকিছুই আসলে অর্থহীন। এবং জীবনটাও অর্থহীন, বাইচা থাকলে যা, মইরা গেলেও তা। তখন তাঁর বাইচা থাকার রুচিটা নষ্ট হইয়া যায়। সে বাইছা নেয় আত্মহত্যার পথ। ইতিহাসের পাতায় তাকাইলে দেখা যায় অনেক সফল লেখক, সাহিত্যিক, সেলিব্রেটি এবং ধনকুবের জীবনে সবকিছু পাওয়া সত্ত্বেও আত্মহত্যা করছে। তখন তাঁরে বলা হয় নৈরাশ্যবাদী।
যদি সে আত্মহত্যাও না করে, আবার তাঁর ভেতরের শূন্যতাটা নিয়া দার্শনিক লেভেলও আটকা পইড়া থাকতে না চায়, তখন সে তাঁর দৃষ্টিটারে বাকী সবকিছু থাইকা কিছু সময়ের জন্য হলেও সরাইয়া নিয়া শুধু শূন্যতার উপরে মনোনিবেশ করে। সে ভাবতে থাকে, কি এই শূন্যতা? কেন এইটা কোন কিছু দিয়াই পূরণ করা যায় না? প্রশ্ন করতে করতে সে চইলা যায় শূন্যতার গভীরে। এইভাবে সে একপর্যায়ে আবিষ্কার করে যে মানুষের এই শূন্যতা আসলে পূরণ হওয়ার না। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার লাইগা না। এই শূন্যতাই মানুষের আসল সত্ত্বা। এই শূন্যতা দিয়াই পুরা মহাবিশ্ব গঠিত। এই শূন্যতারে ভালোবাসাই পূর্ণতার একমাত্র পথ। সে আরও দেখতে পায় যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব যতটুকু রহস্যময়, তাঁর নিজের শূন্যতাও ততটুকুই রহস্যময়। তাঁর কাছে পুরা মহাবিশ্বরেই মনে হয় একটা টোটাল শূন্যতার আধার। আর এই পুরা শূন্যতাটারেই তাঁর কাছে মনে হয় ঈশ্বর। তখন সে ঈশ্বরের সাথে এক হইয়া যায়, একই সময়ে সে নিজেও ঈশ্বর হইয়া যায়। তখন তাঁরে বলা হয় আধ্যাত্মিক।
এইরকম আরও অনেক ছোট বড় ধাপের মধ্যে দিয়া মানুষ তাঁর শূন্যতারে নিয়া ডিল করে। এইখানে বর্ণিত প্রতিটা ধাপ মানব জাতির একেকটা দলরে আলাদা কইরা রিপ্রেজেন্ট করে। এইগুলা যেই সিকোয়েন্সে বর্ণনা করা হইছে, সেই সিকোয়েন্স কাটায় কাটায় মিলব এমন কোন কথা নাই। কোন ধাপরে খারাপ অথবা ভালো হিসেবে মরালাইজ করার দায়িত্ব এই লেখায় পালন করা হয় নাই। সেইটা আপনে নিজেই নিজের লগে হিসাব কইরা নিয়েন। মূল কথা হইল, আমরা সবাই যে যেই দলেরই হই না কেন, এক জায়গায় সবারই এক অদ্ভুত মিল। সেইটা হইল, সবারই সবকিছু করার পরে দিনশেষে খালি খালি লাগে। মনে হয় কি জানি নাই! সবার ভিতরেই একটা কমন শূন্যতার বসবাস। এত অমিল হইয়াও আমাদের সবার মধ্যে কেন এত মিল? কারণ, আমরা সবাই আসলে একই গাছের বিভিন্ন ডালপালা, গোড়া আমাদের একটাই।
লেখা শেষ। এবার আপনে চইলা যাইতে পারেন। আর যাওয়ার আগে কবি জীবনানন্দের শূন্যতার বোধ নিয়া লেখা কবিতার কয়েকটা লাইন পইড়া যাইতে পারেন।
আলো অন্ধকারে যাই- মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়,- শান্তি নয়- ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়- পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা-প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়।