যখন মারা গেলেন, তখন আপনে বাসায় ফিরতেছিলেন।
সড়ক দুর্ঘটনা ছিলো। উল্লেখযোগ্য কিছুই না, তারপরেও ব্যপারটা সাংঘাতিক। আপনে বউ আর দুইটা বাচ্চা ফালাইয়া মইরা গেছেন। মৃত্যুটা ছিলো যন্ত্রনাহীন। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করছে আপনারে বাঁচানোর, কিন্তু তাঁদের চেষ্টায় কাজ হইলো না। আপনার পুরা শরীরের সব হাড়গোড় চুরমার হইয়া গেছিলো, মইরা গেছেন এইটাই ভালো হইছে, বিশ্বাস করেন।
এরপরই আমার সাথে আপনার দেখা।
“কি……… কি হইছিলো?” আপনে জিজ্ঞেস করলেন আমারে, “আমি কোথায়?”
“আপনে মইরা গেছেন।” আমি সোজা-সাপটা উত্তর দিলাম। মরণ নিয়া মিনমিন করার কোন মানে নাই।
“একটা……… ট্রাক…… পিছলাইতেছিলো…”
“হ্যাঁ”
“আমি…… আমি মইরা গেছি?”
“হ্যাঁ। কিন্তু এইটা নিয়া এত চিন্তা করার কিছু নাই। সবাই মরে।” আমি বললাম।
আপনে এদিক ওদিক ঘুইরা তাকাইলেন। দেখলেন চারিদিকে শুধু শূন্যতা। খালি আপনি
আর আমি। “এইটা আবার কেমন জায়গা?” আপনে জিজ্ঞেস করলেন, “এইটাই কি পরকাল?”
“হুম…হ্যা। পরকালই বলতে পারেন।”
“আপনে কি ঈশ্বর?”
“হ্যাঁ” আমি উত্তর দিলাম, “আমি ঈশ্বর।”
“আমার বাচ্চা…………… আমার বউ।”
“আপনার বউ-বাচ্চার কি হইছে?”
“তাঁরা আমারে ছাড়া ক্যামনে থাকব?”
“আমি এইটাই দেখতে চাইছিলাম” আমি বললাম, “আপনে মাত্র মারা গেলেন আর এখন আপনার মূল চিন্তা আপনার পরিবার নিয়া! ওইখানে তাইলে আপনারা ভালোই ঘটনা ঘটাইতেছেন।”
আপনে দুই চোখে একটা মোহনীয় দৃষ্টি নিয়া আমার দিকে তাকাইলেন। কিন্তু আমারে দেইখা আপনার কাছে ঈশ্বর মনে হইলো না। আমি দেখতে আর দশটা পুরুষ মানুষের মতই। অথবা একটা মহিলার মতও বলা যায়। কোন এক অস্পষ্ট কর্তৃত্বপূর্ণ অবয়বও হইতে পারি আমি। আপনার চোখে আমারে দেখতে বড়জোর একটা স্কুলের গ্রামারের মাস্টার মনে হইতে পারে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তো কিছুতেই মনে হইতে পারে না।
“চিন্তা কইরেন না।” আমি বললাম। “আপনার বউ-বাচ্চা ভালোই থাকব। আপনার বাচ্চারা আপনারে একদম সবরকমেই পারফেক্টলি মনে রাখব। বড় হইয়া আপনার অবজ্ঞার পাত্র হইয়া উঠার সময়টাই তো তাঁরা পায় নাই। আপনার বউ অবশ্য উপরে উপরে অনেক কান্নাকাটি করব, কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা স্বস্তিও অনুভব করব। সত্যি কথা বলতে কি, আপনাদের দুইজনের তো প্রায় ছাড়াছাড়ি হইয়া যায় এমন অবস্থা ছিলো। এইটা যদি কোন শান্তনার বিষয় হইয়া থাকে, তাইলে আপনার বউ আপনার মরণে এতটাই স্বস্তি পাইব যে, এই কারণে তাঁর ভিতরে একটু অপরাধ বোধও কাজ করতে পারে।”
“ওহ, তো এখন তাইলে কি হইব? আমি স্বর্গে যাবো নাকি নরকে যাবো?”
“কোনটাতেই যাবেন না” আমি বললাম। “আপনারে আবার পুনর্জন্ম দেয়া হবে।”
“অ্যাঁ, তারমানে হিন্দুরা যা কইছিলো তাই ঠিক ছিলো?”
“সব ধর্মই ঠিক, তাঁদের নিজেদের মত কইরা আর কি!” আমি বললাম, “আমার সাথে আসেন।”
আপনে আমারে অনুসরণ করতে লাগলেন, যখন আমরা শূন্যতার মাঝখানে পাও ফালাইয়া আগাইতে লাগলাম।
“আমরা কোথায় যাইতেছি?”
“বিশেষ কোথাও না” আমি বললাম, “হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে ভালো লাগে, এই আর কি!”
“তাইলে লাভটা হইবো কি?” আপনে জিজ্ঞেস করলেন, “আমার যদি আবার জন্ম হয়, তাইলে তো আমি একটা ব্ল্যাংক স্লেট হইয়া জন্ম নিব, তাই না? একটা ছোট বাচ্চা। তাইলে আমার জীবনের সব অভিজ্ঞতা এবং পুরা জীবনে যা কিছু করলাম সবই তো নাই হইয়া যাইব, কোন কিছুই তো আর ম্যাটার করব না।”
“না করব না! আপনার অতীত জীবনগুলার সকল জ্ঞান, তথ্য এবং অভিজ্ঞতা আপনার ভিতরেই রইয়া গেছে। খালি এই মুহূর্তে আপনে সেইগুলা মনে করতে পারতেছেন না।”
আমি হাঁটা থামাইয়া আপনার কাঁধে হাত রাইখা বললাম, “আপনার আত্মাটা এত বড়, এত সুন্দর, আর এত বিস্তীর্ণ যা আপনে সম্ভবত কল্পনাও করতে পারবেন না। একটা মানুষের মন সত্যিকারের আপনিটার কেবল ক্ষুদ্র থাইকা ক্ষুদ্রতর একটা অংশ ধারণ করতে পারে। ব্যপারটা ঠিক গ্লাসের পানিতে আঙুল দিয়া দেখার মত, পানিটা ঠাণ্ডা নাকি গরম। আপনার এই শরীর নামক খাঁচাটার ভেতরে আপনার নিজের খুব ক্ষুদ্র একটা অংশ রাখেন, এবং যখন আপনে এইটারে আবার খাঁচার ভিতর থাইকা বাইর কইরা নিয়া আসেন, তখন সাথে আপনার অর্জিত সকল অভিজ্ঞতাও চইলা আসে।”
“আপনে গত ৪৮ বছর ধইরা একটা মানুষ ছিলেন, সুতরাং আপনে এখনো পুরাপুরি উইঠা আসেন নাই এবং আপনে আপনার চেতনার বাকিটা গভীরভাবে অনুভব করছেন। এইখানে যদি আমরা এখন যথেষ্ট সময় নিয়া দাঁড়াইয়া থাকি, তাইলে আপনার সবকিছুই আস্তে আস্তে মনে পড়া শুরু হইব। কিন্তু প্রতিটা জীবনের মাঝখানে এমন কইরা সবকিছু মনে করার কোন মানে নাই।”
“তাইলে আমার কতবার পুনর্জন্ম হইছিলো?”
“অনেকবার। অনেকবার এবং বহুবার। এবং হরেক রকম জীবনে আপনার পুনর্জন্ম হইছিলো।” আমি বললাম। “এইবার আপনে খ্রিস্টপূর্ব ৫৪০ অব্দে একটা চাইনিজ চাষীর মেয়ে হিসেবে জন্ম নিতে যাইতেছেন।”
“দাঁড়ান, কি বললেন?” আপনে তোতলাইতে তোতলাইতে বললেন। “আমারে আপনে সময়ের পেছনের দিকে পাঠাইবেন?”
“অ্যাঁ, আসলে ব্যপারটা হইলো, সময়রে আপনে যেভাবে চিনেন, সেই সময় কেবল আপনার ব্রহ্মাণ্ডেই ঐভাবে কাজ করে। আমি যেইখান থাইকা আসছি, সেইখানে সবকিছু অন্য রকম।”
“আপনে যেইখান থাইকা আসছেন মানে?”
“হা, অবশ্যই,” আমি ব্যাখ্যা করতে লাগলাম, “আমি কোন এক জায়গা থাইকা আসছি। অন্য জায়গা। এবং আমার মত এমন ঈশ্বর আরো আছে। আমি জানি এখন আপনে জানতে চাইবেন, সেই জায়গাটা কেমন, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আপনারে বললেও আপনে বুঝবেন না।”
“ওহ,” আপনে একটু মর্মাহত হইয়া বললেন। “কিন্তু দাঁড়ান। যদি একই সময়ে বিভিন্ন জায়গায় আমার পুনর্জন্ম হয়, তাইলে তো আমি এই আমিরেও জন্ম দিতে পারি।”
“নিশ্চয়ই। এইরকম সবসময়ই ঘইটা থাকে। একই সাথে দুইটা জীবনে আপনে প্রতিটা জীবনে আলাদা ভাবে সজাগ থাকবেন এবং প্যারালালি আপনার যে দুইটা জীবন চলতেছে, সেইটা আপনে বুঝতেও পারবেন না।”
“তাইলে এই সবকিছুর কোন মানে আছে? হুদাই!”
“সিরিয়াসলি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সিরিয়াসলি? আপনে আমার কাছে জীবনের অর্থ জানতে চাইতেছেন? বিষয়টা কেমন ক্ষেত হইয়া গেল না?”
“এইটা তো একটা যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন।”
আমি আপনার চোখের দিকে তাকাইয়া বললাম, “জীবনের অর্থ, যেই কারণে আমি ব্রহ্মাণ্ড বানাইছি, এর উদ্দেশ্য একটাই — আপনারে পরিপক্ব কইরা তোলা।”
“আপনে আমারে বলতে পুরা মানবজাতিরে বুঝাইছেন? আপনে আমাদেরকে পরিপক্ব কইরা তোলতে চান?”
“না, আপনাদেরকে না। শুধু আপনারে। আমি ব্রহ্মাণ্ডটা বানাইছি শুধু আপনার জন্যে। প্রতিটা জন্মে, প্রতিটা নতুন জীবনের সাথে সাথে আপনে একটু একটু কইরা পরিপক্ব হইয়া উঠতেছেন, আরও বড় হইয়া উঠতেছেন, এবং আরও বুদ্ধিমান হইয়া উঠতেছেন।”
“খালি আমি? বাকী সবার তাইলে কি হইলো?”
“বাকী সবাই বলতে কেউ নাই। এই ব্রহ্মাণ্ডে কেবল আপনিই আছেন, আর আছি আমি।”
এই কথা শুইনা, আপনার চক্ষু দুইটা রক্তশূন্য হইয়া গেল। “কিন্তু দুনিয়াতে আরও যে মানুষজন আছে…”
“সবগুলা মানুষই আপনি। সবগুলাই আপনার আলাদা আলাদা মূর্তি।”
“দাঁড়ান। মানে, আমিই সবাই!?”
“হ্যাঁ, এইতো বুঝতে পারতেছেন,” আমি আপনার পিঠে অভিনন্দনের চাপড় মাইরা বললাম।
“দুনিয়াতে যত মানুষ আসছে প্রত্যেকটাই আমি?”
“আপনে ছাড়া আর কে হবে, আপনিই।”
“আমি আব্রাহাম লিঙ্কন?”
“হ্যাঁ, এবং আপনেই জন ওইল্কিস বুথ।”
“আমি হিটলার?”
“এবং হিটলারের খুন করা লাখ লাখ মানুষগুলাও আপনি।”
“আমি যিশু খ্রিস্ট?”
“হ্যাঁ, এবং তাঁর যত অনুসারী ছিলো সেগুলাও আপনি।”
তারপর আপনে চুপ হইয়া গেলেন।
“যতবারই আপনে কাউরে ঠকান,” আমি বললাম, “আপনে আসলে নিজেরেই ঠকান।
যতজনরে আপনে উদারতা দেখাইছেন, আপনে আসলে তা নিজেরেই দেখাইছেন। যে
কোন মানুষের অনুভূত প্রতিটা সুখ এবং দুঃখের যেই মুহূর্ত ছিলো, আছে এবং থাকবে, তাঁর সবই অনুভূত হবে আপনার দ্বারা।”
এই কথা শুইনা আপনে অনেকক্ষণ ধইরা ভাবলেন।
“কেন?” আপনে জিজ্ঞেস করলেন, “এতসব কেন করতেছেন?”
“কারণ একদিন, তুমিও আমার মত হবা। আমার মনে হয় এখন তোমারে তুমি কইরা বলার সময় হইছে। তুমি আমার জাতেরই একজন। তুমি আমার মতই। তুমি আমারই সন্তান।”
“তাই নাকি!” তুমি অবিশ্বাসের সুরে বইলা উঠলা, “তাঁর মানে আপনে বলতেছেন আমিও ঈশ্বর?”
“না। তুমি এখনো ঈশ্বর হইয়া উঠো নাই পুরাপুরি। তুমি একটা ভ্রূণ। এখনো তুমি বাইড়া উঠতাছ। যখন পুরা সময় ধইরা সবগুলা মানুষের জীবন যাপন করা শেষ করবা, তখন ঈশ্বর হইয়া জন্ম নেওয়ার পরিপক্বতা তোমার আসব।”
“তাইলে এই যে পুরা ব্রহ্মাণ্ডটা। এইটা তাইলে শুধুই……”
“হ্যাঁ, এইটা শুধুই একটা ডিম” আমি উত্তর দিলাম। “এখন তোমার পরবর্তী জন্ম নেওয়ার সময় হইয়া গেছে।”
এবং তারপর আমি তোমারে তোমার পথে পাঠাইয়া দিলাম।
অনুবাদকালঃ সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৬, ঢাকা।