1016977 10151818921479074 249740261

ব্লাউজ

মমিন গত কয়েকদিন যাবত এক ধরণের অস্থিরতায় ভুগছে। তাঁর পুরো শরীরটা যেন একটা দগদগে বিষফোঁড়া। সর্বদা সে একটা রহস্যজনক ব্যথা অনুভব করে —কাজ করতে গেলে, হাঁটতে গেলে, এমনকি চিন্তা করতে গেলেও ব্যথাটা তাঁর অনুভূত হয়। যতবারই সে এই অনুভূতিটাকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে, ততবারই ব্যর্থ হয়েছে।

বসে থাকা অবস্থায় মাঝে মাঝে সে ব্যথাটার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো শুরু করে। সাধারণত যে অস্পষ্ট এলোমেলো চিন্তাগুলো তাঁর মনে বুদ্বুদাকারে উত্থিত হয়ে আবার নীরবে মিলিয়ে যায়, সেগুলো এখন প্রচণ্ড ঝড়ের বেগে সেখানে বিস্ফোরিত হওয়া শুরু করেছে । মনে হচ্ছে যেন কাঁটাওয়ালা পা নিয়ে কতগুলো পিঁপড়ে তাঁর কোমল মনটার অলিতে গলিতে হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তাঁর পুরো শরীরে একটা টানটান অনুভূতি জেগে উঠেছে, আর এতে তাঁর ভয়ানক অস্বস্তি লাগা শুরু হয়েছে। অস্বস্তিটা যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন মমিনের ইচ্ছা করে একটা বৃহদাকার গরম কড়াইয়ের ভেতরে শুয়ে থাকতে, যা এখনই তাঁকে আস্ত খেয়ে ফেলবে।

রান্নাঘর থেকে মসলা বাটার আওয়াজ এসে মমিনের কানে বাজলো। আওয়াজটা শুনে সে একটা গভীর তৃপ্তি বোধ করলোঃ ধাতুর সাথে ধাতুর সংঘর্ষে বেজে উঠা সঙ্গীতটা ছাদের উপরে তাঁর খুপরিতে এসে যেন একটা হুমকি হয়ে প্রবেশ করে, যেখানে সে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আওয়াজে সৃষ্ট কাঁপুনিটা তাঁর খালি দুটো পা বেয়ে দৌড়ে উঠে চলে যায় পায়ের মাংসপেশি আর উরুতে, সেখান থেকে এটা তাঁর হৃদপিণ্ডে পৌঁছানোর আগ মুহূর্তে ঠিক ঝড়ো হাওয়ায় একটা মাটির প্রদীপ শিখার মতই পাখা ঝাপটাতে থাকে।

মমিনের বয়স পনেরো, হয়তো ষোল হবে; সে তাঁর সঠিক বয়সটা জানে না। সে একটা বলিষ্ঠ, স্বাস্থ্যবান বালক যার বয়ঃসন্ধিকাল অশ্ব গতিতে ছুটছে বয়:প্রাপ্তির দিকে এবং এই অশ্ব গতির প্রভাব সম্পর্কে মমিন পুরোপুরিই অজ্ঞ—যে গতি আলোড়ন তুলেছে তাঁর প্রতিটা রক্ত কণিকায় । সে এই অনুভূতির অর্থটা বোঝার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি।

তাঁর শারীরিক পরিবর্তনগুলোও দিনে দিনে দৃশ্যমান হতে শুরে করেছে। তাঁর সরু গ্রীবা ধীরে পুরু হতে চলেছে; ফলগ্রন্থিটা আরও উন্নত হয়ে উঠছে, বাহুর পেশীগুলো আরও আঁটসাঁট হয়েছে; বক্ষদেশটা হয়ে উঠেছে শক্ত আর বুকের বোঁটা দুটো এমনভাবে ফুলে উঠেছে যেন কেউ সেখানে দুটো মারবেল ঠেসে দিয়েছে। বুকের এই ডেলাগুলোতে ছোঁয়া লাগলে মমিনের মারাত্মক অস্বস্তি লাগে। কখনো ঘটনাক্রমে এই ডেলাগুলোতে তাঁর হাতের আঁচড় লাগলে, কিংবা কাজের সময় তাঁর শার্টের ভারী কাপড়ের ঘসা লাগলে, ব্যথায় সে লাফিয়ে উঠে।

গোসলখানায়, কিংবা রান্নাঘরে যখন একা, শার্টের বোতামগুলো খুলে সে বুকের ডেলাগুলোকে আলতো হাতে মালিশ করতে করতে খুব মনযোগের সাথে পরখ করে। তখন তীব্র ব্যথার একটা ঝলকানি তাঁর সারা শরীরের মধ্যে ছুটে বেড়ায়, যেন ফলের ভারে নুয়ে পড়া একটা গাছের মত তাঁর শরীরটাকে কেউ ঝাঁকি দিয়েছে। যদিও ব্যথাটা তাঁকে কাঁপিয়ে তুলে, তবুও সে অবসর সময়গুলোতে ইচ্ছে করেই এই ব্যথায় ডুবে থাকে। মাঝে মাঝে, যদি সে একটু জোরে চাপ দেয়, ডেলাগুলো তখন ফুটো হয়ে যায় এবং সেখান থেকে চটচটে তরল পদার্থ বেরিয়ে আসে। এই দৃশ্যটা দেখলে তাঁর মুখটা আকর্ণ রক্তিম হয়ে উঠে। তাঁর মনে হয়, কোন অর্থ ছাড়াই, সে যেন একটা পাপকর্ম করে ফেলেছে।

পাপ আর পুন্য সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান খুবই সামান্য। যে কোন কাজ, যা মানুষ জনসম্মুখে করতে পারে না সেটাকেই তাঁর কাছে পাপ বলে মনে হয়। সে জন্যে যখন তাঁর মুখটা আকর্ণ লাল হয়ে উঠে, তাড়াহুড়ো করে সে শার্টটা পড়ে নিয়ে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে যে এরকম বিকৃত বিনোদনে আর কখনই মত্ত হবে না। কিন্তু এহেন প্রতিজ্ঞা করা সত্ত্বেও, দুই অথবা তিন দিন পরেই সে এই ধরণের কাজে ফের ডুবে যায়।

মমিন তাঁর জীবনের রাজপথে একটা মোড় নিতে যাচ্ছে, মোড়ের এই পথটা যতটা বিশ্বাসঘাতক ততটা দীর্ঘ নয়। এই পথে মাঝে মাঝে সে দ্রুত বেগে দৌড়ায়, মাঝে মাঝে ধীরে। সত্যি কথা হলো সে জানে না এই ধরণের পথগুলো কিভাবে পার হতে হয়। তাঁদের সাথে কি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বোঝাপড়াটা সেরে নেয়া উচিত, নাকি সেটা আস্তে ধীরেই করা উচিত; পথিমধ্যে কি কারো সাহায্য নেয়া উচিত? তাঁকে দেখলে মনে হয়, তাঁর সমীপবর্তী পুরুষত্বের পথের শানে সে বার বার পা পিছলে পড়ে যাচ্ছে, অনেক সংগ্রাম করে সে তাঁর ভারসাম্য রক্ষা করছে। বিষয়টা তাঁকে বড়ই বিচলিত করে তুলেছে, আর এ জন্যে কাজের মাঝখানেই সে শুরু করে দেয়, দেয়ালের একটা হুক দু’হাতে ধরে ঝুলে থাকে। আর প্রাণপণে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে যেন কেউ তাঁর পা দুটোকে নিচের দিকে টেনে ধরে, যেন টানতে টানতে তাঁকে একটা সরু তারে পরিণত করে ফেলে। কিন্তু তাঁর এইসব চিন্তা-ভাবনার কোন অর্থই সে বুঝতে পারে না, মনে হয় যেন এগুলো তাঁর মস্তিষ্কের কোন এক অজানা অংশ থেকে উদয় হচ্ছে।

বাড়ির প্রত্যেকেই মমিনকে খুব পছন্দ করে। মমিন কঠোর পরিশ্রমী, তাঁর সব কাজই সে সময়মত করে রাখে। সুতরাং তাঁর প্রতি বাড়ির কারোরই কোন প্রকার অভিযোগ নেই। কাজের লোক হিসেবে সে কাজ করেছে মাত্র তিনমাস, কিন্তু এই অল্প সময়েই সে বাড়ির সকলের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে। মাসিক ছয় রুপিতে সে কাজ করা শুরু করেছিলো, কিন্তু দ্বিতীয় মাসেই তাঁর বেতন দুই রুপি বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট রুপিতে। এই বাড়িতে সে বেশ ভালো আছে, এখানে তাঁকে সম্মান দেখানো হয়।

কিন্তু এখন, গত কয়েকদিন ধরে, সে খুব অস্থির হয়ে উঠেছে। আর এই অস্থিরতার কারণে সারাদিন তাঁর বাজারে ঘুরাফেরা করে কাটাতে ইচ্ছে করে, অথবা দূরে জনশূন্য কোন জায়গায় গিয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

কাজে আর তাঁর আগের মত মন নেই, কিন্তু তাঁর ঔদাসিন্যতা সত্ত্বেও সে অলস হয়ে যায়নি, আর এ জন্যেই বাড়ির কেউ তাঁর ভেতরের চলমান অশান্তিটাকে দেখতে পায়নি। রাজিয়া সারাটা দিন মিউজিক শুনে, নতুন নতুন সিনেমার গান মুখস্থ করে আর ম্যাগাজিন পড়ে পার করে দেয়। সে কখনই মমিনকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। শাকিলা মাঝে মাঝে মমিনকে দিয়ে নিজের কিছু কাজ করিয়ে নেয়, মাঝে মাঝে বকাও দেয়, কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে সেও কয়েকটা ব্লাউজের স্যাম্পল কপি করা নিয়ে পুরোপুরি ডুবে আছে। স্যাম্পলগুলো তাঁর এক বান্ধবীর, যে সর্বাধুনিক ফ্যাশনের সাথে সর্বদা তাল মিলিয়ে চলে। শাকিলা তাঁর কাছ থেকে আটটা ব্লাউজ ধার করে নিয়ে এসে এগুলোর ডিজাইন কাগজের উপর প্রতিলেপন করছে। সুতরাং গত কয়েকদিনে, সেও মমিনের দিকে তেমন একটা মনযোগ দিতে পারেনি।

ডেপুটি সাবের স্ত্রী মহিলাটা তেমন কঠোর প্রকৃতির নয়। মমিন ছাড়াও বাড়িতে আরও দুজন ভৃত্য রয়েছে। একজন বুড়ো মহিলা আছে যে বেশীরভাগ সময়ই রান্নাঘরে কাজ করে, মমিন মাঝে মধ্যে তাঁকে একটু আধটু সাহায্য করে। ডেপুটি সাবের স্ত্রী সম্ভবত মমিনের চিন্তা চেতনায় একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে, কিন্তু সে এটা তাঁর কাছে উল্লেখ করতে পারেনি। মহিলা নিশ্চয়ই মমিনের শরীর আর মনের আকস্মিক পরিবর্তন সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাঁর কোন ছেলে নেই, সুতরাং মমিন কি ধরণের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেটা তাঁর বুঝতে পারার কথা না। আর তাছাড়া, মমিন একটা কাজের ছেলে। কে কাজের ছেলের জীবনের দিকে এত মনযোগ দিতে পারে? তাঁদের জীবনের সবগুলো ধাপই কাটে দৌড়ের উপর, শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত, আর আশেপাশের কেউই তাঁদের জীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতে পারে না।

সে যদিও এসবে অবগত ছিলো না, মমিন অপেক্ষা করছে কিছু একটা ঘটার। কি ঘটবে? কিছু একটা ঘটুকঃ টেবিলের উপর সযত্নে সাজিয়ে রাখা প্লেটগুলো উপরের দিকে লাফিয়ে উঠুক; কেতলির ফুটন্ত পানিটা ঢাকনাটাকে উড়িয়ে বাতাসে তোলে ফেলুক; হাতের হালকা চাপেই টেপের পাইপটা ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাক; একটা পানির ফোয়ারা হঠাৎ বিচ্ছুরিত হোক; তাঁর দেহটা ভেঙ্গেচুরে চুরমার হয়ে যাক, খুব জোরে, যেন শরীরের প্রতিটা হাড় আলাদা হয়ে ঝুলে থাকে; এমন কিছু একটা আত্মপ্রকাশ করুক যা সে জীবনে কোনদিন দেখেনি বা অনুভব করেনি।

মমিন গভীরভাবে অস্থির।

এবং রাজিয়া নতুন নতুন সিনেমার গান মুখস্থ করতে ব্যস্ত, আর শাকিলা ডুবে আছে ব্লাউজের স্যাম্পল কাগজের উপর প্রতিলেপনে। শাকিলার যখন ডিজাইন কপি করা শেষ হলো, সে এদের মধ্য থেকে সবচেয়ে ভালোটা বাছাই করে, সেটার অনুকরণে নিজের জন্যে একটা বেগুনী বর্ণের সাটিন ব্লাউজ বানানো শুরু করলো। এখন জোর করে রাজিয়াকেও রেডিও আর সিনেমার গান বাদ দিয়ে ব্লাউজ বানানোর দিকে মনযোগ দিতে বাধ্য করা হলো।

শাকিলা সবসময়ই যে কোন কাজ অনেক ধৈর্য আর যত্নের সাথে করে। তাঁর সেলাই করার ভঙ্গিটাতে এক ধরণের পরিতৃপ্তি প্রকাশ পায়। সে তাঁর বোন রাজিয়ার মত উড়ুক্কু স্বভাবের নয়। তাঁর সুচের প্রতিটা ফোঁড় এগিয়ে চলে গভীর আর যত্নশীল বিবেচনার পর, সুতরাং এখানে ভুল হওয়ার কোন সম্ভাবনাই থাকে না। তাঁর পরিমাপ সবসময়ই যথাযথ। প্রথমেই সে ভালো করে মেপে কাগজ কেটে নেয়, তারপর সেই কাগজের টুকরোর মাপে তাঁর কাপড়গুলোকে কাটে। এতে সময় লাগে বেশী, কিন্তু ফলাফলটা হয় প্রায় নির্ভুল।

শাকিলা মেয়েটা দীর্ঘকায়, স্বাস্থ্যবানও বটে। তাঁর হাতের আঙ্গুলগুলো পুরু, মাংসল, আগার দিকটা সরু, এবং আঙ্গুলের প্রতিটা গাঁটে আছে অগভীর খাঁজ। যখন সে সেলাই মেশিনে বসে কাজ করে, হাতের নড়াচড়ায় খাঁজগুলো তখন অদৃশ্য হয়ে যায়।

শাকিলা খুব শান্ত হয়ে মেশিনটাতে বসে। হাতের দুই অথবা তিনটা আঙুল দিয়ে মেশিনের হুইলটা ঘুরায়। ধীরে এবং পরিচ্ছন্নভাবে। তখন আলতোভাবে বাঁকা হয় তাঁর কব্জিটা। তাঁর কাঁধটা হালকা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, এবং একটা চুলের গোছা, কোন নির্দিষ্ট জায়গা খুঁজে না পেয়ে, পিছলে ঝুলে পড়ে। কাজে সে এতটাই মগ্ন হয়ে ডুবে থাকে যে চুলের গোছাটা হাত দিয়ে সরানোর কথাটাও বেমালুম ভুলে যায়।

শাকিলা বেগুনী সাটিন কাপড়টা বিছিয়ে নিলো, ব্লাউজের মাপে কাপড়টাকে এখন কাটবে। কাটতে গিয়ে তাঁর মনে হলো তাঁর একটা কাপড় মাপার ফিতা দরকার। তাঁদের নিজেদের ফিতাটা পুরনো হয়ে ছিড়ে গেছে; ইস্পাতের একটা অবশ্য আছে, কিন্তু এটা দিয়ে সে তাঁর পিঠ আর বুক মাপবে কি করে? তাঁর নিজের অবশ্য অনেকগুলো ব্লাউজ আছে, কিন্তু যেহেতু ওজন আগের চেয়ে একটু বেড়েছে, তাই সে তাঁর শরীরের পরিমাপটা আবারো দেখে নিতে চাচ্ছে।

গায়ের শার্টটা খুলে চিৎকার করে সে মমিনকে ডাকলো। মমিন আসার পর বললো, “মমিন, একটু পাশের বাড়িতে যাও তো, ছয় নম্বর বাড়িটায়, গিয়ে একটা মাপন ফিতা চেয়ে নিয়ে আসো। তাঁদের বলো, শাকিলা চাইছে!”

মমিনের চোখ গিয়ে পড়লো শাকিলার পরনের সাদা অন্তর্বাসের উপর। শাকিলাকে এই অবস্থায় মমিন আগেও বহুবার দেখেছে, কিন্তু আজকে এই দৃশ্যটা তাঁর শরীরে একটা অদ্ভুত ঝাঁকুনি দিলো। সে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বললো, “কি ধরণের মাপন, বিবি?”

“ফিতা মাপন। এই যে লোহার দণ্ডটা, তোমার সামনে যেটা পড়ে আছে, এটাও এক ধরণের মাপন। আরেক ধরনের মাপনও আছে, কাপড়ের জন্যে। যাও, ছয় নম্বর বাড়ি থেকে গিয়ে নিয়ে আসো, দৌড় দাও। তাঁদেরকে বলো, শাকিলা বিবির এটা দরকার।”

ছয় নম্বর ফ্ল্যাটটা কাছেই ছিলো। মমিন মিনিট খানেকের মধ্যে ফিতা নিয়ে ফিরে আসলো। শাকিলা তাঁর হাত থেকে ফিতাটা নিয়ে বললো, “দাঁড়াও, এক সেকেন্ড। এখনই আবার ফেরত দিয়ে এসো।” তারপর তাঁর বোনকে উদ্দেশ্য করে সে বললো, “জানিস, এই মানুষগুলো না, তুই যদি তাঁদের কিছু একটা এনে রেখেছিস তো এটা ফেরত পাওয়ার জন্যে তোর সাথে রীতিমত উতপাত শুরু করে দিবে। এই যে এখানে, আমার মাপটা একটু নিবি?”

রাজিয়া শাকিলার পিঠের আর বুকের মাপ নেয়া শুরু করলো; দুজনেই কথা বলে যাচ্ছিলো অবিরত। মমিন দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁদের কথাগুলো শুনছিলো, আর পার করছিলো একটা অস্বস্তিকর নীরবতা।

“রাজিয়া, তুই ফিতাটাকে একটু ছড়িয়ে কেন মাপটা নিচ্ছিস না? আগেরবারও তুই একই কাজ করেছিস। তোর মাপে বানিয়ে খুব বাজে একটা ব্লাউজ হয়েছে। যদি ব্লাউজের সামনের দিকটা মাপসই না হয়, তাহলে বগলের চারপাশে এটা ঢিলা হয়ে থাকে।”

“কোথায় মাপ নেব, কোথায় নেব না, তুমি তো আমাকে বিপাকে ফেলে দাও! আমি এক জায়গায় নেয়া শুরু করি তো তুমি বলো, ‘আরেকটু নিচে’। যদি অল্প একটু ছোট-বড় হয়, তাহলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?”

“হ্যাঁ, হয়ে যাবে! জিনিসটা শুধু মাপসই হলেই কেবল দেখতে ভালো লাগে। সুরাইয়ার কাপড়গুলো দেখিস না, কি সুন্দর মাপ? একটাও ভাঁজ পড়তে দেখেছিস তাঁর কাপড়ে? দেখিস না, কত সুন্দর লাগে কাপড়গুলো তাঁর গায়ে? এখন, আয়, ঠিকমত মাপটা নে।” এটা বলেই সে একটা নিঃশ্বাস নিলো, এতে তাঁর স্তনযুগল ফুলে উঠলো। স্তনগুলো যখন যথাযথভাবে বিস্ফোরিত, সে তাঁর নিঃশ্বাসটা আটকে ধরে বললো, “মাপটা নে না, এখনই, তাড়াতাড়ি।”

শাকিলা যখন নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দিলো, মমিনের ভেতরে তখন শত শত বেলুনের বিস্ফোরণ শুরু হলো। কোনরকমে শুঁকনো গলায় সে বললো, “এটা কি ফেরত দিয়ে আসবো বিবি, ফিতাটা?”

“দাঁড়াও, এক মিনিট,” শাকিলার অগ্রাহ্য উত্তর।

উত্তরটা যখন দিচ্ছিলো, কাপড়ের ফিতাটা তখন তাঁর হাতে পেঁচিয়ে গেলো। শাকিলা পেঁচটা ছাড়াতে গিয়ে হাত দুটো উপরে উঠে গেল, তখন তাঁর ধূসর বগলের এক গোছা কালো চুলের উপর চোখ পড়লো মমিনের। একই ধরণের চুল তাঁর নিজের বগলেও গজিয়েছে, কিন্তু শাকিলারগুলো দেখে সে এক ধরণের বিশেষ প্রীতি অনুভব করলো। তাঁর পুরো শরীরের মধ্য দিয়ে একটা শিহরন বয়ে গেলো। তাঁর ভেতরে একটা অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা জন্মাল — যদি এই কালো চুল গুলো তাঁর গোঁফ হয়ে যেত! শৈশবে, সে ভুট্টা গাছের কালো আর সোনালী চুল দিয়ে নিজের গোঁফ তৈরি করতো। এখন এই ইচ্ছাটা, তাঁর নাক আর মুখের আশেপাশে সেই ছোট বেলার অনুভূতিটা জাগিয়ে তুললো — ভুট্টার চুলগুলো সুড়সুড়ি দিচ্ছে তাঁর উপরের ঠোঁটটায়।

শাকিলা তাঁর হাত দুটো নামালো এবং তাঁর বগলটা আবারো আড়াল হয়ে গেলো, কিন্তু মমিন তখনো তাঁর মনের চোখে কালো চুলের গোছাটা দেখতে পেলো। শাকিলার হাত তোলা আর তাঁর বগলের চুলগুলোর উঁকি মারার দৃশ্যটা মমিনের মনে একদম গেঁথে গেলো।

শাকিলা মমিনের হাতে ফিতাটা দিয়ে বললো, “যাও, ফেরত দিয়ে আসো। আর তাঁদের খুব করে ধন্যবাদ জানিও।”

মমিন ফিতাটা ফেরত দিয়ে এসে বাড়ির উঠোনে বসলো। আবছা কিছু ভাবনার উদয় হলো তাঁর মনে। সে অনেকক্ষণ বসে থেকে এসবের অর্থ বোঝার চেষ্টা করলো, কিন্তু পরিষ্কার কিছুই বোঝা গেল না।

ঘরে এসে হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই সে তাঁর ছোট্ট ট্রাঙ্কটা খুলে বসলো। ট্রাংকে সতুন সেলাই করা ঈদের কাপড়গুলো রাখা আছে।  ট্রাঙ্কের ঢালাটা খোলার সাথে সাথেই নতুন সুতোর গন্ধটা তাঁর নাকে এসে বারি খেলো। এখন গোসল করে, নতুন কাপড়গুলো পড়ে, উপরের তলায় গিয়ে শাকিলা বিবিকে সালাম করার একটা আকস্মিক ইচ্ছা তাঁর মনে জেগে উঠলো। তাঁর নতুন সুতি সালোয়ারটা তো কুচকে যাবে, আর তাঁর টুপিটা…… টুপির কথাটা মাথায় আসতে না আসতেই তাঁর চোখ গিয়ে পড়লো টুপির সুতোর গোছাটায়। এবং সুতোর গোছাটা যেন সাথে সাথে একটা কালো চুলের গোছায় রূপান্তরিত হলো, যে চুল সে শাকিলার বগলে দেখেছে। সে কাপড়ের নিচ থেকে নতুন টুপিটা বের করে আনলো, টুপির সুতোর তুলতুলে, নমনীয় গোছাটায় আঙুল চালাতে শুরু করলো। তখনই ভেসে আসলো শাকিলার গলার আওয়াজ।

“মমিন!”

মমিন টুপিটা ট্রাঙ্কে রেখে, ঢালাটা লাগিয়ে, শাকিলা যে ঘরে কাজ করছিলো সেখানে ফিরে আসলো। শাকিলা স্যাম্পল ব্যবহার করে ইতোমধ্যেই অনেকগুলো বেগুনী সাটিন কাপড়ের টুকরো কেটে ফেলেছে। উজ্জ্বল, পিচ্ছিল কাপড়ের টুকরোগুলো একপাশে রেখে সে মমিনের দিকে ঘুরে তাকাল। “আমি তোমাকে কতবার ডাকলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?”

মমিনের জিব আটকে গেলো, “না, বিবি জি।”

“তাহলে, কি করছিলে তুমি?”

“কিছুনা, একদম কিছুই না।”

“তুমি কিছু তো একটা করছিলে।” শাকিলা তাঁকে প্রশ্ন দিয়ে আক্রমণ করতে লাগলো, কিন্তু আসলে তাঁর মনযোগ ছিলো ব্লাউজের দিকে, যেটার উপরে তাঁকে এখন প্রাথমিক সেলাইগুলো দিতে হবে।

“আমি ট্রাঙ্ক খুলে আমার নতুন কাপড়গুলো দেখছিলাম,” মমিন জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়ে কথাটা স্বীকার করলো।

এটা শুনে শাকিলা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো, সাথে রাজিয়াও যোগ দিলো।

শাকিলাকে হাসতে দেখে মমিন অদ্ভুত এক পূর্ণতার স্বাদ পেল, এবং তাঁর ইচ্ছে হলো এমন কিছু বলতে অথবা করতে যা শাকিলাকে আরও হাসাবে। সুতরাং, একটু লাজুক ভঙ্গিতে, মেয়েলি গলায় সে বললো, “আমি বেগম সাবের কাছে কিছু টাকা চাইবো, আর ঐ টাকা দিয়ে আমি একটা রেশমি রুমাল কিনবো।”

শাকিলা এখনো হাসছে, জিজ্ঞেস করলো, “আর ঐ রুমাল দিয়ে কি করবে শুনি?”

“আমার গলায় বাঁধব, বিবি,” মমিন লাজুক গলায় বললো, “দেখতে খুব সুন্দর লাগবে।”

এটা শুনে, শাকিলা আর রাজিয়া দুজনেই দীর্ঘক্ষণ ধরে হাসলো।

“যদি তুমি এটাকে তোমার গলায় বাঁধ, তাহলে ভুলে যেওনা, আমি এটা দিয়ে তোমাকে ফাঁসিতে ঝুলাব।” তারপর, হাসিটাকে কোন রকমে চেপে ধরে, রাজিয়াকে সে বললো, “এই গাধাটা আমাকে ভুলিয়েই দিয়েছে আমি তাঁকে কেন ডেকেছি। কেন ডেকেছিলাম রে তাঁকে?”

রাজিয়া উত্তর দিল না, কিন্তু একটা সিনেমার গান গুনগুন করে গাইতে লাগলো, যে গান সে গত দুই দিন ধরে মুখস্থ করে আসছে। এরই মধ্যে, শাকিলার মনে পড়ে গেল কেন সে মমিনকে ডেকেছে। “শোন, মমিন, আমি তোমাকে এই অন্তর্বাসটা দিচ্ছি। এটা নিয়ে তুমি ঔষধের দোকানের পাশে যে নতুন দোকানটা খুলেছে সেখানে যাবে, ঐ দোকানটা যেখানে তুমি সেদিন আমার সাথে গিয়েছিলে, আর তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করবে এরকম ছয়টা অন্তর্বাসের দাম একসাথে কত পড়বে। তাঁদেরকে বলতে ভুলে যেওনা যে আমি অন্য জায়গায় দাম দেখব, এতে তাঁরা আমাকে দামে ছাড় দিবে। বুঝেছ?”

“হ্যাঁ, বিবি,” মমিন উত্তর দিলো।

“এখন যাও।”

মমিন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, এবং কিছুক্ষণ পর অন্তর্বাসটা হাত থেকে ছুটে গিয়ে পায়ের কাছে পড়লো। ভেতর থেকে শাকিলার গলার আওয়াজ ভেসে আসলোঃ “তাঁদেরকে বলো আমরা ঠিক এটার মতই কিছু চাইছি, হুবুহু এরকম ডিজাইনের। কোন হেরফের হলে চলবে না।”

মমিন বললো, “আচ্ছা”, এবং অন্তর্বাসটা হাতে তুলে নিল। অন্তর্বাসটা হালকা ভিজে গেছে, যেন কেউ এটাকে বাষ্পের উপরে কিছুক্ষণ ধরে রেখে তারপর টেনে নিয়ে এসেছে। অন্তর্বাসটা উষ্ণ আর মিষ্টি; শাকিলার শরীরের গন্ধটা এখনো লেগে আছে — এবং পুরো জিনিসটাই তাঁর কাছে খুবই প্রীতিকর লাগলো। মমিন এটাকে আঙ্গুলের চিপায় ঘষতে ঘষতে চলে গেলো; জিনিসটা বিড়াল ছানার মতই নরম, তুলতুলে। দাম জিজ্ঞেস করে যখন মমিন ফিরে আসলো, ইতিমধ্যে শাকিলা তাঁর ব্লাউজ সেলাই করা শুরু করেছে, বেগুনী সাটিন ব্লাউজটা, মমিনের টুপির সুতোর গোছাটার চাইতেও অনেক উজ্জ্বল আর মসৃণ।

ব্লাউজটা সম্ভবত ঈদের প্রস্তুতি হিসেবে বানানো হচ্ছে, ঈদ তো খুব নিকটে। মমিনকে সেদিন বহুবার ডাকা হয়েছেঃ সুতা কিনে আনতে, লোহাটা বের করতে; সুঁইটা ভেঙ্গে গেছে, নতুন আরেকটা কিনে আনতে। শাকিলা তাঁর বাকী কাজ পরের দিন পর্যন্ত রেখে দিল, কিন্তু সুতার টুকরো আর বেগুনী সাটিনের টুকরোগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। মমিনকে ডাকা হলো এগুলো পরিষ্কার করতে।

সে সবকিছু পরিষ্কার করে বাইরে ছুড়ে ফেললো, শুধু উজ্জ্বল কিছু বেগুনী সাটিনের টুকরো ছাড়া, এগুলোকে সে নিজের কাছে রেখে দিল, কোন কারণ ছাড়াই।

পরের দিন সে পকেট থেকে টুকরোগুলো বের করলো, একা বসে, এগুলো থেকে টেনে সুতা বের করতে লাগলো। এই খেলেটা খেলতে খেলতে এক সময় দেখলো সুতাগুলো একসাথে মিলে তাঁর হাতে একটা বল তৈরি হয়েছে। সে এটাকে আঙুল দিয়ে ঘষলো, চাপ দিলো, কিন্তু শাকিলার বগলটা, যেখানে সে কালো চুলের গোছাটা দেখেছিলো, তাঁর মনের মধ্যে এই ছবিটা গেঁথেই রইলো।

তাঁকে সেদিনও বহুবার তলব করা হলো। প্রতিটা ধাপেই সে বেগুনী সাটিনের ব্লাউজটা দেখলো। যখন এটার কাজ অসমাপ্ত, পুরো ব্লাউজের উপরে ছিলো লম্বা লম্বা সাদা সেলাই। তারপর, এটাকে ইস্ত্রি করা হলো, সবগুলো ভাঁজ মুছে গিয়ে জিনিসটা আরও দিগুণ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। এর পরে, তখনো এটার গায়ে প্রাথমিক সেলাইগুলো ছিলো, শাকিলা এটাকে পড়ে রাজিয়াকে দেখালো। পাশের রুমের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় সে দেখে নিল তাঁকে কেমন লাগছে, সে প্রতিটা এঙ্গেল থেকে সেটা দেখলো। দেখা শেষ হয়ে গেলে, খুলে ফেললো, তারপর এটার জায়গায় জায়গায় দাগ দিলো, যেখানে যেখানে টাইট অথবা ঢিলা। তারপর, সবগুলো ত্রুটি ঠিক করে নিল, এবং আবারো গায় দিয়ে দেখতে লাগলো। যখন একদম ঠিকঠাক মত ফিট হলো, তখনই সে আসল সেলাই শুরু করলো।

এক দিকে, ব্লাউজের সেলাইয়ের কাজ চলছে, আর অন্য দিকে, মমিনের মনে উদ্ভট আর সমস্যাপূর্ণ সব চিন্তা ভাবনার উদয় হচ্ছে। তাঁকে যখন ঘরে ডেকে নেয়া হলো, তাঁর নজর গিয়ে পড়লো চকচকা বেগুনী সাটিন ব্লাউজটার উপর, এটাকে ছুঁয়ে দেখার একটা ইচ্ছা তাঁর মনে জেগে উঠলো, শুধুই ছোঁয়া না, এটার নরম, রেশমি পৃষ্ঠদেশটাকে তাঁর হাতের রুক্ষ আঙ্গুলগুলো দিয়ে আদর করে দিতেও ইচ্ছে করলো।

সে নিজের কাছে রাখা সাটিনের টুকরোটা থেকে এটার কোমলতা অনুভব করেছে। যে সুতাগুলো সে জমিয়েছে, সেগুলো আগের চেয়ে যেন আরও নরম হয়ে উঠেছে। সুতাগুলো দিয়ে যখন সে একটা বল বানিয়েছিলো, তখন সেটাকে আঙুল দিয়ে চাপ দেয়ার সময় সে আবিষ্কার করেছিলো যে এগুলোর গায়ে রাবারের মত কিছু একটা আছে। যখনই সে ঘরের ভেতরে আসে, আর ব্লাউজটা দেখে, তখনই তাঁর মন শাকিলার বগলে দেখা কালো চুলের গোছাটার দিকে ছোটে। চুল গুলোও কি সাটিনের মতই তুলতুলে হবে? সে ভাবে।

অবশেষে ব্লাউজ বানানো শেষ হলো। মমিন একটা ভেজা কাপড় দিয়ে মেঝে মুছছিলো, তখন শাকিলা এসে ঘরে ঢুকলো। সে গায়ের শার্টটা খুলে বিছানার উপর রাখলো। শার্টের নিচে, সে একটা সাদা অন্তর্বাস পড়েছিলো, ঠিক মমিন যেটা দাম জানার জন্যে দোকানে নিয়ে গিয়েছিলো সেটার মতই দেখতে। অন্তর্বাসটার উপরেই সে তাঁর হাতে সেলাই করা ব্লাউজটা পড়লো, বোতামগুলো লাগিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

মমিন তখনো মেঝে মুছে যাচ্ছিলো, আয়নার দিকে মুখ তুলে তাকাল। সে দেখলো, ব্লাউজটার ভেতরে যেন একটা নতুন জীবনের আবির্ভাব হয়েছে; দুয়েক জায়গায় এমনভাবে চকচক করছিলো, মনে হচ্ছিলো সাটিনটা যেন সাদায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। শাকিলার পিঠটা ছিলো মমিনের দিকে, আর ব্লাউজটা আঁটসাঁট হওয়ার কারণে দেখা যাচ্ছিল তাঁর পিঠের লম্বা ভাঁজ আর কশেরুর পুরো গভীরতা। মমিন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।

সে বলে উঠলো, “বিবি, আপনি দর্জিদেরও ছাড়িয়ে গেছেন দেখছি!”

নিজের প্রশংসা শুনে শাকিলা খুশি হলো, কিন্তু রাজিয়ার মতামত শোনার জন্যে অধৈর্য হয়ে পড়লো আর বললো, “সুন্দর হয়েছে, তাই না?”। তারপর দৌড়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো।

মমিনের স্থির চক্ষু দুটি তখনো আয়নায় সেঁটে রইলো, যেখানে ব্লাউজের কালো উজ্জ্বল প্রতিবিম্বগুলো কিছুক্ষণের জন্যে স্থায়ী হয়েছিলো।

রাতে যখন মমিন ঐ ঘরে এক জগ পানি দিয়ে আসতে গেলো, ব্লাউজটাকে তখন একটা কাঠের হ্যাঙ্গারে ঝুলে থাকতে দেখলো। ঘরে আর কেউ ছিলো না। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে সে ব্লাউজটার দিকে একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে রইলো। তারপর, কাঁপা কাঁপা হাতে সে এটাকে ছুঁতে লাগলো। মনে হলো যেন কেউ তাঁর হাত দিয়ে, মৃদু বাতাসের মতই, তাঁর শরীরের লোমগুলোকে আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে।

সেই রাতে মমিন অনেক এলোমেলো স্বপ্ন দেখলো। ডেপুটি সাবের স্ত্রী তাঁকে বিশাল এক স্তূপ কয়লা গুঁড়া করতে আদেশ করেছে, কিন্তু যখন হাতুড়ি দিয়ে সে কয়লার গায়ে আঘাত হানলো, কয়লার গুঁড়াগুলো একটা নরম চুলের গোছাতে রূপ নিলো। দেখে মনে হলো যেন মিহি আঁশের একটা কালো হাওয়াই মিঠাইয়ের বল। তারপর, এই বলগুলো কালো বেলুন হয়ে উড়তে লাগলো বাতাসে। বিস্ফোরিত হওয়ার আগে বেলুনগুলো অনেক অনেক উপরে উঠলো। আকাশে শুরু হলো বজ্রপাত, এদিকে মমিনের টুপির সুতোর গোছাটাও হারিয়ে গেছে। মমিন এটাকে খুঁজতে বাহিরে বের হয়েছে। এলোমেলোভাবে ঘুরতে লাগলো এখান থেকে ওখানে। কোথা থেকে যেন তাজা সুতোর গন্ধটা এসে তাঁকে আলিঙ্গন করলো। তারপর কি ঘটলো সে জানে না। তাঁর হাতটা গিয়ে পড়লো একটা কালো সাটিন ব্লাউজের উপর। কিছু সময়ের জন্য সে একটা কম্পমান জিনিসের উপর হাতটা চালনা করলো। হঠাৎ জেগে উঠলো। কিছুক্ষণের জন্যে বুঝে উঠতে পারছিলো না কি হয়েছে। তারপর, ভঁয়, বিহ্বলতা আর আকস্মিক যন্ত্রণা এসে ভর করলো তাঁর উপর। একটা অদ্ভুত মানসিক অবস্থায় সে হারিয়ে গেলো। প্রথমেই অনুভব করলো একটা উষ্ণ ব্যথা; কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পর, একটা শীতল তরঙ্গ বয়ে গেল তাঁর পুরো শরীরে।

মূলঃ ব্লাউজ—সাদাত হাসান মান্টো

Comments

comments

3,371 views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *