2347 41

মুভি গ্রাউণ্ডহগ ডে (১৯৯৩) —একঘেয়ে পুরনো জীবনের জং ধরা আত্মায় এক নতুন নিঃশ্বাস

ধরেন কোন এক মাসের ০২ তারিখ সকালে আপনে ঘুম থাইকা উঠলেন, অন্য সব দিনের মত আপনার একঘেয়ে জীবনের একঘেয়ে সব কর্মকাণ্ড সম্পাদন কইরা মুখে একরাশ বিরক্তি আর হতাশা নিয়া রাইতে বিছানায় গিয়া চক্ষু বুঝলেন, পরের দিন সকালে এলার্ম ঘড়ির জঘন্য আওয়াজে আপনার ঘুম ভাঙ্গল, কিছুক্ষণ পর আপনে কয়েকটা ঘটনা আর ঘড়ি দেইখা টের পাইলেন যে আজকের দিনটা ০৩ তারিখ হওয়ার কথা থাকলেও আজকেও আসলে ০২ তারিখ। কি অদ্ভুদ! অথচ আপনে ০২ তারিখ রাতেই ঘুমাইছেন। যাইহোক, এই দিনটা আগেরটার মতই কাটাইয়া পরের দিনও ঘুম থাইকা উঠার পর আপনে দেখলেন যে আজেকও ০২ তারিখ। তার পরের দিনও একই। অর্থাৎ, কিছুতেই আপনে ০২ তারিখের বাইরে যাইতে পারতেছেন না। এবং প্রতিদিনই একই রকম সব ঘটনা ঘটতেছে। প্রতিদিনই আপনারে একই কাজ নতুন কইরা করতে হইতেছে। এইরকম একটা “টাইম লুপ”-এ যদি আপনে আটকা পইড়া যান, তখন জীবন আপনার কাছে কেমন ঠেকব? এই প্রশ্নের উত্তর আপনে ঠিক ভাবে দিতে পারবেন না, কারণ এই রকম অবস্থার মুখোমুখি আপনে জীবনে কখনও হন নাই। আর হওয়ার কোন সম্ভাবনাও আপনে আপাতত দেখতে পাইতেছেন না। আর কল্পনা কইরা এইরকম একটা উদ্ভট প্রশ্নের উত্তর আপনার দিতেও ইচ্ছা করব না। কিন্তু মজার বিষয় হইলো, এই রকম একটা টাইম লুপে খুব সম্ভবত আপনে অনেক বছর ধইরাই আটকা পইড়া আছেন। সেইটা কিভাবে? জানার আগে চলেন একটু মুভি থাইকা ঘুইরা আসি।

মুভির নাম গ্রাউণ্ডহগ ডে। মুভিটার এই রকম নাম হওয়ার কারণ মুভির কেন্দ্রীয় চরিত্রটাও ‘গ্রাউণ্ডহগ ডে’ তে আইসা একটা টাইম লুপে আটকা পইড়া যায়। প্রায় পুরা মুভিতেই সে এই ‘গ্রাউণ্ডহগ ডে’তেই আটকা পইড়া থাকে।  ‘গ্রাউণ্ডহগ ডে’ জিনিসটা হইলো অ্যামেরিকা আর কানাডায় পালন করা একটা ঐতিহ্যবাহী হলিডে। এই দিনটা আসে ফেব্রুয়ারির ০২ তারিখে। মুভির শুরুতেই দেখা যায় যে আমাদের কেন্দ্রীয় চরিত্রটা পেশায় একজন ওয়েদারম্যান, টিভিতে ওয়েদার রিপোর্ট করে। তো ০২ তারিখ ভোর ৬ টায় তাঁর ঘড়ির রেডিওতে একটা গান বাইঝা উঠে — ‘আই গট ইউ বেইব’, গানের আওয়াজ শুইনা সে জাইগা উইঠা বিরক্তিতে ঘড়িটা ঘুষি দিয়া ভাইঙ্গা তাঁর দিনের কর্মকাণ্ডের জন্যে প্রস্তুত হইতে থাকে। সারা দিন পর কাজ-কর্ম সাইরা ক্লান্ত হইয়া রাতের বেলায় বাসায় আইসা বিছানায় শুইয়া ঘুমাইয়া পড়ে। পরের দিন সকাল ৬ টায় আবারো তাঁর ঘড়িতে বাইজা উঠে — ‘আই গট ইউ বেইব’। বিরক্তি নিয়া ঘুম থাইকা উইঠা আবারো ঘুষি দিয়া ঘড়িটা ভাইঙ্গা দিনের প্রস্তুতি নিতে থাকে আগের মতই। এর মধ্যে অবাক হইয়া সে খেয়াল করে যে আজকের দিনটাও আসলে সেই কালকের ‘গ্রাউণ্ডহগ ডে’ই। সে তখন বুইঝা উঠতে পারে না কি হইতেছে। সারাটা দিন ঠিক আগের দিনের মতই কাটাইয়া বাসায় আইসা সে ঘুমাইয়া পড়ে। পরের দিন সকাল ৬ টায় আবারো তাঁর ঘড়িতে বাইজা উঠে একই গান —‘আই গট ইউ বেইব’। তখন সে বুঝতে পারে যে সে আসলে একটা দিনের মধ্যেই আটকা পইড়া গেছে। সে কিছুতেই এই দিনটার ভিতর থাইকা বাইর হইতে পারতেছে না। এর মধ্যে সে একটা মেয়ের প্রেমেও পইড়া যায়। একদিন মেয়েটারে ইমপ্রেস কইরা ফেলে তো পরের দিন মেয়ে আবার সব ভুইলা নরমাল হইয়া যায়, কারণ মেয়েটার জন্যে তো এই দিনটা প্রথম। এই রকম কইরা এই একটা দিনেই প্রতিদিন সে মেয়েটারে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করে, অন্যসব কাজকর্মও করে, একই টিভি রিপোর্ট প্রতিদিন করে, একটা সময় এই দিনটার প্রতিটা সেকেন্ড তাঁর মুখস্থ হইয়া যায়। এই একদিনের আশা, ভরসা, হতাশা আর উত্তেজনা নিয়া আগাইতে থাকে মুভির কাহিনী।

মুভিটারে অফিসিয়ালি বলা হইয়া থাকে ‘ফ্যান্টাসি-কমেডি’। শুধুমাত্র কমেডি হিসেবে মুভিটা শতভাগ সফল বিনোদনধর্মী একটা সিনেমা হইয়া উঠলেও, মুভিটার আসল প্রাণ হইলো এইটার অন্তর্নিহিত দর্শন। মুভিতে দেখা যায় আমাদের কেন্দ্রীয় চরিত্রটা তাঁর বর্তমান জীবনটা নিয়া খুবই বিরক্ত। সেইটা প্রথমেই প্রকাশ পায় সকালে ঘুম থাইকা উইঠা ঘড়ি ভাঙ্গার দৃশ্যে। অতঃপর তাঁর সারাদিনের একটিভিটি দেইখাও বুঝা যায় সে আসলে তাঁর বর্তমান জীবনের কোন কিছুই পছন্দ করে না। আশেপাশের সবকিছুর প্রতি তাঁর এমন রিয়েকশন প্রকাশ পায় যেন সবকিছুই তাঁর প্রতিকূলে। কোন কিছুই যেন তাঁর ভালো চায় না। সে তাঁর জীবন নিয়া বড়ই অসুখী। কিন্তু এইখানে আসল ব্যাপার হইলো, তাঁর জীবনের এই ভোগান্তি আর দুঃখ কষ্টের পেছনে আসলে তাঁর আশেপাশের পরিবেশ দায়ী না। তাঁর অনুভব করা প্রায় সবগুলা সমস্যাই তৈরি হয় তাঁর মাথায়, যেইগুলার কোন বাস্তবতা নাই। এইটারে বলা হয়, “সাইকো অব সাফারিংস”। সাফারিংসের এই সাইকোতে যখন সে আটকা পইড়া আছে, তখন অলৌকিকভাবে তাঁর জন্যে একটা টাইম লুপ তৈরি হইয়া যায়। এই টাইম লুপে আটকা পইড়া যখন সে লিটারেলি একটা দিনরেই বারবার রিপিট করতে থাকে, তখন সে রিয়েলাইজ করে যে পুরা জীবনটারে আসলে সে নিজেই এক জায়গায় দাড় করাইয়া রাখছে। প্রতিটা দিনই সে রিপিট করে, কারণ একটা দিনও সে পূর্ণতা নিয়া বাঁচে না।

এখন প্রশ্ন হইলো এই মুভির কাহিনীর সাথে আপনার নিজের টাইম লুপে আটকা পইড়া যাওয়ার সম্পর্ক কি হইতে পারে? সম্পর্কটা হয়তো ইতিমধ্যে আপনে নিজেই দেখা শুরু করছেন। তবে উত্তরটা হইলো, আমরা প্রায় সবাই আমাদের প্রতিটা দিনই কাটাই সেই ‘গ্রাউণ্ডহগ ডে’ এর মত। আমরা সবাই যার যার নিজ নিজ ‘গ্রাউণ্ডহগ ডে’ তে আটকা পইড়া আছি। ব্যাপারটা এইরকম হওয়ার কারণ কি? কারণটা হইলো, আমরা কেউই আমাদের বর্তমান মুহূর্তটারে গ্রহণ কইরা নেই না, আর এই গ্রহণ না করার কারণে অনন্তকালের জন্যে আমরা একটা নির্দিষ্ট দিনরেই রিপিট কইরা যাই। আমাদের দিনগুলিরে একটা থাইকা আরেকটা আলাদা করা যায় না। প্রতিটা দিন “সেইম শিট” ডিল করতে করতে আমাদের জীবন পার হইয়া যায়। প্রতিদিনই মনে হয়, পরের দিনই বোধয় ঠিক মত বাঁচতে পারব। কিন্তু এই পরের দিনটা আর কখনই আসে না।

আমরা সময়রে যেভাবে বছর, দিন, মাস, ঘণ্টা, মিনিট আর সেকেন্ডে ভাগ কইরা রাখছি, এইটা কেবলই আমাদের অফিসিয়াল কাজকর্মের সুবিধার্থে করা। প্রকৃত পক্ষে, সময়ে আসলে তেমন কোন ভাগাভাগি নাই, আছে শুধু মুহূর্ত। যখন এই সময়ের এই ভাগাভাগিটা আপনে বাদ দিয়া দিবেন, তখন দেখতে পাইবেন যে আপনে একটা অন্তহীন টাইম লুপে বাস করতেছেন। আপনার সামনে তখন ভাইসা উঠব পুরা ইটার্নিটি। এখন এই ইটার্নিটি আপনে কাটাইবেন কিভাবে? আর এই ইটার্নিটিতে যদি আপনি একটা দিনের মধ্যেই অনন্তকালের জন্যে আটকা পইড়া থাকেন, সেইখান থাইকা বাইর হইবেন কিভাবে?

এই মুভি আপনারে দেখাইয়া দিব কিভাবে। আপনারে দেখাইয়া দিব কিভাবে প্রতিটা দিন একসেপ্ট করার মধ্য দিয়া আপনে সম্পূর্ণ নতুন আরেকটা দিনে পাও রাখতে পারবেন, যেইখানে আপনার জন্যে অপেক্ষা করতেছে নতুন আরেকটা জীবন। মুভি দেখতে দেখতে কেন্দ্রীয় চরিত্রটার সাথেই আপনে শেষের দিকে গিয়া নতুন একটা দিনের নতুন একটা ভোরে নতুন ভাবে হয়তো জাইগা উঠবেন।

তবে নতুন দিনে জাইগা উঠার আগে ‘গ্রাউণ্ডহগ ডে’র টাইম লুপে সে কতদিন আটকা পইড়া থাকে সেইটা নিয়া প্রশ্ন আইসা পড়ে। স্পিরিচুয়াল সেন্স থাইকা বলা হয়, একটা আত্মার পরের লেভেলে পৌঁছাইতে কমপক্ষে দশ হাজার বছর সময় লাগে। শুইনা ভয় পাওয়ার কিছু নাই, কারণ আপনার হাতে আছে অনন্তকাল। এইখানে দশ হাজার বছর তেমন কিছুই না। তবে মুভির রিয়েল টাইমের হিসাবে ধইরা নেওয়া হয়, কেন্দ্রিয় চরিত্রটা এই মুভিতে আটকা পইড়া ছিল ১২,৩৯৪ দিন, অর্থাৎ ৩৪ বছর।

মুভির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করছে অ্যামেরিকান অভিনেতা বিল মারি। বিল সম্ভবত তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়টা দেখাইছে এই মুভিতেই। এত গভীর ও জটিল জীবন দর্শন বহন করলেও মুভিটা বিনোদন হিসেবে খুবই উপভোগ্য। চমৎকার এই মুভির পরিচালক হইলেন হ্যারোল্ড রামিস। মুভিটা কালচারাল আর হিস্ট্রিকাল সিগনিফিকেন্সের জন্যে অ্যামেরিকান ন্যাশনাল ফিল্ম রেজিস্ট্রিতে নিজের জায়গা কইরা নিছে ২০০৬ সালে।

ক্রিটিকদের কাছ থাইকা পজিটিভ রিভিও সহ, মুভিটা অডিয়েন্সের কাছ থাইকা পাইছে ৮৭% স্কোর। আইএমডিবিতে রেটিং ৮। আর রটেন টমেটোতে মুভিটা ৯৬% ফ্রেশ।

রিভিও শেষ।

Comments

comments

2,204 views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *